logo
আপডেট : ৪ জুলাই, ২০২৩ ১০:৫৯
ভক্তদের হতাশ করে চলে গেলেন মার্টিনেজ
মুস্তাফিজুর রহমান নাহিদ

ভক্তদের হতাশ করে চলে গেলেন মার্টিনেজ

মুস্তাফিজুর রহমান নাহিদ: বাংলাদেশের মানুষ ফুটবলপ্রেমী। বিশেষ করে আর্জেন্টিনা বা ব্রাজিলের খেলা থাকলে এদেশের ফুটবলপ্রেমীদের রাতের ঘুম হারাম হয়ে যায়। এ দুই দলের খেলা থাকলে অফিসপাড়া থেকে শুরু করে গলির মোড়ের চা-দোকানে চলে আলোচনা-সমালোচনা। কার দল হারবে কার দল জিতবে এ নিয়ে ভীষণ তর্ক শুরু হয়।

 

বিশ্বকাপ এলে চিত্র আরো বদলে যায়। প্রিয় দলের জার্সি আর পতাকায় ছেয়ে যায় দেশ। চলে আড্ডা-তর্ক-বাজি। কখনো কখনো তা চলে যায় হাতাহাতির পর্যায়ে। কিন্তু যাদের নিয়ে এতে মাতামাতি, তাদের বেশিরভাগই বাংলাদেশের নামটিও শোনেননি।

 

ম্যারাডোনাকে একবার বলা হয়েছিল, বাংলাদেশে আপনার লাখ লাখ দর্শক রয়েছে। ফুলবল ঈশ্বর চোখ বড় করে বলেছিলেন, বাংলাদেশ! হোয়ার ইজ বাংলাদেশ? পরে অবশ্য তিনি বাংলাদেশে আসার ইচ্ছে প্রকাশ করেছিলেন। ম্যারাডোনা-পেলের মৃত্যুতে মন খারাপ করেনি এমন বাঙালি খুঁজে পাওয়া মুশকিল। সবকিছু পেছনে ফেলে আর্জেন্টিনা-ব্রাজিলের তারকারা এদেশের মানুষের কাছে তারকাদের তারকা। তাদের একটু সান্নিধ্য পেতে মুখিয়ে থাকেন এদেশের ভক্ত-দর্শকরা।

 

তেমনি আর্জেন্টিনার তারকা এমিলিয়ানো মার্টিনেজকে একবার দেখার জন্য অপেক্ষায় ছিলেন বাংলাদেশের তারকা ফুটবলার জামাল ভূইয়া থেকে শুরু করে লাখো মানুষ। কিন্তু কারো সঙ্গে দেখা করলেন না মার্টিনেজ। ভক্তদের হতাশ করে উড়াল দিলেন পাশের দেশ ভারতে। আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ জেতানো গোলরক্ষক মার্টিনেজ ১১ ঘণ্টার সংক্ষিপ্ত এক সফরে ঢাকা এসেছিলেন।

 

সেই সফরে সাধারণ ফুটবলপ্রেমী তো নয়-ই; এমনকি গণমাধ্যমেরও কোনো প্রবেশাধিকার ছিল না। এ নিয়ে নানা অঙ্গনে চলছে আলোচনা-সমালোচনা। মার্টিনেজকে বাংলাদেশে এনেছিল ফান্ডেড নেক্সটের প্রতিষ্ঠান নেক্সট ভেঞ্চার। তারা অর্থ ব্যয় করে আনলেও জনসাধারণ; এমনকি মিডিয়ার জন্য কোনো সেশনই ছিল না। এ নিয়ে সোমবার ফান্ডেড নেক্সটের কর্মকর্তারা ব্যাখ্যা দিয়েছেন।

 

সকালে ফান্ডেড নেক্সট কার্যালয়ে মার্টিনেজ পরিদর্শনের সময় আমন্ত্রিত অতিথি হয়ে আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক এসেছিলেন। ভক্তদের সম্পৃক্ত না করা নিয়ে তাকেও প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়েছে। এর উত্তরে তিনি বলেন, ‘ফান্ডেড নেক্সটের ব্যক্তিগত উদ্যোগে মার্টিনেজ এসেছেন। সময় স্বল্পতায় তারা পাবলিক অনুষ্ঠান করতে পারেননি।’

 

পলক তার নিজের আমন্ত্রণ প্রসঙ্গে বলেন, ‘জায়েদ এবং গালিব আমার কাছের ছোট ভাই, তারা আইটি সেক্টর নিয়ে কাজ করে। ২৬ জুন এটি কনফার্ম হওয়ার পর তারা আমাকে জানায়। আমিও ৬ বছর বয়স থেকে আর্জেন্টিনার সমর্থক। তাই সপরিবারে এসেছি।’ পলক গণমাধ্যমে তার প্রারম্ভিক বক্তব্যে বলেছিলেন, মার্টিনেজের এ সফর ফুটবলারদের অনুপ্রেরণা দেবে। এত বড় ফুটবলার বাংলাদেশে এলেন, কিন্তু সান্নিধ্যে যাওয়ার সুযোগ পাননি কোনো ফুটবলার। অথচ ডাকা হয়েছে এক সাবেক ক্রিকেট অধিনায়ক মাশরাফি বিন মুর্তজাকে।

 

এ নিয়ে গণমাধ্যমে উত্তর দিতে হয়েছে পলককে, ‘আমন্ত্রণের বিষয়ে আমি পুরোপুরি উত্তর দেয়ার অবস্থানে নেই। মাশরাফি নিজেও আর্জেন্টিনার সমর্থক। এখানে আসলে জায়েদ ও গালিবের ঘনিষ্ঠজনরাই আমন্ত্রিত হয়েছে। সুনির্দিষ্ট কোনো ক্রাইটেরিয়া ছিল না।’ আর্জেন্টিনার প্রতি বাংলাদেশের ভালোবাসা প্রকাশ হয়েছে মিডিয়ার মাধ্যমে। মার্টিনেজের সফরে মিডিয়া একেবারেই উপেক্ষিত ছিল। প্রশ্ন করার সুযোগ তো ছিলই না; এমনকি চিত্রগ্রহণও ভালোভাবে করা যায়নি। মূল ধারার গণমাধ্যম উপেক্ষিত থাকলেও ইউটিবারদের মার্টিনেজের সাক্ষাৎ করতে দেখা গেছে।

 

এ নিয়ে প্রতিমন্ত্রীর বক্তব্য, ‘এখানে যারা এসেছে, সবাই জায়েদ ও গালিবের সম্পর্কের মাধ্যমেই। অনেকটা পারিবারিক ও তাদের পরিচিত পরিবেশে অনুষ্ঠানটি হয়েছে। যারা সুযোগ পেয়েছেন, তারাও আমন্ত্রিত ছিলেন।’ এ নিয়ে গণমাধ্যমকে দুঃখিত না হওয়ার অনুরোধ জানান পলক। মার্টিনেজ মূলত ৪-৫ জুলাই কলকাতায় থাকার কথা। তাকে কলকাতা আনছেন কলকাতার ক্রীড়া উদ্যোক্তা শতদ্রু দত্ত।

 

তিনি কলকাতার আগে বাংলাদেশে ঘুরিয়ে নেয়ার পরিকল্পনা করেন। প্রথমে পরিকল্পনা ছিল পুরো দিনই বাংলাদেশে রাখার। অনেক প্রতিষ্ঠান স্পন্সর করতে এগিয়ে আসার আগ্রহী হলেও ডলার সংকট জটিলতায় সেটি সম্ভব হয়নি। মার্টিনেজ বাংলাদেশে এসেছেন শুভেচ্ছা সফরে। এক পক্ষের বড় আর্থিক সুবিধা না হওয়ায় সমর্থক ও মিডিয়ার সামনে আনা হয়নি মার্টিনেজকে এ নিয়ে কানাঘুষা চলছে। এরপরও শেষ পর্যন্ত মার্টিনেজ এসেছেন ১১ ঘণ্টার সংক্ষিপ্ত সফরে। এতেই তৃপ্ত পলক, ‘বাংলাদেশ সফরটি তার নির্ধারিত সূচিতে ছিল না। এরপরও তিনি এসেছেন, এটা বাংলাদেশের জন্যও একটা গর্বের বিষয়।’

 

অপেক্ষায় ছিলেন জামাল, চলে গেলেন মার্টিনেজ : বাংলাদেশ ফুটবল দল ভারতের ব্যাঙ্গালুরুতে সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ খেলে দেশে ফিরেছে। হায়দরাবাদ ও মুম্বাই হয়ে দুই ফ্লাইটে দুপুর সোয়া ১টায় ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে এসে পৌঁছান ফুটবলাররা। একই সময়ে বিমানবন্দরে ঢাকা ছাড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন ১১ ঘণ্টার সংক্ষিপ্ত সফরে বাংলাদেশ সফরে আসা আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপজয়ী গোলরক্ষক মার্টিনেজ।

 

বাংলাদেশ অধিনায়ক জামাল ভূইয়া বিমানবন্দরে আর্জেন্টাইন গোলরক্ষক মার্টিনেজের অপেক্ষায় ছিলেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ শেষে মার্টিনেজ বিমানবন্দরের উদ্দেশে রওনা হন। বাংলাদেশ ফুটবল দল বিমানবন্দরের আনুষ্ঠানিকতা শেষে বের হওয়ার পথে ছিল তখন। কিছু সময় মার্টিনেজের জন্য অপেক্ষা করেও সাক্ষাৎ পাননি বাংলাদেশ ফুটবল দলের অধিনায়ক জামাল ভূইয়া।

 

বিমানবন্দর থেকে বাংলাদেশের অনেক ফুটবলার নিজ গন্তব্যে রওনা দিয়েছিলেন। জামাল ভূইয়া টিম অ্যাটেনডেন্ট মো. মহসীনকে নিয়ে মার্টিনেজকে দেখতে বহির্গমনের দিকে যান। মার্টিনেজকে স্বল্প দূরত্ব থেকে দেখলেও বাংলাদেশের অধিনায়ক ফ্রেমবন্দি হওয়া কিংবা পরিচিত হওয়ার সুযোগ পাননি।

 

জাতীয় দলের টিম অ্যাটেনডেন্ট মো. মহসীন ঘটনা বর্ণনা করলেন এভাবে, ‘অনেকে চলে গেলেও জামাল ভাইয়ের মার্টিনেজের সঙ্গে দেখা করার ইচ্ছা ছিল। তিনি আমাকেও সঙ্গে নেন। আমরা অপেক্ষা করছিলাম এবং কয়েকজনকে বলেছি, বাংলাদেশ দলের অধিনায়ক অপেক্ষা করছেন। মার্টিনেজ গাড়ি থেকে নামার পরপরই তাকে ভেতরে নিয়ে যাওয়া হয়।’

 

বাজপাখি, নৌকা ও বঙ্গবন্ধুর বই উপহার পান মার্টিনেজ : আর্জেন্টিনার জাতীয় দলের গোলরক্ষক ও নির্ভরতার প্রতীক এমিলিয়েনো মার্টিনেজ। ১১ ঘণ্টার সংক্ষিপ্ত সফরে তিনি বাংলাদেশে এসেছেন। সেই সফরে তার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেছেন আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ হোসেন পলক। মার্টিনেজের সঙ্গে প্রায় পৌনে ১ ঘণ্টা সময় কাটানোর পর গণমাধ্যমের মুখোমুখি হয়েছেন পলক। মার্টিনেজকে বাংলাদেশে এনেছে ফান্ডেড নেক্সট কোম্পানি।

 

সেই কোম্পানির পক্ষ থেকে তাকে বেশকিছু উপহার সামগ্রী দেয়া হয়েছে। মার্টিনেজকে বাংলাদেশের সমর্থকরা বাজপাখি বলে ডাকেন। সেই ‘বাজপাখি’ উপহার দেয়া হয়েছে তাকে। পলক বলেন, ‘মার্টিনেজকে বাজপাখি উপহার দিয়েছে ফান্ডেড নেক্সট। এতে সে খুবই খুশি হয়েছে।’ বাজপাখি নামটিও তার খুব পছন্দ বলে জানান তিনি, ‘মার্টিনেজ বাজপাখি নামটি বেশ পছন্দ করেছে।

 

সে নিজেও বেশ কয়েকবার এটি বলেছে।’ বাজপাখির সঙ্গে দেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের প্রতীকও দেয়া হয়েছে। নদীমাতৃক দেশ নৌকাও দেয়া হয়েছে আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপজয়ী দলের সদস্যকে, ‘পাটের তৈরি একটি নৌকা এবং বঙ্গবন্ধুর বই উপহার দেয়া হয়েছে।’

 

মার্টিনেজকে কাছে পেয়ে মহাখুশি আর্জেন্টিনাভক্ত মাশরাফি : তার বাংলাদেশ সফরের আয়োজনে অতিথি হিসেবে আমন্ত্রণ পেয়েছেন আকাশি-সাদাভক্ত মাশরাফি। মার্টিনেজকে বাংলাদেশে এনেছে ফান্ডেড নেক্সট নামক আইটি কোম্পানি।

 

সকাল সাড়ে ৯টার কিছুক্ষণ পর মার্টিনেজ উত্তর বাড্ডাস্থ অফিস পরিদর্শনে আসেন। আয়োজকরা মার্টিনেজকে বরণ করে নিতে সংসদ সদস্য ও জাতীয় ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক মাশরাফি বিন মুর্তজাকে আমন্ত্রণ জানায়। বাংলাদেশের সফল সাবেক অধিনায়ক মাশরাফি বিন মুর্তজা আর্জেন্টিনার কট্টর সমর্থক। আর তাই মার্টিনেজের সফর নিয়েও উচ্ছ¡সিত তিনি।

 

বলেন, ‘এমিকে ভালো লাগার শুরু কোপা আমেরিকা থেকেই, যেখানে সে টাইব্রেকারে দুটি গোল আটকে দিয়ে দলকে জয় এনে দিল। কত বছর পর বড় কোনো শিরোপা জিতল আর্জেন্টিনা! লিওনেল মেসিও পেল দেশের হয়ে প্রথম বড় ট্রফির স্বাদ। স্বাভাবিকভাবেই পাখির চোখে তাকিয়ে ছিলাম বিশ্বকাপের দিকে। কিন্তু সৌদি আরবের সঙ্গে হেরে মনে হয়েছিল, আরেকটি বিশ্বকাপও হয়তো শেষ হবে হতাশায়। কিন্তু অবিশ^াস্যভাবে ঘুরে দাঁড়ানো এবং পরে বিশ্বকাপ জয় দেখতে পারাটা ছিল অনেক দিনের লালিত স্বপ্ন পূরণের মতো।

 

মাশরাফি বলেন, সেই জয়ের অন্যতম নায়ক এমির সঙ্গে দেখা হলো আমাদের এ ঢাকায়। খুব অল্প সময়ের জন্য দেখা, কিন্তু দারুণ এক অনুভূতি। বিশ্বকাপজয়ী দলের গোলকিপার চোখের সামনে! সে তো জানে না, আমার এবং আমার মতো আরো কত কোটি মানুষের কত বছরের অপেক্ষা শেষ হলো, যেদিন তার ওই হাত ধরেই আর্জেন্টিনা বিশ্বকাপ জয় করল! আজকে সে ইন্টারভিউয়ের মাঝেই একবার ট্রাউজার উঠিয়ে দেখাল, পায়ের ঠিক সেই জায়গায় একটি ট্যাটু করিয়েছে, বিশ্বকাপ ফাইনালে শেষ বাঁশির ১৮ সেকেন্ড আগে কোলো মুয়ানির শটটি আটকিয়ে দিয়েছিল যে জায়গা দিয়ে।

 

এক সেকেন্ডের জন্য মনে হলো, আসলে বিশ্বকাপটা তো ওখানেই জিতে নিয়েছে। নিজের সন্তানদের প্রসঙ্গ টেনে মাশরাফি লিখেছেন, বেশি ভালো লাগছে আমার সন্তানদের জন্য। যখন বললাম, ‘এমি আসছে, তোমাদের কি দেখা করার ইচ্ছা আছে?’ ওরা লাফাচ্ছিল।

 

সর্বশেষ দুটি দিন ওরা ঠিকমতো ঘুমাতে পারছিল না এমিকে দেখবে বলে। আজকে এমির সঙ্গে দেখা হওয়ার পর বললাম, ‘বাচ্চারা তোমার অটোগ্রাফ নিতে চায়।’ সে এত আন্তরিকতা দেখাল, এক কথায় অসাধারণ। এমনকি সে ছবিও তুলে দিল ওদের সঙ্গে। এখন তারা মহাখুশি, আর ওদের খুশিতে আমিও এখন মহাখুশি।

 

এমি, আপনাকে স্বাগত এ বাংলার মাটিতে। এখানে আপনাদের অগণিত ভক্ত আছে, যুগ যুগ ধরে। আশা করি, আপনারও ভালো লাগছে এ মাটিতে পা রেখে। পাশাপাশি এটাও ভাবি, সত্যি বাংলাদেশ এক দিন বিশ্বকাপ ফুটবলে কোয়ালিফাই করবে আর আমরা আমাদের পতাকা নিয়ে মিছিল করব, ইনশাআল্লাহ।

 

ভোরের আকাশ/নি