logo
আপডেট : ৮ জুলাই, ২০২৩ ১৪:৪৭
বরিশালের গুঠিয়া সন্দেশ যাচ্ছে বিদেশে
বরিশাল ব্যুরো

বরিশালের গুঠিয়া সন্দেশ যাচ্ছে বিদেশে

বরিশালের গুঠিয়া সন্দেশ

শত বছরের ঐতিহ্যবাহী দুধ, চিনি ও কিসমিসে তৈরি অত্যন্ত সুস্বাদু শত প্রতিক‚লতার মাঝেও ঐতিহ্যের ধারা অক্ষুণ্ণ রেখে টিকে আছে বরিশালের গুঠিয়ার সন্দেশ। দক্ষিণাঞ্চলজুড়ে এখনো নানা স্বাদ ও বৈচিত্র্যের খাটি মিষ্টির সমারোহ ভোজনরসিকদের রসনা তৃপ্ত করলেও উজিরপুর গুঠিয়ার সন্দেশের স্বাদ এখনো সবার জিহবায় লেগে থাকে।

 

ঐতিহ্য ধরে রেখে গুঠিয়ার সন্দেশের নাম ছড়িয়ে আছে দেশের বিভিন্ন এলাকার মানুষের কাছে। ২০০৫ সালে গুঠিয়ায় দৃষ্টিনন্দন ‘বায়তুল আমান জামে মসজিদ’ গড়ে তোলার পরে সেখানে দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে মুসল্লিয়ানসহ পর্যটকদের আগমন বৃদ্ধির সাথে গুঠিয়ার সন্দেশের কদরও বাড়তে থাকে। দিন দিন এর আরো খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছে দেশ ছাড়িয়ে বিদেশেও।

 

সম্প্রতি চিনি ও দুধসহ কারিগরদের মজুরি বৃদ্ধির ফলে সন্দেশের দাম বেড়ে যাওয়ায় সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে যাচ্ছে গুঠিয়ার সন্দেশও। সড়কপথে বানারীপাড়া যাবার পথে দারোগার হাট ও গুঠিয়া বাজার। বরিশাল মহানগরী থেকে প্রায় ১৮ কিলোমিটার পশ্চিম-উত্তরে বাবুগঞ্জ ও বানারীপাড়া উপজেলার সীমান্তবর্তী উজিরপুর উপজেলার গুঠিয়া বাজারের মিষ্টির দোকানগুলোতে দীর্ঘদিন ধরে এসব সন্দেশ তৈরি ও বিক্রি হচ্ছে।

 

ব্রিটিশ আমলে মিষ্টির কারিগর সতীশ ঘোষ প্রথম এ সন্দেশ তৈরির সূচনা করেন। বংশ পরম্পরায় সে ঐতিহ্য এখনো বহমান। দারোগার হাট ও গুঠিয়া বাজারে আরো অন্তত ১০টি মিষ্টির দোকানে বর্তমানে এ সন্দেশ তৈরি ও বিক্রি হয়।

 

বেশ কয়েকজন বয়োজ্যেষ্ঠ জানান, বাবুগঞ্জের মাধবপাশায় জমিদার বংশের পত্তন ও প্রাচীন জনপদ চন্দ্রদ্বীপের রাজধানী হয়ে ওঠার সাথে এই সন্দেশের ঐতিহ্য ও সমৃদ্ধির সম্পর্ক রয়েছে। তবে সে ইতিহাস সঠিকভাবে কোথাও লিপিবদ্ধ নেই। অন্য সন্দেশ সাধারণত নরম হলেও গুঠিয়ার সন্দেশ কড়াপাকের হওয়ায় কিছুটা শক্ত ও শুষ্ক। সুস্বাদু এই সন্দেশ এক পলার।

 

দুধ, চিনি ও কিসমিস দিয়ে তৈরি এ সন্দেশ এতটাই মুখরোচক যে এ সন্দেশ একবার খেলে তা সবার মনে থাকে অনেক দিন। এমনকি এখন দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে প্রতিদিন বিপুলসংখ্যক মানুষ বরিশালে ভাসমান পেয়ারার বাজার, দুর্গাসাগর দিঘি, বানরীপাড়ার ভাসমান ধান-চালের হাট ও গুঠিয়া মসজিদ দেখতে এসে ভোজন তালিকায় গুঠিয়ার সন্দেশকেই রাখছেন। খাটি দুধের ছানা গুঠিয়ার সন্দেশের মূল উপকরণ।

 

এসব ছানা তৈরির পর বড় লোহার কড়াইতে পাকে বা জাল দেয়া হয়। কাঁচা ছানার সাথে সামান্য কিছু ময়দাও মিশিয়ে পাকের পর তা মিহি করা হয়। পাক কম-বেশির ওপরেই এ সন্দেশের স্বাদ ও গুণগত মান নির্ভর করে। পাকের পর তা চুলা থেকে নামিয়ে ছোট ছোট গোলা করে হাত দিয়ে জোড়ে পরিচ্ছন্ন কাপড়ের ওপর ছুঁড়ে ফেলে চ্যাপ্টা করা হয়। এরপর তার ওপরে মাঝখানে একটি পরিষ্কার কিচমিচ দানা বসিয়ে দেয়া হয়।

 

এতে সন্দেশের সৌন্দর্য ও স্বাদ আরো বাড়ে। গুঠিয়ার সন্দেশের রং সাদা। স্বাদে অনন্য এ সন্দেশে গরুর দুধের টাটকা গন্ধ ভোজন রসিকদের রসনাকে তৃপ্ত করে। এখানকার বেশ কয়েকজন কারিগর প্রায় শত বছরের ঐতিহ্যের ও বিখ্যাত এ সন্দেশের সুনাম ধরে রাখছেন। ৬০ বছর বয়সী নিকুঞ্জ মিস্ত্রি তাদেরই একজন। বিখ্যাত এই সন্দেশের প্রস্তুত প্রণালি শিখিয়েছেন ছেলেকেও।

 

নিকুঞ্জ মিস্ত্রি জানান, সাধারণত ৬-৭ কেজি দুধে ১ কেজি ছানা পাওয়া যায়। সেই ছানার সঙ্গে পরিমাণ মতো চিনি মিশিয়ে অল্প জাল দিতে হয়। ২০ থেকে ৩০ মিনিট পর পাকিয়ে অল্প আঁচে ৫ মিনিট রাখলেই সন্দেশের কাঁচামাল তৈরি। এরপরে কাঠের ওপরে পরিষ্কার কাপড় বিছিয়ে সন্দেশের আকার দেয়া হয়। তবে সন্দেশ তৈরির প্রধান বিষয় হচ্ছে খাঁটি দুধ। এর সাথে পরিমাণ মতো আঁচ ও পাক অন্যতম অনুষঙ্গ।

 

গুঠিয়া বাজারের ৮-৯ জন এখনো এই সন্দেশের ঐতিহ্য আঁকড়ে আছেন। কারিগরদের মজুরি বৃদ্ধির সাথে দুধ, চিনি আর কিসমিসের অগ্নিমূল্যের পরেও গুঠিয়া সন্দেশের কেজি সাড়ে ৬০০ থেকে ৭০০ টাকা। কেজিতে ২০ থেকে ২৫টির মতো সন্দেশ থাকে।

 

তিনি জানান, শীতকালে এবং বৈশাখে সন্দেশের চাহিদা বাড়ে। তবে সব উপকরণসহ শ্রমিকদের মজুরি বেড়ে যাওয়ায় এখন সন্দেশ তৈরি করে খুব বেশি লাভ হচ্ছে না। তবুও ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখতে মানের সঙ্গে আপস করেন না বলেও জানান নিকুঞ্জ মিস্ত্রী।

 

গুঠিয়া ইউপি চেয়ারম্যান আওরঙ্গজেব হাওলাদার বলেন, প্রায় শত বছর ধরে গুঠিয়ার সন্দেশ দেশের গন্ডি পেরিয়ে বিভিন্ন দেশে যাচ্ছে। দ্রব্যমূল্য বেড়ে যাওয়ায় সন্দেশের দামও বেড়েছে, সে কারণে অনেকের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে চলে যাচ্ছে এ সন্দেশ। ফলে চাহিদা কমায় সন্দেশ তৈরির কাজে নিয়োজিতরা এখন প্রতিনিয়ত পেশায় টিকে থাকার লড়াইয়ে রয়েছেন।

 

ভোরের আকাশ/নি