ঢাকার শান্ত ভোরের স্নিগ্ধতাকে এতটুকু বিরক্ত না করেই তিনি প্রথমবার পা রাখলেন বাংলাদেশে। লাল-সবুজের পতাকার সঙ্গে ভালোবাসার ইমোজি দিয়ে ইনস্টাগ্রামে লিখলেন ‘বাংলাদেশ’; যেন কল্পনায় আঁকা ছবির এক দেশে পা রেখেছেন আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপজয়ী গোলরক্ষক এমিলিয়ানো মার্টিনেজ। কাতার বিশ্বকাপের পর থেকে যে নতুন আত্মীয়তা হয়েছে বাংলাদেশিদের সঙ্গে, সেই কুটুমবাড়িতে অন্তত একবার ঘুরে গেলেন এমিলিয়ানো।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আতিথেয়তা পেলেন, পরিচিত হলেন মাশরাফি বিন মুর্তজা ও আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলকের সঙ্গে বাংলাদেশের জার্সি, নৌকা ও বাজপাখির রেপ্লিকা উপহারও পেলেন। পেলেন ভালোবাসার ছোঁয়াও। কিন্তু তার মানসপটে বাংলাদেশের আর্জেন্টাইন ভক্তদের যে ছবি আঁকা ছিল, তার স্পর্শ কতটা পেলেন?
বিমানবন্দর থেকে হোটেল, সেখান থেকে স্পন্সর প্রতিষ্ঠান নেক্সট ভেঞ্চারের অফিস হয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ঘড়ি দেখে ছোটাছুটিতে কেবল কালো কাচে ঘেরা গাড়িতে এক বিশ্বকাপজয়ীর অস্পষ্ট ছবিই দেখলেন তার ভক্তরা।
বাংলাদেশের আর্জেন্টাইন সমর্থকদের যে আবেগ দেখে মন দেওয়া-নেওয়া শুরু, সমর্থকদের যে উন্মাদনা দেখে ভালোবাসার সম্পর্ক গাঢ়; সেই সাধারণ সমর্থকদের তৃষ্ণা অপূর্ণই থেকে গেলÑ ‘হে ক্ষণিকের অতিথি, এলে প্রভাতে কারে চাহিয়া...।’
এত অল্প সময়ে মার্টিনেজের হয়তো বাংলাদেশ দর্শনের ইচ্ছা পূরণ হয়েছে, কিন্তু অপূর্ণ যে থেকে গেছে ভক্তকুলের একটা বিশাল অংশের। মাশরাফির ভাষায়, ‘মার্টিনেজকে সাধারণের মাঝে আনতে পারলে ভালো হতো। ওরা (আর্জেন্টাইনরা) যা শুনেছে, তা বুঝতে পারল না। যদি মানিক মিয়া অ্যাভিনিউতে অন্তত ১০ মিনিটের জন্য মার্টিনেজকে আনা যেত, তাহলে সাধারণ ভক্তরা তাদের সমর্থন প্রকাশ করতে পারত। তবে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে যখন তার দেখা হয়েছে, তাহলে নিশ্চিত তাকে সেভাবেই আপ্যায়ন করা হয়েছে।’
কিন্তু কেন সমর্থকদের সামনে আনা গেল না মার্টিনেজকে? বিশ্বকাপজয়ী এই ফুটবলারকে যিনি ঢাকা নিয়ে আসছেন, কলকাতার সেই ক্রীড়া উদ্যোক্তা শতদ্রæ দত্তর ব্যাখ্যাটা এমন, ‘আমি তো চেয়েইছিলাম, কিন্তু হলো না। মার্টিনেজ যখন নিজের ইচ্ছাতেই বাংলাদেশে আসতে চান, তখন থেকেই আমরা পৃষ্ঠপোষক খুঁজতে শুরু করি। প্রায় এক মাস আগে থেকে আমরা ঢাকার কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কথাও বলি।
আমরা চেয়েছিলাম, কলকাতার মতো সমর্থকদের নিয়ে এখানে কিছু করতে। কিন্তু পৃষ্ঠপোষকরা আগ্রহ দেখায়নি। পরে মার্টিনেজের চাওয়াতেই শুধু বিমান আর হোটেল ভাড়া দেয়ার শর্তে কয়েক ঘণ্টার জন্য তাকে নিয়ে আসা হয়েছে। ভবিষ্যতে মার্টিনেজ তার দলের সঙ্গেই বাংলাদেশে আসতে চেয়েছেন।’
শতদ্রু যেটা বলেননি, সেটাই হলো আসল কারণ। গতকালই বিকেল সাড়ে ৪টার ফ্লাইটে কলকাতা চলে গেছেন মার্টিনেজ। সেখানে দু’দিনের সব মহোৎসব হবে মার্টিনেজকে নিয়ে। যার সবটাই বাণিজ্যিক। কলকাতায় আজ ‘তাহাদের কথা’ নামে একটি অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে মার্টিনেজ বিশ্বকাপ এবং তার সাফল্যের গল্প শোনাবেন। যা শোনার জন্য সর্বোচ্চ ১ লাখ ২৫ হাজার রুপি দিয়ে টিকিট কিনেছেন অনেকে। এখন সেই গল্পগুলো যদি ঢাকায় শুনিয়ে যান, তাহলে কলকাতার সেই টিকিট যে জলে যাবে! এ জন্যই কোনো মিডিয়া সেশন রাখা হয়নি।
তাই বলে কি ঢাকায় সমর্থকদের সামনে এসে একবারের জন্যও হাত নাড়াতে পারতেন না মার্টিনেজ? ফান্ডেড নেক্সটের যে প্রতিষ্ঠান নেক্সট ভেঞ্চার মার্টিনেজকে আতিথেয়তা দিয়েছে, কাল সেখানে মিডিয়া এবং ক্রীড়াসংশ্লিষ্টতা ছিল উপেক্ষিত। অথচ কিছু ইউটিউবারের জায়গা হয়েছে ওই অনুষ্ঠানে। বাফুফে বা ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের কোনো সম্পৃক্ততা ছিল না এই অনুষ্ঠানে। এ নিয়ে চাপা ক্ষোভ রয়েছে ক্রীড়াঙ্গনেও।
এসব নিয়েই কাল গণমাধ্যমের প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয় আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলককে। ‘ফান্ডেড নেক্সটের ব্যক্তিগত উদ্যোগে মার্টিনেজ এসেছেন। সময় স্বল্পতায় তার পাবলিক অনুষ্ঠান করতে পারেননি। জায়েদ ও গালিবের (ফান্ডেড নেক্সট) ঘনিষ্ঠজনই আমন্ত্রিত হয়েছে। সুনির্দিষ্ট কোনো ক্রাইটেরিয়া ছিল না।’
‘বাজপাখি’ নামটা সঙ্গে করে নিয়ে গেলেন মার্টিনেজ সমর্থকদের কাছাকাছি না যেতে পারলেও তাদের দেয়া ডাকনামটি নিয়ে গেলেন তিনি সঙ্গে করেÑ ‘বাজপাখি’। হ্যাঁ, এই নামেই যে তাকে বাংলাদেশের ভক্তরা ডাকেন। এদিন তাকে সেই কথা জানানোর পর নিজের মুখেই বারবার বলেছেন ‘আমি বাংলাদেশের বাজপাখি।’
এদিন পৃষ্ঠপোষক প্রতিষ্ঠানের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা আবদুল্লাহ গালিব ফেসবুকে মার্টিনেজের একটি ভিডিও শেয়ার করেন। যেখানে দেখা যায়, বাংলাদেশকে ধন্যবাদ জানান বিশ্বকাপজীয় এই তারকা। মার্টিনেজ বলেন, ‘হাই বাংলাদেশ। ধন্যবাদ সাপোর্ট করার জন্য। আমি বাংলাদেশের বাজপাখি।’
এর আগে আবদুল্লাহ গালিব তার এক স্ট্যাটাসে বলেন, ‘এয়ারপোর্ট থেকে হোটেলে যাত্রাপথে গাড়িতে মার্টিনেজকে বলেছিলাম, বাংলাদেশের মানুষ তোমাকে বাজপাখি নামে ডাকে। বিশ্বাস করুন, পুরোটা রাস্তা সে নামটা বলছিল এবং মুখস্থ করার চেষ্টা করছিল। আমাদের বাজপাখিকে স্বাগত।’
আইসিটি প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে এক অনুষ্ঠানে আড্ডা দিতে দেখা যায় মার্টিনেজকে। এরপর তাকে বাজপাখির রেপ্লিকা, পাটের তৈরি নৌকা এবং বঙ্গবন্ধুর বই উপহার দেয়া হয়। বাজপাখি নামটি তার খুব পছন্দ হয়েছে বলে জানান আইসিটি প্রতিমন্ত্রী। সমর্থকদের অপেক্ষা ও উপেক্ষা মার্টিনেজের আগমন নিয়ে শুরু থেকেই একটা রাখঢাক রেখে চলছিল পৃষ্ঠপোষক প্রতিষ্ঠান নেক্সট ভেঞ্চার।
আগের রাতে একটা সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে তারা জানিয়ে দেয় একেবারেই ঘরোয়া একটা অনুষ্ঠান। সেখানে মিডিয়া এবং সমর্থকদের প্রবেশ নেই। কিন্তু তারপরও গতকাল সকাল থেকে সবুজ, সেলিম, শান্তর মতো সাধারণ সমর্থকরা আর্জেন্টিনার জার্সি গায়ে জড়িয়ে কেউ মোহাম্মদপুর, কেউ মিরপুর থেকে বাড্ডায় নেক্সট ভেঞ্চারের কার্যালয়ে অপেক্ষা করেন। বৃষ্টি উপেক্ষা করে বেশকিছু মিডিয়াও আসে সেখানে।
কিন্তু আগে থেকে বলে দেয়া বেসরকারি নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা এতটাই সজাগ ছিলেন যে, মার্টিনেজের গাড়ির পিছু নেয়া এক ফটোসাংবাদিককে আহতও হতে হয়েছে। এমনকি ক্যামেরা দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে অফিসের মূল ফটক এড়িয়ে অন্যদিক দিয়ে নেয়া হয়েছে মার্টিনেজকে।
জামালের সঙ্গে দেখা হলো না মার্টিনেজের সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ থেকে গতকাল দুপুরেই দেশে ফিরেছে বাংলাদেশ দল। বিমানবন্দরে নেমে বাংলাদেশ অধিনায়ক জামাল ভুঁইয়া অপেক্ষায় ছিলেন মার্টিনেজের সঙ্গে দেখা করার। সে সময় কলকাতা যাওয়ার জন্য মার্টিনেজও ছিলেন সেখানে। কিন্তু মার্টিনেজের সঙ্গে থাকা কর্মকর্তারা আন্তরিক না হওয়ায় দেখা হয়নি তাঁদের।
বাংলাদেশ জাতীয় দলের টিম অ্যাটেনডেন্ট মোহাম্মদ মহসিন পুরো ঘটনাটি বলেন এভাবে, ‘অনেকে চলে গেলেও জামাল ভাই অপেক্ষা করছিলেন মার্টিনেজের সঙ্গে দেখা করার। কয়েকজনকে বলেও ছিলাম, বাংলাদেশ দল অপেক্ষা করছে। কিন্তু তাঁর সফরসঙ্গীরা আন্তরিক ছিলেন না। তাই দেখা হয়নি তাঁদের।’
ভোরের আকাশ/নি