শাহীন রহমান: মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার এক বিশিষ্ট জলবায়ু বিশেষজ্ঞ জানিয়েছেন, চলতি জুলাই মাস কয়েক হাজার না হলেও অন্তত কয়েকশ’ বছরের মধ্যে সবচেয়ে উষ্ণ মাস হতে যাচ্ছে। বাংলাদেশে ঋতু-বৈচিত্র্যের ধরন অনুযায়ী, চলতি জুলাই মাসে সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত হয়ে থাকে।
প্রকৃতির এ সময়কে শ্রাবণ মেঘের দিন হিসেবেও অবহিত করা হয়ে থাকে, যার প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো সারা দিন আকাশে মেঘের ঘনঘটা। সেইসঙ্গে টানা বৃষ্টির রিমঝিম শব্দে প্রকৃতি যেন মুখর হয়ে ওঠে। অথচ এ পরিবেশ এখন সম্পূর্ণ উল্টে গেছে। শ্রাবণের এ সময়ে যখন মেঘ-বৃষ্টির ঘনঘটা থাকার কথা, সেখানে গত কয়েকদিন ধরে সারা দেশে গরম ভোগাচ্ছে মানুষকে। এবার জুলাই শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বৃষ্টিপাত উধাও হয়ে গেছে।
পরিবর্তে প্রকৃতিতে এখন বয়ে যাচ্ছে তাপপ্রবাহ। আবহাওয়া অফিস জানায়, শুধু জুলাই নয়, আগামী সেপ্টেম্বরের মধ্যে ভারী বৃষ্টিপাতের আভাস নেই। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশসহ এ অঞ্চলে প্রধানত চার মাস ব্যাপক বৃষ্টিপাত হয়। তা শুরু হয় মধ্য জুন থেকে। চলে মধ্য সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। অধিক বৃষ্টির কারণে প্রতি বছর মধ্য জুলাইয়ে সারা দেশে বন্যার পানিতে ভেসে যায়। পানিবন্দি হয়ে পড়েন দেশের লাখ লাখ বাসিন্দা।
পুরো আগস্ট মাস পর্যন্ত অব্যাহত থাকে বন্যার দাপট। সেপ্টেম্বর থেকে কমে আসে বৃষ্টির প্রবণতা। আবহাওয়া অফিসের হিসাব অনুযায়ী, জুনের প্রথম সপ্তাহে প্রকৃতিতে দক্ষিণ পশ্চিম মৌসুমি বায়ু প্রবাহিত হয়। এ কারণেই মূলত বেশি বৃষ্টিপাত হয় এ সময়। এবারো ঘড়ির সময় ধরে মধ্য জুনে মৌসুমি বায়ু দেশে প্রবেশ করে। এর প্রভাবে এবার জুনের শেষ দিনগুলোয় ব্যাপক বৃষ্টিপাত হয়েছে। ফলে দেশের উত্তরাঞ্চল ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলে বন্যা দেখা দেয়। কিন্তু তা বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। বন্যার প্রকোপ এখন আর দেশে নেই। তার পরিবর্তে চলছে তাপপ্রবাহ।
আবহাওয়া অফিস জানায়, গরমের এ দাপট অব্যাহত ধাকবে। বিশেষ করে এ সময়ে বাতাসে জলীয় বাষ্প বেশি থাকায় তাপপ্রবাবে গরমের অনুভূতি বেশি হতে পারে।
আবহাওয়াবিদ আবুল কালাম মল্লিক বলেন, আগামী সেপ্টেম্বর পর্যন্ত গরম এরকমই থাকবে। মাঝেমধ্যে তাপমাত্রা কম থাকতে পারে, কিন্তু গরমের অনুভূতি কম থাকবে না। এর কারণ ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, বাতাসে এখন জলীয় বাষ্পের পরিমাণ বেশি, বৃষ্টিপাত কমে গেছে। এখন তাপমাত্রা যদি ৩২ থেকে ৩৪ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মাঝেও থাকে, আর্দ্রতার কারণে গরম অনুভ‚ত হবে বেশি।
তিনি বলেন, গরমের সময় ঘাম হয়। ঘামের মাধ্যমে শরীর নিজেকে ঠান্ডা করে। কিন্তু জলীয় বাষ্প থাকলে এ ঘাম বের হওয়ার প্রক্রিয়াটা বাধাগ্রস্ত হয়। তাই অস্বস্তিকার গরম লাগে। আগামী কয়েকদিনের মধ্যে বৃষ্টির সম্ভাবনা আছে কিনা জানতে চাইলে বলেন, কয়েকদিনে বড় ধরনের বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা নেই। বৃষ্টি হলেও তা খুব সামান্য। ঢাকা, রাজশাহীসহ আরো কয়েক বিভাগে কিন্তু বৃষ্টিপাত অলরেডি কমে গেছে। এবারের এ ধরনের খরতাপের সূত্রপাত শুধু জুলাই থেকে নয়। চলতি বছর এপ্রিল ও মে মাস গেছে তাপপ্রবাহের দাপটে। এর মধ্যে ঘূর্ণিঝড়ও হানা দিয়ে গেছে।
আবহাওয়া অধিদপ্তর আগেই জানিয়েছিল, জুন থেকে শুরু হওয়া বর্ষা মৌসুমেও গরম পিছু ছাড়বে না। আবহাওয়ার এমন ‘অসহনীয়’ অবস্থার জন্য মৌসুমি বায়ুর নিষ্ক্রিয়তাকে দায়ী করেছেন আবহাওয়া বিশেষজ্ঞরা। শুধু বাংলাদেশ নয়, এ বছরের জুলাইয়ের উষ্ণতা বিশ্ব জুড়েই ছড়িয়ে পড়ছে। এ বিষয়ে আমেরিকা মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসাও সতর্কতা উচ্চারণ করেছে।
তারা জানায়, বিশ্বজুড়ে তাপপ্রবাহ শুরু হয়েছে। প্রায় প্রতিদিনই তাপমাত্রা আগের রেকর্ডকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে। সম্প্রতি নাসার জলবায়ু বিশেষজ্ঞ গেভিন শ্মিডট বলেন, এ মাসে প্রতিদিনই তাপমাত্রার নতুন রেকর্ড সৃষ্টি হচ্ছে। বর্তমানে যে চরম দাবদাহ চলছে, তা প্রশ্নাতীত। বিশ্বজুড়ে নজিরবিহীন পরিবর্তন দেখছি। যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ ও চীনে আমরা যে তাপপ্রবাহ দেখছি, তা আগের সব রেকর্ড ভেঙে ফেলছে। এ বিরূপ তাপমাত্রার জন্য শুধু ‘এল নিনো’ নামের বিশেষ আবহাওয়া পরিস্থিতিকে দায়ী করা যায় না। কারণ এবারের এল নিনো মাত্র কিছুদিন আগে শুরু হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উষ্ণতা বৃদ্ধির এ চিত্র পৃথিবীর গড় তাপমাত্রায়ও প্রতিফলিত হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্টাল প্রেডিকশন (এনওএএ) ১৯৭৯ সাল থেকে সর্বোচ্চ গড় তাপমাত্রার হিসাব রাখছে।
সংস্থাটির তথ্যমতে, গত ৩ জুলাই বৈশ্বিক গড় তাপমাত্রা সর্বোচ্চ ১৭.০১ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা ৬২.৬২ ডিগ্রি ফারেনহাইট রেকর্ড করা হয়। এর আগে সর্বোচ্চ বৈশ্বিক গড় তাপমাত্রার রেকর্ডটি ছিল ১৬.৯২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা ৬২.৪৬ ডিগ্রি ফারেনহাইট। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) জানায়, চরম তাপমাত্রা দেশে দেশে স্বাস্থ্যসেবার ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলছে। বিশেষ করে শিশু ও বয়স্ক ব্যক্তিদের স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ছে।
বৈশ্বিক তাপমাত্রার বৃদ্ধি ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে সীমিত রাখার লক্ষ্য থেকে বিশ্ব ক্রমে দূরে যাচ্ছে বলে মনে করেন জলবায়ু বিষয়ক বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, কয়েক মাস ধরে স্থলভাগ ও সাগরের তাপমাত্রায় রেকর্ড হয়েছে। অথচ দেশগুলো এ বিষয়ে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হচ্ছে। আগামী নভেম্বরে দুবাইয়ে জাতিসংঘের জলবায়ুবিষয়ক সম্মেলন (কপ-২৮) অনুষ্ঠিত হবে।
এ বিষয়ে প্রস্তুতি নিতে গত জুন মাসের শুরুর দিকে জার্মানির বন শহরে একত্র হয়েছিলেন বিভিন্ন দেশ ও সংস্থার প্রতিনিধিরা। ইউরোপীয় ইউনিয়নের অর্থায়নে পরিচালিত কোপারনিকাস ক্লাইমেট চেঞ্জ সার্ভিস (সিথ্রিএস) জানায়, সেখানে আলোচনা হয়, কিছুদিন ধরে ভূপৃষ্ঠে বায়ুর তাপমাত্রা শিল্পযুগের আগের চেয়ে ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি রয়েছে।
২০১৫ সালে প্যারিস জলবায়ু সম্মেলনে বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি শিল্পায়নপূর্ব যুগের থেকে ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে পদক্ষেপ গ্রহণে চুক্তি সই হয়। তবে বিজ্ঞানীরা সতর্ক করেছেন, বর্তমান ধারায় চলতে থাকলে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন এ সীমার মধ্যে আটকে রাখা যাবে না।
জাতিসংঘের বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা (ডব্লিউএমও) গত মে মাসে এক পূর্বাভাসে জানায়, এখন থেকে ২০২৭ সালের মধ্যে অন্তত ৩৬৫ দিন বা পুরো এক বছর সময়ের তাপমাত্রা শিল্পায়নপূর্ব যুগের থেকে ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের সীমা ছাড়িয়ে যেতে পারে।
এ বছর এপ্রিল মাসজুড়ের টানা তাপপ্রবাহের কবলে ছিল দেশ। মে মাসে কমবেশি বৃষ্টি হলেও জুনের শুরু থেকে আবার দাবদাহের কবলে পড়ে দেশ। গত এপ্রিল মাসে তাপপ্রবাহের কারণে দেশে সর্বোচ্চ তাপমাত্র উঠে যায় প্রায় ৪৩ ডিগ্রির ওপরে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চলতি বছর প্রথম থেকেই গরম স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি। এবারের তাপপ্রবাহ এমন পর্যায় পৌঁছেছে যে, আবহাওয়া অধিদপ্তরকে সতর্কতা জারি করতে হয়েছে। অব্যাহত এ উষ্ণায়নের কারণ হিসেবে বিজ্ঞানীরা বলছেন, ৫ বছর পর আবহাওয়ায় ‘এল নিনো’ ফিরেছে। ফলে প্রকৃতি দ্রুতই উষ্ণ হয়ে পড়ছে।
তারা মনে করছেন, প্রশান্ত মহাসাগরে সৃষ্ট উষ্ণ স্রোতের প্রভাবে কারণে এ অবস্থা সৃষ্টি হচ্ছে। এই এল নিনোর কারণে আগামীতে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কমে গিয়ে অব্যাহত খরা পরিস্থিতি হতে পারে। এমনকি বর্ষায় পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাতের দেখা নাও মিলতে পারে।
তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আবহাওয়ার এ বিরূপ তাপমাত্রার জন্য শুধু ‘এল নিনো’ নামের বিশেষ আবহাওয়া পরিস্থিতিকে দায়ী নয়। জলবায়ু পরিবর্তনই এর মূল কারণ।
ভোরের আকাশ/নি