জনসংখ্যা কখনোই সমস্যা নয়, এটি হলো সম্পদ। কেননা জনসংখ্যাই হতে পারে জনসম্পদ। মূলধন ও প্রাকৃতিক সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার নির্ভর করে দক্ষ জনসম্পদের ওপর। তাই দক্ষ জনসম্পদ অর্থনৈতিক উন্নয়নের অন্যতম প্রধান ও অপরিহার্য শর্ত। অতিরিক্ত জনসংখ্যার দক্ষতা বাড়াতে গেলে অনেক সময় সম্পদেরও প্রয়োজন হয়। কিন্তু জনসংখ্যা কম হলে সীমিত সম্পদ দিয়েও তাদের দক্ষ করে তোলা সম্ভব হয়।
একটি দেশের মূল অবকাঠামো হচ্ছে জনসংখ্যা। যদিও বর্তমান বিশ্বে অধিকাংশ দেশে জনসংখ্যা বেড়ে যাওয়া এক ধরনের আতঙ্কের খবর। বলা হয়, একুশ শতাব্দীতে জনসংখ্যা বিস্ফোরণ সবচেয়ে সংকটজনক অবস্থার জন্ম দিতে চলেছে। জনসংখ্যা-সংক্রান্ত বিভিন্ন প্রশ্নে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করার লক্ষ্যে প্রতি বছর ১১ জুলাই ‘বিশ্ব জনসংখ্যা দিবস’ হিসেবে পালন করা হয়। এবারের প্রতিপাদ্য বিষয় ‘অধিকার ও পছন্দই মূল কথা : প্রজনন স্বাস্থ্য ও অধিকার প্রাধান্য পেলে কাক্সিক্ষত জন্মহারে সমাধান মেলে।’
১৯৯০ সালের ১১ জুলাই প্রথমবারের মতো ৯০টি দেশে বিশ্ব জনসংখ্যা দিবস উদযাপিত হয়। এরই ধারবাহিকতায় নানা আয়োজনের মধ্য দিয়ে প্রতি বছর বাংলাদেশও বিশ্ব জনসংখ্যা দিবস পালন করে আসছে।
বাংলাদেশের জনসংখ্যা বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৭৪ লাখ। এর মধ্যে পুরুষ ৮ কোটি ৩৮ লাখ এবং নারী ৮ কোটি ৩৬ লাখ। দেশের মানুষের প্রত্যাশিত আয়ুষ্কাল বেড়ে হয়েছে ৭২ দশমিক ৬ বছর। বিশ্বের ৮ম বৃহত্তম জনসংখ্যার দেশ বাংলাদেশ। এখানে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার শতকরা ১.৩৩ ভাগ। বাংলাদেশে পুরুষ ও নারীর অনুপাত ১০০.২:১০০। তবে বর্তমানে বাংলাদেশে বর্তমান জনসংখ্যার দুই-তৃতীয়াংশ কর্মক্ষম। আর দেশের জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ তরুণ প্রজন্ম।
দেশের ক্রমবর্ধমান নিরবচ্ছিন্ন জনসংখ্যার জন্য কঠোর আইন তৈরি করা, সব রাজনৈতিক দলকে বর্ণ, ধর্ম এবং সম্প্রদায় থেকে ঊর্ধ্বে উঠতে এবং জাতীয় স্বার্থে একটি কঠোর জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ আইন কার্যকর করতে হবে। বিশ্ব জনসংখ্যা আজ সাড়ে সাত বিলিয়ন অতিক্রম করেছে, কিন্তু ১৯৮৭ সালের ১১ জুলাই বিশ্ব জনসংখ্যা ৫০০ কোটি ছাড়িয়ে গেলে সারা বিশ্বের জনমানুষের মধ্যে যে আগ্রহের সৃষ্টি হয়, তাতে অনুপ্রাণিত হয়ে ১৯৮৯ সালে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির পরিচালনা পরিষদ এই দিবসটি প্রতিষ্ঠা করে। বিশ্ব জনসংখ্যা দিবসের লক্ষ্য হলো পরিবার পরিকল্পনা, লৈঙ্গিক-সমতা, দারিদ্র্য, মাতৃস্বাস্থ্য এবং মানবাধিকারের মতো জনসংখ্যা-সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয়ে জনগণের সচেতনতা বৃদ্ধি করা।
২০১৯ সালের মাঝামাঝি বিশ্বের জনসংখ্যা ৭৭০ কোটিতে পৌঁছে। এটি ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পেয়ে ২০৩০ সালে ৮৫০ কোটি, ২০৫০ সালে ৯৭০ কোটি এবং এবং ২১০০ সালে গিয়ে ১০৯০ কোটিতে পৌঁছাতে পারে বলে জাতিসংঘ অনুমান করছে। ২০৫০ সালের মধ্যে যে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাবে, তার অর্ধেকের বেশি সংঘটিত হবে ৯টি দেশে; এগুলো হলো ভারত, নাইজেরিয়া, পাকিস্তান, কঙ্গো গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র, ইথিওপিয়া, তানজানিয়া, ইন্দোনেশিয়া, মিশর এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ২০২৭ সাল নাগাদ ভারত চীনকে ছাড়িয়ে বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল রাষ্ট্রে পরিণত হবে।
জনসংখ্যা একটি দেশের জন্য আশীর্বাদ ও অভিশাপ দুটোই হতে পারে। যখনই দেশের সম্পদ দেশের জনগণের তুলনায় অপ্রতুল হয়ে যায়, তখনই দেশে জনসংখ্যার বিস্ফোরণ হয় এবং এই বিস্ফোরণ নিয়ন্ত্রণ করা অতীব জরুরি হয়ে পড়ে। জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে শিক্ষার্থীরাও ব্যাপক ভ‚মিকা পালন করতে পারে। জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে শিক্ষার্থীদের ভ‚মিকা রাখতে হলে প্রথমে তাদের জনসংখ্যা বিস্ফোরণের কারণ জানতে হবে।
প্রথমত, সমাজে বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ, ছেলে সন্তানের লোভে অধিক সন্তানের জন্ম দেয়ার মতো কুসংস্কার রয়েছে, যা জনসংখ্যা বৃদ্ধির জন্য দায়ী। এ ছাড়াও কুসংস্কারের বিভিন্ন বেড়াজাল যে সমাজে ছড়িয়ে পড়ছে, তার অন্যতম কারণ অশিক্ষা বা কার্যকরী শিক্ষার অভাব। যখন দেশের মানুষের গড় আয়ু কম হয় এবং শিশু মৃত্যুর হার বেশি হয়, তখনো দেশের জনগণ অধিক সন্তানের প্রতি আগ্রহী হয়। দারিদ্র্যের হার বেশি আর নারীর মতামতের প্রাধান্য না থাকাও জনসংখ্যা বিস্ফোরণে উদ্দীপক হিসেবে কাজ করে।
এক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ভূমিকা রাখতে পারে। শিক্ষার্থীরা বাল্যবিবাহ ও বহুবিবাহের কুপ্রভাব সম্পর্কে বিভিন্ন পোস্টার ছাপতে পারে। বিভিন্ন সমাবেশের আয়োজন করতে পারে। যেখানে পরিবারের সদস্যদের তারা বোঝাবে সন্তান ছেলে হোক আর মেয়ে হোক পরিবারের ভার বহনে উভয়েই সক্ষম। দারিদ্র্য কমানোর জন্য বেশি সন্তানের জন্ম নয় বরং পরিবারের নারী সদস্যদের শিক্ষিত ও কর্মক্ষম হওয়া জরুরি এটাও শিক্ষার্থীরা সমাজের মানুষকে বোঝাতে পারে।
জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি সম্পর্কে সচেতন হওয়ার জন্য চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে উৎসাহিত করতে পারে। বিভিন্ন ধর্মীয় নেতাদের সচেতনতা সৃষ্টিতে এগিয়ে আসার জন্য উদ্বুদ্ধ করতে পারে। শিশু মৃত্যুহার হ্রাসে গর্ভবতী ও প্রসূতি মায়েদের ‘মা ও শিশুর স্বাস্থ্য পরিচর্যা’, ‘মা ও শিশুর পুষ্টি’ প্রভৃতি সম্পর্কে অবহিত করাতে পারে শিক্ষার্থীরা। এ কাজগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার সদস্য হিসেবে অথবা স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে ভ‚মিকা রাখতে পারে।
ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা বৃদ্ধি আজ সমগ্র বিশ্বের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি। পৃথিবীর জনসংখ্যা বৃদ্ধির এই প্রবণতা খুব বেশি পুরোনো নয়। মূলত কৃষি বিপ্লবই জনসংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধিতে ভ‚মিকা রেখেছে। এর আগ পর্যন্ত খাদ্যাভাব পরোক্ষভাবে জনসংখ্যাকে নিয়ন্ত্রণ করেছে। অতিরিক্ত জনসংখ্যার মূলে রয়েছে বাল্যবিয়ে। বাংলাদেশে আয়তনের চেয়ে জনসংখ্যার আধিক্য রয়েছে। অতিরিক্ত জনসংখ্যা একটি রাষ্ট্রের জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়ায়। একটি দেশে জনসংখ্যা কী পরিমাণ হওয়া উচিত তার কোনো নির্দিষ্ট সংখ্যা নেই। তবে একটি দেশের আয়তন এবং সম্পদের ওপর নির্ভর করে সে দেশের জনসংখ্যা কত হলে একটি আদর্শ রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব।
একটি দেশে জনসংখ্যার ওপর সে দেশের শিক্ষা, অর্থনীতি, উন্নয়ন, জীবনযাত্রার মান, সামাজিক অবক্ষয়সহ বিভিন্ন দিক জড়িত থাকে। উন্নত দেশে জনসংখ্যা কম হওয়ায় মাথাপিছু আয়ও বেশি। সরকারের নারী শিক্ষা উন্নয়নে গৃহীত পদক্ষেপগুলো বাস্তবায়নে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। তা ছাড়া বাল্যবিয়ে রোধে আইনের সঠিক প্রয়োগ আরো নিশ্চিত করতে হবে। সর্বোপরি জনগণকে সচেতন করতে জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও বাল্যবিবাহের কুফল জনগণের সামনে তুলে ধরতে হবে। কেননা বাল্যবিবাহ রোধ করতে পারলে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ অনেকটা সহজ হবে। তবে জনসংখ্যা কখনই সমস্যা নয়, এটি হলো সম্পদ। কেননা জনসংখ্যাই হতে পারে জনসম্পদ।
মূলধন ও প্রাকৃতিক সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার নির্ভর করে দক্ষ জনসম্পদের ওপর। তাই দক্ষ জনসম্পদ অর্থনৈতিক উন্নয়নের অন্যতম প্রধান ও অপরিহার্য শর্ত। অতিরিক্ত জনসংখ্যার দক্ষতা বাড়াতে গেলে অনেক সময় সম্পদেরও প্রয়োজন হয়। কিন্তু জনসংখ্যা কম হলে সীমিত সম্পদ দিয়েও তাদের দক্ষ করে তোলা সম্ভব হয়। বর্তমান জনসংখ্যা সমস্যা সমাধান করার জন্য প্রয়োজন শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা। আর তা করতে পারলে এই জনসংখ্যা জনসম্পদে পরিণত হবে।
উপযুক্ত বাসস্থান, পরিবেশ ও মানসম্মত জীবনযাপন, সুষম ও পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণ ইত্যাদি বিষয় সুস্বাস্থ্যের মূল উপাদান। এগুলো নিশ্চিত করার মাধ্যমে অতিরিক্ত জনসংখ্যাকে সম্পদে রূপান্তর করা যায়। বাংলাদেশের জনসংখ্যাকে দক্ষ জনশক্তি হিসেবে গড়ে তুলতে হলে প্রয়োজন সুষ্ঠু পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন।
কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিত করে দেশকে বেকারত্ব হ্রাস করে তুলতে হবে। মানবসম্পদ উন্নয়নের মূল উপাদান হচ্ছে শিক্ষা। শিক্ষা ব্যবস্থার ব্যাপক উন্নয়নের মাধ্যমে জনসম্পদকে দক্ষ করে তোলা যায়। তাই শিক্ষা ব্যবস্থাকে যুগোপযোগী করে জনসম্পদকে আরো সমৃদ্ধ করার প্রতি সরকারকে দৃষ্টি দিতে হবে। কর্মমুখী শিক্ষা ব্যবস্থার জন্য কারিগরি শিক্ষার প্রসার প্রয়োজন।
এ ছাড়াও প্রবীণ জনগোষ্ঠীর অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। ইদানীং বিশ্বব্যাপী প্রবীণ জনসংখ্যা বৃদ্ধির বিষয়টি উদ্বেগের বিষয় হিসেবে দেখা দিয়েছে, যা বর্তমানে সমন্বিত সামাজিক নিরাপত্তামূলক কর্মসূচির একটি মুখ্য বিষয় হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। মানুষের গড় আয়ু বৃদ্ধির কারণে ক্রমান্বয়ে প্রবীণ জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
২০১৩-এর তথ্যানুযায়ী দেখা যায়, ২০১১ সালে আমাদের দেশে প্রবীণের সংখ্যা ছিল মাত্র ১১ দশমিক ৩ মিলিয়ন, যা বর্তমানে প্রতি বছর শতকরা ৪ দশমিক ৪১ ভাগ হারে বাড়ছে। বর্তমানে মোট জনসংখ্যার ৭-৯ শতাংশ প্রবীণ হিসেবে গণনা করা হচ্ছে। এ কারণে প্রবীণ জনগোষ্ঠীকে সুস্থ ও কর্মক্ষম রাখাসহ সামাজিক অধিকার নিশ্চিতকরণে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশের প্রবীণদের জন্য সরকারের উদ্যোগগুলো যেকোনো উন্নয়নশীল দেশের জন্য অনুকরণীয় হতে পারে। সরকারের উদ্যোগের বাইরেও অনেক বেসরকারি প্রতিষ্ঠান প্রবীণদের জন্য বিশেষ কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা জরুরি।
প্রতি বর্গকিলোমিটার জায়গায় ১ হাজার ১২৫ জন মানুষের বসবাসের ফলে প্রাকৃতিক পরিবেশ থেকে শুরু করে সামাজিক-অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক জীবনের সব ক্ষেত্রে নানামুখী সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে এবং সেসব সমস্যা দিনে দিনে বেড়ে চলেছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে এসব সমস্যা আরও তীব্র রূপ ধারণ করবে। তাই আমাদের জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের দিকে বিশেষভাবে মনোযোগী হওয়া অত্যন্ত জরুরি। একুশ শতকের দরজায় দাঁড়িয়ে তাই জনসংখ্যার ভয়াল বিস্ফোরণের লাগাম টেনে ধরে উন্নয়নের দিকে ধাবিত করা জরুরি।
দারিদ্র্য এবং অশিক্ষাই জনসংখ্যা বৃদ্ধির অন্যতম মূল কারণ। বিশেষত কিছু সম্প্রদায়ের ক্ষেত্রে এই বিষয়ে সচেতনতার অভাব রয়েছে। যে কারণে সম্প্রদায়ভিত্তিক সচেতনতা গড়ে তোলার দিকেই বিশেষ নজর দেয়া প্রয়োজন।
কিশোর-কিশোরী এবং প্রবীণেরা কতটা পরিষেবা পাচ্ছেন সেদিকে নজর রাখতে ডিজিটাল পদ্ধতিতে ট্র্যাকিংয়ের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। সচেতনতা বৃদ্ধির পাশাপাশি স্বাস্থ্য পরিকাঠামোর উন্নতি এবং বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে জনসংখ্যার ভারসাম্য বজায় রাখার দিকে বিশেষ গুরুত্ব দেয়াটাই জরুরি।
লেখক: সাংবাদিক
ভোরের আকাশ/নি