রাতে বাসযোগে বাসায় ফিরছিলেন ৪৫ বছর বয়সি নারী। পথিমধ্যে অন্য যাত্রীরা নেমে গেলে বিপদ ঘনিয়ে আসে। নির্জন সড়কে বাসের চালকের সহযোগী ও সুপারভাইজার মিলে ঝাপটে ধরে ওই নারীকে। জোর করে ধর্ষণের চেষ্টা করে। অসহায় নারী চিৎকার করতে থাকেন। একপর্যায়ে চলন্ত বাস থেকে লাফিয়ে পড়েন তিনি।
পরে আশপাশের লোকজন গুরুতর আহত অবস্থায় তাকে উদ্ধার করে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ (মমেক) হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় পরদিন ১৮ জুন মৃত্যু ঘটে তার। ঘটনাটি ঘটে ময়মনসিংহের ভালুকায়। মৃত ওই নারী একজন গার্মেন্ট কর্মী। তার বাড়ি কিশোরগঞ্জ জেলার করিমগঞ্জ উপজেলায়। তিনি ভালুকার মল্লিকবাড়ি নয়নপুরে ভাড়া বাড়িতে থাকতেন। স্বামী নেই।
দীর্ঘ ১০ বছর ধরে পোশাক শ্রমিকের কাজ করে দুই সন্তানকে লেখাপড়া করাচ্ছিলেন এই নারী। সন্তানদের একজন সিলেট পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে অন্যজন কিশোরগঞ্জ পলিটেকনিক স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থী। ভালুকা মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. কামাল হোসেন জানান, বাসটির চালক ২১ বছর বয়সি রাকিব মিয়া, ২০ বছর বয়সি হেলপার আরিফ মিয়া ও ২১ বছর বয়সি সুপারভাইজার আনন্দ দাসকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
এভাবে প্রায়ই ঘটছে ধর্ষণের ঘটনা। বাসে, নির্জন সড়কে, বাসায় ধর্ষণের শিকার হচ্ছেন নারী ও শিশুরা। কখনো কখনো ধর্ষণের পর নির্যাতিতাকে হত্যা করা হচ্ছে। সমাজ বিজ্ঞানীরা জানান, বিচার কার্যক্রমের দীর্ঘসূত্রতার কারণে নানা কৌশলে অপরাধীরা পার পেয়ে যাচ্ছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অপরাধীদের শাস্তি না হওয়ায় ধর্ষণের পরিসংখ্যান কমছে না কিছুতেই।
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের তথ্যানুসারে, গত জুন মাসে সারা দেশে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ২৬৫ নারী ও শিশু। এর মধ্যে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৩৭ জন। তাদের মধ্যে দলবদ্ধভাবে ধর্ষণ করা হয়েছে ১৩ জনকে। ধর্ষিতাদের মধ্যে ১১ জনের বয়স ১৮ বছরের নিচে। ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে তিনজনকে। তার আগে গত মে মাসে বিভিন্নভাবে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ৩০১ জন নারী ও কন্যাশিশু। তাদের মধ্যে ৪৯ শিশুসহ ৬৫ জন ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে আট শিশুসহ ১৫ জন দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। এক কন্যাশিশুকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে।
সমাজ বিজ্ঞানীরা জানান, সামাজিক কারণে নির্যাতিতারা থানা-পুলিশমুখো হতে চান না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ধর্ষকরা প্রভাবশালী হওয়ায় উল্টো আতঙ্কে থাকেন নির্যাতিতা। যে কারণে ধর্ষণ বা যৌন নির্যাতনের প্রকৃত চিত্র সহজে জানা দুষ্কর। কিছু কিছু ক্ষেত্রে গ্রাম্য বিচার-সালিশে সমাধানের চেষ্টা করেন স্থানীয়রা।
ভুক্তভোগীরা জানান, নিয়ম অনুযায়ী নির্যাতিতার ডাক্তারি পরীক্ষা করা হয়। আসামিদের ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষা করাতে পাঠানো হয়। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন (সংশোধন) আইন, ২০০৩ অনুযায়ী ৬০ কার্যদিবসের মধ্যে তদন্ত শেষ করে আদালতে চার্জশিট দেয়ার কথা থাকলেও বাস্তবে হয়ে ওঠে না। নির্যাতিতার পরীক্ষা এবং আসামিদের ডিএনএ নমুনা পরীক্ষার রিপোর্ট পেতে বিলম্ব, মামলার তদন্তে বিলম্ব হতেই থাকে। সেইসঙ্গে নির্ধারিত তারিখে আদালতে দৌড়াতে হয় নির্যাতিতাকে। সবকিছু মিলিয়ে মামলা, তদন্ত ও বিচার কার্যক্রম আরো মহজ এবং দ্রুত সম্পন্ন করার দাবি ভুক্তভোগীদের।
২০২০ সালে পরপর কয়েকটি ধর্ষণ ও সংঘবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনায় দেশব্যাপী তোলপাড় সৃষ্টি হয়। প্রতিবাদ ও আন্দোলনের মুখে ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি করা হয় মৃত্যুদন্ড। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে সংশোধনী এনে অধ্যাদেশের মাধ্যমে তা ইতোমধ্যে কার্যকরও করা হয়েছে। তবে তদন্ত ও বিচারের প্রক্রিয়ায় গলদ বা ফাঁকফোকর থাকলে আইন কঠোর করার পরও সহজে সুফল পাওয়া যাবে না বলেই মনে করছেন নির্যাতিতারা।
এসব বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ কল্যাণ ইনস্টিটিউটের শিক্ষক, সমাজ ও অপরাধ বিজ্ঞানী তৌহিদুল হক বলেন, এই ডিজিটাল যুগে নানা মাধ্যমে যৌন উত্তেজনা সৃষ্টি হচ্ছে। এতে তরুণ সমাজ বিপথগামী হচ্ছে। তবে শুধু যৌন আকাক্সক্ষা থেকেই ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে তা নয়। অনেক ক্ষেত্রে প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে ধর্ষণ করা হচ্ছে। ধর্ষণ প্রতিরোধে যথাযথভাবে আইন প্রয়োগের পাশাপাশি সমাজে ধর্মীয় মূল্যবোধ সৃষ্টি করতে হবে। ভিনদেশি অপসংস্কৃতির বদলে বাঙালি সংস্কৃতির চর্চা করতে হবে বলে মনে করেন তিনি।
ভোরের আকাশ/নি