মৌসুমি ব্যবসায়ী গৌরীপুর উপজেলার নিমাই রবিদাস। ৪০টি চামড়া নিয়ে ময়মনসিংহ অঞ্চলের সবচেয়ে বড় চামড়ার হাট শম্ভুগঞ্জে আসেন তিনি। লবণ লাগিয়ে চামড়াগুলোতে তার খরচ পড়েছে ৮০০ টাকা করে। কিন্তু ৪০টি চামড়ার মধ্যে ৩০টি স্থানীয় পাইকারের কাছে বিক্রি করেছেন ৭০০ টাকা দরে। মঙ্গলবার এই হাটে সর্বোচ্চ ৮০০ টাকা দরে বিক্রি হয়েছে গরুর চামড়া।
এর কারণ হাটে আসেননি টেনারি প্রতিনিধিরা। স্থানীয় পাইকাররা অল্পকিছু চামড়া কিনলেও ব্যবসায়ীদের অধিকাংশই ফেরত গেছেন হতাশ হয়ে। ন্যায্য দাম না পেলে চামড়া পাচার হতে পারে বলে আশঙ্কা হাটের ইজারাদারের। তবে প্রশাসন বলছে, চামড়া পাচার রোধে সীমান্তে নজরদারি রয়েছে।
ব্যবসায়ীরা জানান, ১৯৮৮ সাল থেকে চলে আসছে শম্ভুগঞ্জ চামড়া বাজার। কোরবানির ঈদে দেড় মাসের মতো হাটে চামড়া কেনাবেচা হয়। অন্তত এক লাখ চামড়া এই হাট থেকে বিক্রি হয় কোরবানির ঈদে। প্রতি শনিবার সবচেয়ে বড় বাজার বসলেও মঙ্গলবারও এখানে হাট বসে। কিন্তু মঙ্গলবার দুপুর ১২টা থেকে ২টা পর্যন্ত অবস্থান করেও ক্রেতা পাওয়া যায়নি। বিভিন্ন জেলা-উপজেলা থেকে নিয়ে আসা চামড়া স্থানীয় পাইকারদের কাছে কিছু কিছু বিক্রি করেছেন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা। অনেকে নিজেদের চামড়া স্ত‚প করে পলিথিন দিয়ে ঢেকে রেখে ফেরত গেছেন বাড়িতে।
চামড়া বাজারে দাঁড়িয়ে কথা হয় সুনামগঞ্জের ধর্মপাশার ফজলুল হকের সঙ্গে। তিনি ২৫ বছর ধরে চামড়ার ব্যবসা করেন। গত সোমবার ১ হাজার ২০০ চামড়া নিয়ে শম্ভুগঞ্জের হাটে আসেন। মঙ্গলবার হাট জমবে, বিক্রি হবে চামড়া এমনটি আশা ছিল তার। কিন্তু বেলা ১টা পর্যন্ত ছিল না কোনো টেনারি মালিক ও ঢাকার পাইকার। ওই অবস্থায় চামড়া স্তপ করে কাগজ দিয়ে ঢেকে ফেরত যান তিনি।
ফজলুল হকের ভাষ্য, সাড়ে পাঁচ লাখ টাকার চামড়া কিনেছেন। প্রতিবছর এই হাটে চামড়া বিক্রি করেন তিনি। কিন্তু গতকাল মঙ্গলবার কোনো পাইকার আসেনি। তার কেনা প্রতিটি চামড়ায় লবণ লাগিয়ে খরচ পড়েছে ৭০০ টাকা। গত বছরও অন্তত ৮০ হাজার টাকা লোকসান হয়েছিল তার। এবারো লোকসানের মুখে পড়তে হবে। একই এলাকা থেকে আসা শ্যামল রবি দাস নিয়ে এসেছেন ৮০০ চামড়া। মঙ্গলবার হাটে টেনারি প্রতিনিধি না আসায় চামড়া রেখে বাড়ি চলে গেছেন তিনি।
ঈশ্বরগঞ্জের তারুন্দিয়া ইউনিয়নের সরতাজবহেরা গ্রামের সুনিল রবি দাস ৮০টি চামড়া নিয়ে হাটে আসেন। ৮০০ টাকা দরে ৫০টি চামড়া বিক্রিও করেন। গড়ে ৪০০ থেকে ৬০০ টাকা দরে কেনা চামড়ায় লবণ লাগিয়ে তার খরচ পড়েছে ৮০০ টাকা করে।
তার দাবি, বিক্রি না করে রেখে দিলে নতুন করে লবণ দিতে হবে। ২৪ টাকা কেজির লবণ লাগাতে গেলে খরচ আরো বাড়বে। ভাতিজা রাসেলকে নিয়ে চামড়ায় লবণ লাগাচ্ছিলেন ধোবাউড়া উপজেলা শহরের বাসিন্দা আবদুল কদ্দুস।
তিনি জানান, ১৭টি গাভির চামড়া ৩৫০ টাকা দরে বিক্রি করেছেন। ৪৬টি ষাঁড়ের চামড়ার খরচ পড়েছে ৯০০ টাকা করে। বাজারে দাম বলছে ৮০০ টাকা করে। তাই বিক্রি না করে লবণ লাগিয়ে রেখে যাচ্ছেন। আগামী শনিবার টেনারির লোকজন এলে বেশি দাম পাবেন বলে আশা তার।
ফুলবাড়িয়া উপজেলার দেবগ্রাম গ্রামের নিবাস ঋষি ও জীবন ঋষি দুই ভাই। ১৯০টি চামড়া নিয়ে দুই ভাই গত সোমবার এসেছেন হাটে। মঙ্গলবার বাজার জমবে এমন আশায় সকাল থেকে বসে থাকেন। কিন্তু তাদের চামড়ার দাম বলার মতো কোনো পাইকার ছিল না।
নিবাস ঋষি বলেন, লবণ লাগিয়ে প্রতিটি চামড়ার খরচ পড়েছে ৮০০ টাকা। কিন্তু বাজারের অবস্থা ভালো বোঝা যাচ্ছে না। ভালুকার ওয়ায়েজ উদ্দিন এবারই প্রথম চামড়া কিনেছেন। লবণ লাগিয়ে তার চামড়ায় খরচ পড়েছে এক হাজার টাকার বেশি। মঙ্গলবার বাজার পরিস্থিতি বুঝতে শম্ভুগঞ্জ হাটে আসেন। কিন্তু হাটের পরিস্থিতি দেখে হতাশ তিনি। তার দাবি, একটি মাদ্রাসা থেকে চামড়াগুলো কিনেছেন। মাদ্রাসাকে ভালো মূল্য দিতে গিয়ে নিজে ক্ষতির মুখে এখন।
ঈশ্বরগঞ্জের ব্যবসায়ী আবদুল কাইয়ুম মঙ্গলবার ভোরে ১০০ চামড়া নিয়ে আসেন হাটে। তিনি ১ হাজার ৫০০ চামড়া কিনেছেন এবার। লবণ ও শ্রমিকসহ তার চামড়ায় খরচ পড়েছে ৯০০ টাকা করে। কিন্তু হাটে কোনো ক্রেতা না থাকায় চামড়া ঢেকে রেখে বাড়ি চলে যাচ্ছেন কাইয়ুম। একই অবস্থা অন্য ব্যবসায়ীদেরও। শম্ভুগঞ্জ চামড়া বাজারের আড়তদার আবদুর রেজ্জাক।
এবার ১ হাজার ৭০০টি চামড়া কিনেছেন তিনি। তার ভাষ্য, বর্তমান সময়ের মতো বাজারের খারাপ পরিস্থিতি কখনো ছিল না। টেনারি স্থানান্তর প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার পর থেকেই চামড়ার দাম কমে গেছে। অনেক টেনারি এখনো চালু হয়নি।
শম্ভুগঞ্জ চামড়া বাজারের ইজারাদার আসাদুজ্জামান সোহেল জানান, হাটের অবস্থা নাজুক। টানা বৃষ্টিতে চামড়া রাখার জায়গা পর্যন্ত নেই। আগামী শনিবার টেনারির প্রতিনিধিরা আসবেন। সেদিন বাজারটিতে বেচাকেনা বেশি হতে পারে। তার দাবি, অনেক সময় সিন্ডিকেট করেন টেনারি মালিকরা। বর্তমানে বাজারের যে অবস্থা এবং সঠিক দাম না পাওয়ার কারণে চামড়া ভারতে পাচার হতে পারে।
ভোরের আকাশ/নি