সমস্যা চিহ্নিত করার পরও সমাধানের জন্য সমবেত ও সমন্বিত উদ্যোগ না নিয়ে এর সঙ্গে বসবাসেই যেন আমরা অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি। বাল্যবিবাহ যে আমাদের একটি বড় সামাজিক সমস্যা, এটা কে না জানে? কত উদ্যোগ, কত আয়োজন, প্রচার-প্রচারণা, আইন-অথচ বাল্যবিবাহ আগেও যেমন ছিল, এখনো তা আছে। ঘটা করে হয়তো বাল্যবিবাহের ঘটনা ঘটছে না, তবে গোপনে বা কোনো না কোনো কৌশলে তা চলছে।
নারীর অধিকার ও মর্যাদা নিয়ে বহু বছর ধরে কাজ করছে মহিলা পরিষদ। এই সংগঠনের পক্ষ থেকে বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে সামাজিক সচেতনতা ছাড়াও আইন তৈরির জন্য বিভিন্ন সময় উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। বাল্যবিবাহ নিরোধ আইনও সরকার করেছে, সেটাও কয়েক বছর হয়ে গেল। কিন্তু তারপরও বাল্যবিবাহ যে কমছে না, তা মহিলা পরিষদেরই এক গবেষণা থেকে জানা যাচ্ছে।
শুধু গ্রামীণ দরিদ্র ও শিক্ষার আলোবঞ্চিত পরিবারে নয়, মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোতেও বাল্যবিবাহের হার অত্যন্ত উদ্বেগজনক, মোট বাল্যবিবাহের প্রায় এক-চতুর্থাংশ। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ ‘বাল্যবিয়ের কারণ ও সামাজিক অভিঘাত’ শীর্ষক একটি সমীক্ষা করেছে।
২০২১ থেকে চলতি বছরের মে মাস পর্যন্ত আটটি বিভাগের সিটি করপোরেশন থেকে ইউনিয়ন পর্যায় পর্যন্ত ২ হাজার ৬০ জনের প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে এই সমীক্ষা থেকে জানা গেছে, বাল্যবিবাহ দেয়া অভিভাবকদের মধ্যে প্রায় ৩১ শতাংশ (২৬০ জন) নিরক্ষর, ৪১ শতাংশ (৩৪৭ জন) অক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন, ২৬ শতাংশ (২১৭ জন) স্বল্পশিক্ষিত এবং শিক্ষিত ৪ শতাংশ (৩৩ জন)।
এই জরিপে অভিভাবকদের দেয়া তথ্যে দেখা গেছে, ১৩-১৫ বছর বয়সি কন্যাশিশুরাই বেশি বাল্যবিবাহের শিকার, যা মোট বাল্যবিবাহের ৭২ শতাংশ। অন্যদিকে বাল্যবিবাহের শিকার ৫৭ শতাংশ কন্যাশিশুর বিয়ে ১২-১৫ বছরের মধ্যে হয়েছে। ৫৬ শতাংশ অভিভাবক বাল্যবিবাহের আইন সম্পর্কে অবগত হয়েও আইন অমান্য করে নানাভাবে তাদের কন্যাশিশুর বিয়ে দিয়েছেন।
আইন অনুযায়ী, ১৮ বছরের কম বয়সি কোনো মেয়ের বিয়ে দেয়া অপরাধ। অথচ নানা অজুহাতে ১৮ বছরের আগেই অনেক মেয়ের বিয়ে দেয়া হচ্ছে। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে বয়স বাড়িয়ে অসৎ উপায়ে জন্মনিবন্ধন সনদ সংগ্রহ করে কিংবা কোনো কোনো ক্ষেত্রে যে কাজি বিয়ে পড়ান বা নিবন্ধন করেন, তিনিও টাকার বিনিময়ে জন্মনিবন্ধন সনদ ছাড়াই কাজটি করছেন।
বাল্যবিবাহ নিরোধবিষয়ক আইন থাকলেও তা কার্যকর করার ক্ষেত্রে কড়াকড়ি আরোপ না করার জন্যই আইন না মানার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। আইন থাকলেই হবে না, আইন অমান্য করলে শাস্তি পেতে হবে এটা বাস্তবায়ন না করলে সুফল পাওয়ার আশা কম।
মন্ত্রণালয়, প্রশাসন, জনপ্রতিনিধি, নাগরিক সমাজ, বিভিন্ন মানবাধিকার ও উন্নয়ন সংগঠন যদি সমন্বয়ের মাধ্যমে কাজ করে, তাহলে বাল্যবিবাহ বন্ধে ইতিবাচক পরিবর্তন আসতে পারে।
দারিদ্র্য, নিরাপত্তাহীনতাসহ যেসব অজুহাতে বাল্যবিবাহ দেয়া হয়ে থাকে, সেগুলো দূর করার উদ্যোগও অবশ্যই থাকতে হবে।
ভোরের আকাশ/নি