আরিফ সাওন: বাসার ফুলের টবে বা অন্য কোথাও কোনো জমা পানি নেই। নেই ডেঙ্গু জন্মানোর মতো কোনো পরিবেশ। ব্যালকনির টবে বা টবের নিচে পানি জমল কিনা তা প্রতিনিয়ত খেয়াল করি। বিশেষ করে বৃষ্টি পড়ার পর থেমে গেলেই আমি ব্যালকনিতে গিয়ে পানির টবের গোড়ায় পানি জমা দেখলেই ফেলে দিই। আমার বাসায় মশা চোখে পড়ে না। তারপরও সারাদিন মশারি টানিয়ে রাখি। ছেলেকে মশারির বাইরে আসতেই দিই না। স্কুল থেকে ফেরার পরই মশারি টানিয়ে তার ভেতরে বসিয়ে দিই। লেখাপড়া-খেলা সব মশারির মধ্যেই চলে।
সেদিন রাতে শোয়ার পর মশারির ভেতর থেকে মশার মতো কী যেন উড়তে দেখলাম। ভাবলাম মশা। অনেক খোঁজাখুঁজি করলাম। অন্তত আধাঘণ্টা ধরে খুঁজলাম। মশা পেলাম না। কিন্তু মনের মধ্যে আতঙ্ক। রাতে আর ঘুমই এলো না। আমি যখন রান্না করতে যাই তখনো একটা আতঙ্ক কাজ করে। এই বুঝি মশা পায়ে কামড় বসায়। সারাক্ষণ মনের মধ্যে একটা আতঙ্ক কাজ করে। ছেলেকে যখন স্কুলে নিয়ে যাই, যখন যায় তখন হাতে মশা প্রতিরোধক লোশন লাগিয়ে দেই। কিন্তু মনের মধ্যে আতঙ্ক থেকেই যায়।
শুনলাম এক দিনে ১৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। আর প্রতিদিন যে পরিমাণে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে, তা শুনে আতঙ্ক আর উদ্বেগ বেড়েই চলছে। এভাবে কথাগুলো বলছিলেন রাজধানীর পূর্ব জুরাইনের বাসিন্দা উলফাতুন্নেসা। শুধু তিনি নন, রাজধানীতে বসবাসকারী বেশির ভাগ অভিভাবক নিজেদের নিয়ে যেমন, তার চেয়ে বেশি সন্তানদের নিয়ে উদ্বিগ্ন। জুলাই মাসে প্রকোপ বৃদ্ধির পর ডেঙ্গু আতঙ্কে দিন কাটছে অনেকের। তারা চেষ্টা করছেন সতর্ক থাকার, যাতে মশা জন্মাতে বা কামড়াতে না পারে।
শুধু রাজধানী নয়, ডেঙ্গু আতঙ্ক এখন দেশজুড়ে। দেশে প্রথম ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয় ২০০০ সালে। তারপর থেকে এ পর্যন্ত এক দিনে কখনো এত রোগীর মৃত্যু হয়নি। ১৮ জুলাই সকাল ৮টা থেকে ১৯ জুলাই সকাল ৮টা পর্যন্ত এক দিনে এই প্রথম ১৯ জনের মৃত্যু হলো। এই পরিস্থিতিকে ডেঙ্গু মহামারি বলছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা জরুরি অবস্থা জারি করে সর্বাত্মক ও সমন্বিত পদক্ষেপ গ্রহণের তাগিদ গিয়েছেন।
আইইডিসিআরের উপদেষ্টা ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, সারা দেশে ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়েছে। যেহারে আক্রান্ত হচ্ছে আর মৃত্যু হচ্ছে, তাতে ডেঙ্গু মহামারির পর্যায়ে তো অবশ্যই পড়ে গেছে।
মহামারি ঘোষণা করা প্রয়োজন কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, অবশ্যই প্রয়োজন। কিন্তু আমাদের দেশে ঘোষণা করা হয় না যে, মানুষ আতঙ্কিত হয়ে পড়তে পারে। যেখানে মানুষ মারা যাচ্ছে, সেখানে এসব কথা...। এখনই জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে সর্বাত্মক ও সমন্বিত পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন এই বিশেষজ্ঞ। না হলে পরিস্থিতি সামাল দেয়া কঠিন হয়ে পড়বে বলেও মনে করেন তিনি।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, ডেঙ্গু যেভাবে বিস্তার লাভ করেছে, যেহারে আক্রান্ত হচ্ছে আর মানুষের প্রাণহানি ঘটছে তাতে ডেঙ্গু মহামারি বলা যায়। এতে কোনো সন্দেহ নেই। ২০০০ সালে দেশে ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়। তারপর ২০১৯ সালে এবং ২০২২ সালে বেশি আক্রান্ত হয় এবং মৃত্যু হয়। এ পর্যন্ত বেশি মৃত্যু হয়েছে ’২২ সালে। এবার আমরা ডেঙ্গুর যে পরিস্থিতি দেখছি, তাতে আশঙ্কা করছি বিগত ২৪ বছরের রেকর্ড ছাড়িয়ে যাবে।
তিনি বলেন, এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে এডিস মশা নির্মূল করতে হবে। কিন্তু আমরা মশা মারার যে কার্যক্রম দেখছি তা যথেষ্ট নয়। এভাবে এডিস নির্মূল সম্ভব হবে না। আমি বলব আগামী সাত দিনের মধ্যে জরুরি অবস্থা জারি করে জনসম্পৃক্ততার মাধ্যমে মশা নির্মূলের কাজ করতে হবে। সেই সঙ্গে আক্রান্তদের চিকিৎসা নিশ্চিত করতে হবে। যারা দরিদ্র তাদের আর্থিক সহায়তা দিতে হবে।
মহামারি ঘোষণার পরিকল্পনা আছে কিনা জানতে চাইল স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এবিএম খুরশীদ আলম বলেন, আমরা মহামারি ঘোষণা করার অথরিটি না। এ বিষয়ে পলিসি মেকার পর্যায় থেকে সিদ্ধান্ত আসতে হবে। ঘোষণা করলে আসলে কোনো লাভ আছে কিনা প্রশ্ন রেখে মহাপরিচালক বলেন, আমরা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে তো সর্বাত্মক চেষ্টা করছি। মন্ত্রী মহোদয় দেশের বাইরে আছেন। তিনি আগামীকাল আসার পর একটা সংবাদ সম্মেলন করবেন।
যেসব বিপদচিহ্ন দেখে যেতে হবে হাসপাতালে : ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসা দিতে সব ধরনের প্রস্তুতি রয়েছে বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) ডা. রাশেদা সুলতানা।
তিনি বলেন, যেসব বিপদচিহ্ন দেখলে আমরা হাসপাতালে যাব সেগুলো হলো- জ্বরের সঙ্গে প্রচন্ড পেটে ব্যথা ও অত্যধিক পানির পিপাসা থাকলে, ঘনঘন বমি বা বমি বন্ধ না হলে, রক্ত বমি বা কালো পায়খানা হলে, দাঁতের মাড়ি বা নাক থেকে রক্তপাত হলে, ছয় ঘণ্টার বেশি সময়ে প্রস্রাব না হলে, প্রচন্ড শ্বাস কষ্ট হলে, ডায়রিয়া হলে ও অত্যাধিক দুর্বলতা অনুভব করলে, গর্ভবতী মা, নবজাতক শিশু, বয়স্ক রোগী, ডায়বেটিস ও কিডনি রোগ থাকলে, শরীরের তাপমাত্রা অস্বাভাবিক কমে গেলে এই বিপদচিহ্ন থাকলে সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালে ভর্তি হতে হবে।
তিনি বলেন, কতক্ষণ পর্যন্ত আক্রান্ত রোগী বাসায় থাকতে পারবেন তারও কিছু ক্রাইটেরিয়া আছে- এ ধরনের বিপদচিহ্নগুলো যদি না থাকে, শুধু যদি জ্বর থাকে সে ক্ষেত্রে মুখে পর্যাপ্ত তরল খাবার খেতে হবে। প্রতি ছয় ঘণ্টায় যদি একবার প্রস্রাব হয়, তাহলে তিনি বাড়িতে চিকিৎসা নিতে পারেন। বাড়িতে থাকা অবস্থায় কোনো বিপদচিহ্ন না থাকলে সম্পূর্ণ রেস্টে থাকতে হবে। স্বাভাবিক খাবারের সঙ্গে পর্যাপ্ত লবণযুক্ত খাবার যেমন খাবার স্যালাইন, ডাবের পানি, ফলের রস, স্যুপ ইত্যাদি খেতে হবে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (পরিকল্পনা ও গবেষণা) ডা. আফরিনা মাহমুদ বলনে, ডেঙ্গু জ্বরে প্যারাসিটামল ছাড়া অন্য কোনো ওষুধ সেবন করা যাবে না। অন্য ওষুধ সেবন করতে হলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে সেবন করতে হবে। জ্বর কমাতে কুসুম গরম পানি দিয়ে সারা শরীর মুছে দিতে হবে।
তিনি বলেন, ফুলের টবসহ বাসার চারপাশে জমা পানি তিন দিনের মধ্যে ফেলে দিন। তিন দিনের বেশি সময়ের জন্য বাড়ির বাইরে গেলে কমোড প্যান ইত্যাদি ঢেকে রাখুন এবং পানির পাত্রগুলো উল্টিয়ে রাখুন। দিনে ও রাতে ঘুমানোর সময় অবশ্যই মশারি ব্যবহার করুন। মশার কামড় থেকে বাঁচতে ছোট বড় সকলেই শরীর ঢেকে রাখে এমন কাপড় পরিধান করুন।
এক দিনে ১৯ জনের মৃত্যু : ডেঙ্গুতে এক দিনে ১৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে ১৭ জন রাজধানী ঢাকায় এবং ঢাকার বাইরে ২ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়ে চলতি বছর ডেঙ্গুতে ১৪৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। শুধু জুলাই মাসের এই ১৯ দিনে মৃত্যু হয়েছে ৯৯ জনের। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম থেকে এ তথ্য জানানো হয়েছে।
মঙ্গলবার সকাল ৮টা থেকে বুধবার সকাল ৮টা পর্যন্ত ডেঙ্গু নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে ১ হাজার ৭৯২ জন। কন্ট্রোল রুম জানায়, নতুন ভর্তিদের মধ্যে ৯২২ জন ঢাকায় এবং ঢাকার বাইরে ৮৭০ জন। বর্তমানে দেশের সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন ৫ হাজার ৫৫২ জন। এর মধ্যে ঢাকায় ৩ হাজার ৩৭০ জন এবং ঢাকার বাইরে ২ হাজার ১৮২ জন। ডেঙ্গু নিয়ে চলতি বছর সারা দেশের হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ২৫ হাজার ৭৯২ জন। এর মধ্যে ঢাকায় ১৬ হাজার ৩৮৯ জন এবং ঢাকার বাইরে ৯ হাজার ৩৯৪ জন।
এ পর্যন্ত হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র পেয়েছেন ২০ হাজার ৯৪ জন। এর মধ্যে ঢাকায় ১২ হাজার ৯১৫ জন এবং ঢাকার বাইরে ৭ হাজার ১৭৯ জন। ডেঙ্গুতে চলতি বছরের এ পর্যন্ত প্রাণ গেছে ১৪৬ জনের। এর মধ্যে চলতি মাসেই মৃত্যু হয়েছে ৯৯ জনের। জুনে মৃত্যু হয়েছে ৩৪ জনের। বাকি কয়েকজন তার আগের মাসগুলোতে মারা গেছেন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, জুলাই মাসে ডেঙ্গু নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে ১৭ হাজার ৮১৪ জন। সেই হিসেবে দিনে গড়ে ৯৩৭ জন করে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে অর্থাৎ ঘণ্টায় ৩৯ জন।
ঢাকার বাইরে আগে রোগী কম থাকলেও গত সপ্তাহ থেকে রোগী বাড়তে শুরু করেছে। গত তিন দিনে ঢাকা এবং ঢাকার বাইরে রোগী প্রায় সমান সমান ভর্তি হয়েছে।
ডেঙ্গু রোগীদের জন্য রাজধানীর মহাখালীর ডিএনসিসি ডেডিকেটেড কোভিড-১৯ হাসপাতালে ৮০০ শয্যা রয়েছে। সেখানে রোগী ভর্তি আছে ১২১ জন। বাকি শয্যা খালি আছে। রোগীর চাপ বেশি মুগদা জেনারেল হাসপাতালে। সেখানে ৫০৯ জন রোগী ভর্তি রয়েছে। মুগদায় রোগীদের জন্য প্রস্তুত রয়েছে ৬০০ শয্যা।
ঢাকা মেডিকেলে ডেঙ্গু রোগীদের জন্য ১২০ শয্যা থাকলেও সেখানে ভর্তি রয়েছে ২৪০ জন। স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেলে ১৯৫ শয্যা রয়েছে। সেখানে ভর্তি আছেন ১৮৩ জন। শিশু হাসপাতালে ৪৪ শয্যা রয়েছে। সেখানে ভর্তি আছে ৮ জন। সোহরাওয়ার্দীতে ১২০ শয্যা নির্ধারিত থাকলেও সেখানে ভর্তি রয়েছে ১৩১ জন। কুর্মিটোলায় ২২০ শয্যা থাকলে ভর্তি আছে ১২৫ জন। কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগীদের জন্য ৭২ শয্যা রয়েছে।
সেখানে ভর্তি ৫৬ জন। শুধু ডিএনসিসি ডেডিকেটেড হাসপাতাল এবং কুর্মিটোলা হাসপাতালে এখনো বেশ শয্যা খালি আছে। এছাড়া বেশির ভাগ হাসপাতালে নির্ধারিত শয্যায় কোথাও সামান্য কম, কোথাও বেশি রোগী ভর্তি রয়েছে।
ভোরের আকাশ/নি