logo
আপডেট : ১৫ জুলাই, ২০২৩ ১০:২৪
কূটনীতিকদের দৌড়ঝাঁপ
সংকট সমাধান দেখছেন না বিশ্লেষকরা
এম সাইফুল ইসলাম

সংকট সমাধান দেখছেন না বিশ্লেষকরা

এম সাইফুল ইসলাম: দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে সম্প্রতি বিদেশি কূটনীতিকদের বাংলাদেশ সফরে তাৎপর্যপূর্ণ হলেও সংকটের সমাধান দেখছেন না দেশের বিশিষ্টজনরা। তারা মনে করছেন, নির্বাচনকালীন সংকট উত্তরণে একটি কার্যকরী সংলাপে নিজেদের সমস্যা সমাধানের কোনো বিকল্প নেই। অন্যথায় অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে দুর্ভোগ সবাইকে পোহাতে হবে।

 

তার দায় প্রধান দুটি দল আওয়ামী লীগ-বিএনপিসহ সব রাজনীতিবিদকে। তারা বলছেন, বর্হিবিশ্বে হয়তো নিজেদের স্বার্থ হাসিলে এখানে গণতন্ত্র বজায় রাখার তাগিদ দিচ্ছে। তারপরও সেটিতে গুরুত্ব দেয়া উচিত। কারণ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় স্থিতিশীলতা বজায় থাকলে অন্য কারো স্বার্থের চেয়ে দেশ ও জনগণের স্বার্থ আগে রক্ষা হবে।

 

এদিকে সফররত ইইউ প্রতিনিধি দল আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জামায়াতসহ কয়েকটি দলের সঙ্গে আজ শনিবার বৈঠকে বসছে। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে দেশের রাজনীতির মাঠ সরগরম হয়ে উঠেছে। নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ আর বিএনপি এখন পরস্পরবিরোধী অবস্থানে অনড়। ঠিক সেই মুহূর্তে ভূরাজনীতি আর চাওয়া-পাওয়ার নানা হিসেবে রয়েছে বাংলাদেশের উন্নয়ন সহযোগী বাইরের রাষ্ট্র বা সংস্থাগুলোর। আগামী সংসদ নির্বাচনের ঠিক আগ মুহূর্তে চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকেই বিদেশি কূটনীতিকরা ঢাকামুখী।

 

জানা গেছে, সংক্ষিপ্ত সফরে গত ৬ জুলাই ঢাকায় এসেছিলেন ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব (পূর্ব) সৌরভ কুমার। মূলত বে অব বেঙ্গল ইনিশিয়েটিভ ফর মাল্টি সেক্টরাল টেকনিক্যাল অ্যান্ড ইকোনমিক কো-অপারেশন (বিমসটেক) ইস্যুতে আলোচনা করতে তার এ সফর। তার সফরের দুদিন পরই ৮ জুলাই ঢাকায় এসেছে ইইউ প্রাক-নির্বাচনী পর্যবেক্ষক দল। আগামী ২৩ জুলাই পর্যন্ত এ প্রতিনিধি দলটি বাংলাদেশে অবস্থান করবে।

 

আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে সার্বিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করতেই তাদের ঢাকা সফর। তারা মূলত নির্বাচনের সময়ে পর্যবেক্ষকদের নিরাপত্তা, নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য ও সহিংসতামুক্ত হওয়ার সম্ভাবনার বিষয়গুলো খতিয়ে দেখবে। তারপর নির্বাচনে ইইউ নির্বাচন পর্ববেক্ষণ দল আসবেন কিনা, সে বিষয়ে তারা সিদ্ধান্ত নেবেন। ইইউ এ প্রতিনিধি দল ঢাকায় এসে প্রথমেই তারা যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র ছাড়াও বেশ কয়েকটি পশ্চিমা দেশের কূটনীতিকদের সঙ্গে বৈঠক করেছে। সেই বৈঠকে বাংলাদেশে আগামী নির্বাচনের সার্বিক পরিস্থিতি জানতে চায় প্রতিনিধি দল।

 

পরবর্তী সময়ে এ দলটি সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে বৈঠক করে। এরপর তারা পর্যায়ক্রমে আইনমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান, নির্বাচন কমিশন, অ্যার্টনি জেনারেল, পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় ও সিলেট বিভাগীয় কমিশনার কার্যালয়ে বৈঠক করেছে।

 

এরই ধারাবাহিকতায় আজ ইইউ প্রতিনিধি দল আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জামায়াত, জাতীয় পার্টি, এবি পার্টিসহ কয়েকটি দলের সঙ্গে বৈঠকে বসছে। এসব বৈঠকে দলগুলো যার যার অবস্থান তুলে ধরবে। ইইউর প্রতিনিধি দলটি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গেও বৈঠক করবে। এছাড়া নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি ও বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে বৈঠক করবে তারা।

 

ইইউ প্রতিনিধি দলের সদস্যরা আসন্ন নির্বাচনে রাজনৈতিক দলগুলোর অবস্থান বোঝার চেষ্টা করছেন। একইসঙ্গে প্রশাসন ও সরকার সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে বৈঠকে জানার চেষ্টা করছে বিদ্যমান ব্যবস্থায় এবং বিদ্যমান আইন কাঠামোয় অবাধ নিরপেক্ষ, অংশগ্রহণমূলক ও সহিংসতামুক্ত ভোট করা সম্ভব কিনা। ইইউর এ সফরের মাঝে গত ১১ জুলাই ঢাকা আসেন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের নাগরিক নিরাপত্তা, মানবাধিকার ও গণতন্ত্রবিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি উজরা জেয়া। তার সঙ্গে ছিলেন পররাষ্ট্র দপ্তরের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া বিষয়ক সহকারী সেক্রেটারি ডোনাল্ড লু।

 

তারা বাংলাদেশ সফরের আগে ২০২১ সালের ১০ ডিসেম্বর গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে র‌্যাবের ৭ বর্তমান ও সাবেক কর্মকর্তার ওপর যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা দেয়। এছাড়া দেশটির পক্ষ থেকে আগামী নির্বাচন অবাধ ও নিরপেক্ষ করতে অনেকটাই চাপ প্রয়োগ করার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। গত ২৪ মে বাংলাদেশে সুষ্ঠু নির্বাচনে বাধা প্রদানকারীদের বিষয়ে ভিসানীতি ঘোষণা করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এরপর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কঠোর সমালোচনা করেছেন দেশটির।

 

উজরা জেয়ার নেতৃত্বে সফরে মার্কিন প্রতিনিধি দল সফরের প্রথম দিন কক্সবাজার রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন করেন। এছাড়া বৃহস্পতিবার আন্ডার সেক্রেটারি উজরা জেয়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেনের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। এছাড়া তিনি নাগরিক সমাজের ৫ জন প্রতিনিধির সঙ্গে বৈঠক করেছেন। রাতে প্রধানমন্ত্রী বেসসরকারি শিল্পবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের সঙ্গে নৈশভোজে মিলিত হন। এসব বৈঠকে সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য পেয়েছে জাতীয় সংসদ নির্বাচন ইস্যু।

 

উজরা জেয়া স্পষ্ট করে বলেন, নির্বাচনের আগে তারা এখানকার রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংলাপ চান। তবে এক্ষেত্রে তারা প্রকাশ্যে ভ‚মিকা রাখতে চান না। এছাড়া বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষের অংশগ্রহণে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার ওপর নির্ভর করবে ভবিষ্যৎ। এদেশে শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক কর্মসূচি পালনেও জোর দিয়েছেন তিনি। সর্বোপরি বাংলাদেশে একটি অবাধ ও নিরপেক্ষ এবং সহিংসতামুক্ত নির্বাচন চায় যুক্তরাষ্ট্র এমন বার্তা তিনি স্পষ্ট করেছেন।

 

আগামী নির্বাচনের আগে দেশের দুই প্রধান দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি যখন নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে পরস্পরবিরোধী অবস্থানে তখন বিদেশিদের এ সফর দেশের ক‚টনীতি ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকরা কীভাবে দেখছেন, তা জানার চেষ্টা করে দৈনিক ভোরের আকাশ। তাদের বেশিরভাগই মনে করছেন, বাংলাদেশ কৌশলগতভাবে ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের খুব গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে থাকায় বিশ্বের নজর বেড়েছে।

 

ফলে সবাই এখন ঢাকার সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে চায়। রাজনৈতিক স্থিতিশীল পরিস্থিতি নষ্ট হলে গোটা এ অঞ্চলের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াবে। বর্হিবিশ্ব বিনিয়োগ ঝুঁকির মধ্যে পড়বে। তাই শুধু নিজেদের জন্য এখানে পশ্চিমারা বা বর্হিবিশ্ব বাংলাদেশে নিজেদের স্বার্থ দেখছে তা নয় গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া না থাকলে, সেটি যে কারো জন্য ভালো হবে না, সেটি আমাদের বোঝানোর চেষ্টা করছে। যদিও পশ্চিমাদের গণতন্ত্রের এ ছবক মানতে নারাজ চীন ও রাশিয়া। আর এবার কৌশলগত নীরবতায় প্রতিবেশী দেশ ভারত।

 

বিষয়টি নিয়ে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার ভোরের আকাশকে বলেন, দেশের অভ্যন্তরের পরিস্থিতি ভালো থাকলে বাইরে কেউ ‘নসিহত’ করার সুযোগ পেত না। আমাদের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া যখন দুর্বল হয়, তখন এখানে অনেকেই এসে কথা বলতে শুরু করে। গত কয়েকদিনের কূটনীতিক তৎপরতা খুব তাৎপর্যপূর্ণ দাবি করে তিনি বলেন, তারা আমাদের বলতে চাইছে তোমরা একটি শান্তিপূর্ণ নির্বাচন ও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ফিরে এসো। অন্যথায় এখানে অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সৃষ্টির দায় তোমাদের। তাই আমাদের রাজনীতিবিদদের যদি শুভ বুদ্ধর উদয় হয়, তাহলে তারা একটি শান্তিপূর্ণ নির্বাচন ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনবেন।

 

অন্যথায় এখানে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে, যা আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্যে অনন্ধার ডেকে আনবে। এ বিষয়ে সাবেক রাষ্ট্রদূত মো. তৌহিদ হোসেন ভোরের আকাশকে বলেন, বিদেশিদের এবারের সফর বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। নির্বাচন বাংলাদেশের অভ্যন্তারীণ বিষয়। এ বিষয়ে বর্হিবিশ্বের হস্তক্ষেপ কাম্য নয়। আমাদের নিজেদের বিষয় নিজেরা বসে ঠিক করতে হবে। অন্যথায় পরিস্থিতি ভালো হওয়ার কথা নয়।

 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ মনে করেন, বাংলাদেশের অভ্যন্তরে রাজনীতিতে বিভক্তি প্রকট। তাই এখানে বাইরে থেকে এসে কথা বলার সুযোগ পায়। বাংলাদেশের ইতিহাসে বলে এখানে বাইরে থেকে এসে কোউ সমস্যার সমাধান করতে পারেনি। তাই নিজেদের সমস্যা নিজেদের মেটাতে হবে। এখানে বিদেশিদের একটি আগ্রহ আছে এবং থাকে, কারণ এখানে তারা অনেক বিনিয়োগ করেছে।

 

বিদেশিদের বিনিযোগ থাকার কারণে তারা আগ্রহ দেখায়। এখন শেষ পর্যন্ত দেখা যাবে দেশের জনগণ কী ধরনের পদক্ষেপ নেয়। তিনি বলেন, এ সফরে দুটি বিষয় সামনে এসেছে। একটি হচ্ছে নিজেরা বসে সমস্যার সমাধান আর অন্যটি হচ্ছে মানুষের গণআন্দোলনে চাপ সৃষ্টি করে দাবি মানতে বাধ্য করা। এর বিকল্প তিনি দেখছেন না।

 

ভোরের আকাশ/নি