logo
আপডেট : ৮ জুলাই, ২০২৩ ১২:০৪
বাজার নিয়ন্ত্রণ আইন কতটা কৃষকবান্ধব?
ড. রাহমান নাসির উদ্দিন

বাজার নিয়ন্ত্রণ আইন কতটা কৃষকবান্ধব?

দুদিন পর পর কোনো না কোনো ভোগ্যপণ্য সংবাদপত্রের শিরোনাম হয়ে উঠে বাজারে হঠাৎ করে অস্বাভাবিক দাম বৃদ্ধির কারণে। একবার চিনির দাম বাড়ে তো আরেকবার পেঁয়াজের দাম বাড়ে! একবার ডিমের দাম বাড়ে তো আরেকবার কাঁচামরিচের দাম বাড়ে।

 

সম্প্রতি কাঁচামরিচের বাজারমূল্য উঠেছিল ৮০০-১০০০ টাকা কেজি। ভাবা যায়?

 

বাজার-সংশ্লিষ্ট সবার কথায় একটা বিষয় পরিষ্কার হয়, সেটা হচ্ছে বাজারকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য একটা শক্তিশালী অশুভ সিন্ডিকেট ইতোমধ্যে গড়ে উঠেছে এবং ক্ষেত্রবিশেষ সরকার ও প্রশাসনের সব নিয়ন্ত্রণমূলক প্রক্রিয়া ও পদ্ধতির চেয়েও তারা এতটা শক্তিশালী হয়ে ওঠে যে, খোদ সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রীকেও খানিকটা অসহায় বক্তব্য দিতে দেখা যায়।

 

এসব শক্তিশালী বাজার-সিন্ডিকেটকে নিয়ন্ত্রণের জন্য গত ৫ জুলাই জাতীয় সংসদে ‘খাদ্যদ্রব্য উৎপাদন, মজুত, স্থানান্তর, পরিবহন, সরবরাহ, বিতরণ ও বিপণন (ক্ষতিকর কার্যক্রম প্রতিরোধ) বিল, ২০২৩’ শিরোনামে একটি বিল উত্থাপন করা হয় এবং সেটা কণ্ঠভোটে পাস হয়। খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার এ বিল সংসদে উত্থাপন করেন। সরকারের নির্ধারণ করে দেয়া পরিমাণের চেয়ে বেশি খাদ্যদ্রব্য মজুত করলে যাবজ্জীবন বা সর্বোচ্চ ১৪ বছর সশ্রম কারাদন্ডের (অর্থদন্ডসহ) বিধান রেখে এ বিল পাস করা হয়। এবং এ অপরাধে কাউকে গ্রেপ্তার করা হলে তার জামিন হবে না।

 

কেননা এ বিলে অতিরিক্ত সময় পণ্যদ্রব্য মজুত করাকে জামিন অযোগ্য অপরাধ হিসেবে বিবেচনায় রাখা হয়েছে। এ বিল সংসদে আনার আগে এ বিলের ওপর বিরোধী সদস্যদের দেয়া আপত্তি ও আলোচনা জনমত যাচাই-বাছাই কমিটিতে পাঠানো হয় এবং সংশোধনী প্রস্তাবগুলো নিষ্পত্তি করা হয়। এ বিল পাস হওয়ার মধ্য দিয়ে ১৯৬৫ সালের ফুড (স্পেশাল কোর্ট) অ্যাক্ট এবং ১৯৭৯ সালের ফুডগ্রেইনস সাপ্লাই (প্রিভেনশন অব প্রিজুডিশিয়াল অ্যাকটিভিটি) অর্ডিন্যান্স বাতিল করা হলো।

 

বাজার-সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণে সরকারের শক্ত অবস্থানকে আমরা স্বাগত জানাই। আমি মনে করি, উৎপাদন, বণ্টন এবং বিপণন ব্যবস্থার মধ্যে একটা শক্তিশালী মধ্যস্বত্বভোগী অত্যন্ত চাতুর্যতার সঙ্গে পুরো বাজার ব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করে। ফলে একদিকে উৎপাদনকারী কৃষকরা যেমন তাদের উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য পায় না, অন্যদিকে অতিরিক্ত দাম দিয়ে পণ্য ক্রয় করতে হয় বলে ভোক্তারাও হয়ে ওঠেন সবচেয়ে বড় ভুক্তভোগী।

 

এ রকম একটি পরিস্থিতিতে সরকারের একটা নৈতিক এবং সাংবিধানিক দায়িত্ব হয়ে দাঁড়ায় এসব অসাধু মধ্যস্বত্বভোগী বাজার-সিন্ডিকেটকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য একটা শক্ত আইনি ভিত্তি তৈরি করা। এ আইন মূলত তারই একটি প্রচেষ্টা। ফলে আমরা সরকারের এ প্রচেষ্টাকে মোবারকবাদ জানাই। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, আইনের চেয়ে আইনের যথাযথ প্রয়োগ অধিকতর বেশি জরুরি।

 

এ আইন উল্টো কৃষকদের নতুন করে আরেকটা দুষ্টচক্রের হাতে বন্দি করে ফেলবে না তো? যেহেতু এ আইনে অতিরিক্ত পরিমাণ সময়ে মজুত রাখাকে জামিন অযোগ্য অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে, সেহেতু সুযোগসন্ধানীরা এবং আইনের অপব্যবহারকারীরা আবার এ আইনের অপপ্রয়োগ করে সাধারণ ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীদের এবং প্রান্তিক কৃষকদের নতুন করে জিম্মি করে ফেলবে না তো? এসব প্রশ্ন গুরুতর বিবেচনার দাবি রাখে।

 

গত বেশ কয়েকটা দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির ঘটনা প্রায় একই তরিকায় ঘটেছে। মজুতদাররা বাজারের চাহিদা অনুযায়ী জোগান না দিয়ে গুদামে দ্রব্য মজুত করে রাখে। ফলে বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি হয়। আর চাহিদা-জোগানের বিপ্রতীপ তত্ত¡ অনুযায়ী চাহিদার তুলনায় জোগান কম হলে দ্রব্যমূল্যের দাম বৃদ্ধি পায়। কাজেই বাজারে বিশেষ একটি পণ্যের দাম ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পেয়ে মানুষের ক্রয়ক্ষমতার নাগালের বাইরে চলে যায়।

 

বাজারের চড়া দাম ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই মজুতদাররা গুদামে মজুত করে রাখা দ্রব্য বাজারে ছেড়ে দিয়ে কোটি কোটি টাকা বাগিয়ে নেয়। এ চক্র একই তত্ত্ব প্রয়োগ করছে বছরের পর বছর ধরে। কিন্তু কেউ এ বাজার সিন্ডিকেট ভাঙতে পারছে না। যখন সরকারের পক্ষ থেকে অভিযান চালানো হয়, তখন দেখা যায় আমাদের পণ্যের কোনো ঘাটতি নেই। কৃত্রিমভাবে এ সংকট সৃষ্টি করে অসাধু ব্যবসায়ীরা অতিরিক্ত মুনাফা পকেটস্থ করে।

 

প্রশ্ন আসে, বাজারে যখন পণ্যের ঘাটতি দেখা দেয় সরকার তখন পণ্য আমদানির ব্যবস্থা কেন করে না? সরকার তখনই পণ্য আমদানির উদ্যোগ নেয় যখন বিশেষ একটি পণ্য চড়া মূল্যে বিক্রি করে অসাধু ব্যবসায়ীরা বাজার থেকে বিরাট অঙ্কের মুনাফা তুলে নেয়। সরকার পণ্য আমদানি করলে মজুতদাররাও তাদের মজুত করা পণ্য বাজারে চালান দেয়। ফলে দ্রব্যমূল্য স্থিতিশীল হয়।

 

কিন্তু ততক্ষণে সাধারণ ভোক্তার পকেট থেকে শত শত কোটি টাকা অসাধু ব্যবসায়ীদের পকেটে চলে যায়। এখানে অনেকে সরকারকে অপরাধীর কাঠগড়ায় দাঁড় করায় এ অভিযোগ তুলে যে, ‘কেন পণ্য আমদানি আগে থেকে করা হয় না’। এখানে মনে রাখা জরুরি যে, পণ্যের পর্যাপ্ত উৎপাদন হওয়ার পরও যদি সরকার বিদেশ থেকে পণ্য আমদানি করে, তাহলে বাজারে পণ্যের দাম কমে যায়। সে ক্ষেত্রে কৃষকরা পণ্যের ন্যায্য দাম পায় না এবং অনেক ক্ষেত্রে তাদের উৎপাদন খরচও ওঠে না।

 

তাই কৃষকরা যাতে বাজারে তাদের পণ্যের ন্যায্যমূল্য পায়, সেদিকটাও সরকারকে খেয়াল রাখতে হয়। কিন্তু এই দুইয়ের মধ্যে কীভাবে একটা চমৎকার সমতা ও সামঞ্জস্য রক্ষা করে বাজার নিয়ন্ত্রণ করা যায় সেটাই আদতে বড় চ্যালেঞ্জ। সরকার দীর্ঘদিন ধরে এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার চেষ্টা করছে, কিন্তু সব সময় সফল হয়েছে এ দাবি করা যাবে না। কেননা মাঝে মাঝে মনে হয়েছে বাজার-সিন্ডিকেট কোনো কোনোভাবে সরকারের চেয়েও শক্তিশালী।

 

তাই এ সমস্যার একটা স্থায়ী সমাধান জরুরি ছিল। আমরা ধরে নিতে পারি যে, সে জায়গা থেকেই পুরো প্রক্রিয়াটাকে একটা শক্ত আইনের আওতায় নিয়ে আসার চিন্তায় ‘খাদ্যদ্রব্য উৎপাদন, মজুত, স্থানান্তর, পরিবহন, সরবরাহ, বিতরণ ও বিপণন (ক্ষতিকর কার্যক্রম প্রতিরোধ) বিল, ২০২৩’ আইন পাস করা হয়। তবে এ আইনের যাতে অপপ্রয়োগ না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। কৃষক যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সেদিকে নজর দিতে হবে।

 

কৃষকরা যাতে হয়রানির শিকার না হয় সেদিকে সচেতন দৃষ্টি রাখতে হবে। বাংলাদেশে নানাভাবে সাজানো মামলা দেয়ার অসংখ্য নজির আছে। কৃষকরা দুই পয়সা বেশি লাভ করার আশায় অনেক সময় উৎপাদিত পণ্য দুদিন পরে বাজারে সরবরাহ করে। কৃষকের এ স্বাভাবিক উৎপাদন ও বিপণন প্রক্রিয়াকে ভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করে জামিন-অযোগ্য মামলা দিয়ে যাতে যাবজ্জীবন বা ১৪ বছরের জেল দিয়ে একটা মানুষের পুরো জীবনটা বা পুরো একটা পরিবারকে ধ্বংস করে দেয়া না হয়, সেটা নিশ্চিত করতে হবে।

 

মনে রাখতে হবে যে, সব ভালোর কিছু খারাপ দিক আছে। তাই এ কথা স্বীকার্য যে, ‘খাদ্যদ্রব্য উৎপাদন, মজুত, স্থানান্তর, পরিবহন, সরবরাহ, বিতরণ ও বিপণন (ক্ষতিকর কার্যক্রম প্রতিরোধ বিল), ২০২৩’ একটি অত্যন্ত শক্ত আইন, যেখানে অসাধু ব্যবসায়ী এবং অবৈধ মজুতদারদের জন্য শক্ত শাস্তির ব্যবস্থা আছে। কিন্তু এর ভেতর কৃষকদেরও ঝুঁকির মধ্যে পড়ার সম্ভাবনা নিহিত আছে।

 

এ বিলের নানা সমালোচনার উত্তর দিতে গিয়ে খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার সংসদে বলেন, ‘বর্তমান সরকার কৃষকবান্ধব। কৃষকদের নানা প্রণোদনা এই সরকার দিয়ে যাচ্ছে। প্রকৃত মজুতদারদের চিহ্নিত করা সহজ বিষয়। কৃষকদের ওপরে এই আইন প্রয়োগের কোনো আশঙ্কা নেই।’

 

আমরা খাদ্যমন্ত্রীর কথায় আশ্বাস রাখতে চাই। কথা এবং কাজের মধ্যে একটা চমৎকার মিল দেখতে চাই। কেননা এ কৃষকরাই নিয়মিতভাবে আমাদের খাদ্যের জোগান দেয়। কৃষকদের পাশেই আমাদের সবাইকে দাঁড়াতে হবে। আপনাকে, আমাকে, সমাজকে, সরকারকে এবং রাষ্ট্রকে।

 

লেখক : নৃবিজ্ঞানী ও অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

 

ভোরের আকাশ/নি