logo
আপডেট : ২৪ জুলাই, ২০২৩ ১৪:০৪
একজন আসমা ও দুবাই জলবায়ু সম্মেলন
পাভেল পার্থ

একজন আসমা ও দুবাই জলবায়ু সম্মেলন

বিশ্বের বৃহত্তম বাদাবন সুন্দরবন। শ্যামনগর দেশের বৃহত্তম উপজেলা। এই উপজেলার মানুষ একই সঙ্গে বিরল ও নিদারুণ অভিজ্ঞতার সঙ্গী। প্রতিদিন সুন্দরবনকে দেখে বড় হওয়ার অভিজ্ঞতাটি বিরল। তবে অন্য অভিজ্ঞতাটি নিদারুণ। তীব্র নোনা আর লাগাতার ঝড়-জলোচ্ছাস আজ ঝাঁঝরা এই জনপদ। বিস্ময় লাগে এখানেই, ধূমঘাটে, এক সময় গড়ে ওঠেছিল রাজা প্রতাপাদিত্যের রাজধানী। মিডিয়া আজ এখানকার গাবুরাকে চেনে জলবায়ু-দুর্গত এলাকা হিসেবে।

 

কত মিডিয়া, কত উন্নয়ন ফেরিওয়ালা নিত্য এখানে আসে ‘দুর্গতি’ বুঝতে। এখান থেকেই জাপানি বড়লোকদের খাবার থালায় নরম খোলের কাঁকড়া যায়। ঢাকায় যায় সুন্দরবনের মধু। তো গাবুরার কথা যখন চলেই এলো, দেখা যাক আইলার ১৪ বছর পর কী স্মৃতি-বিস্মৃতি নিয়ে এখানে বাঁচে মানুষ। এই যে দুম করে ‘আইলার’ নাম লেখা হলো, দেশের কতজনের জানা আছে এই নির্দয় যন্ত্রণার নাম? দেশজুড়ে মুছে গেলেও গাবুরার যেকোনো জীবনে আইলা এখনো এক দুঃসহ স্মৃতি।

 

এর দাগ ও ক্ষত নিয়ে এখনো বেঁচে আছে গাবুরা। আইলা ২০০৯ সালের এক ঘূর্ণিঝড়, যা, লন্ডভন্ড করে দিয়ে যায় শ্যামনগরসহ পুরো দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চল। তো এই অতি পরিচিত গাবুরাতে কিন্তু যাতায়াত এত সহজ কোনো ব্যাপার নয়। ঢাকা থেকে প্রায় ৩২৫ কিলোমিটার দূরে শ্যামনগর। তারপর সড়কপথে আরো ৩০ কিলোমিটার লক্কড়ঝক্কড় যাত্রার পর নীলডুমুর ঘাট। নৌকায় খোলপেটুয়া নদী পাড় হয়ে ডুমুরিয়া ঘাট। তারপর হেঁটে যে পথে যাই, যার সঙ্গেই কথা হয় ১৪ বছর আগের আইলার দগদগে ক্ষত টের পাওয়া যায়।

 

কথা হয় দিনমজুর আসমা খাতুনের সঙ্গে। চিংড়ি ঘেরে ঘাস বাছা, শেওলা পরিষ্কার, মাটি কাটার কাজ করে দৈনিক মজুরি পান ২৫০ টাকা। সপ্তাহে প্রতিদিন কাজ জুটে না। বছরে দুয়েকবার মাংস জুটে পাতে। একটা নতুন কাপড়ের টাকা জোগাতে বছর দুই অপেক্ষা করতে হয়। তিন সন্তানের ভেতর বড় ছেলে লেখাপড়া ছাড়ান দিয়েছে, ছোট মেয়ের বয়স দেড় বছর। দ্বিতীয় মেয়ে দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ে।

 

আসমাও দ্বিতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পড়তে পেরেছিলেন। অথচ তাদের ডুমুরিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টি স্থাপিত হয় ৬৯ বছর আগে, ১৯৫৪ সালে। আসমার স্বামী একজন বিশেষভাবে সক্ষম মানুষ, কোনো আয়-রোজগার নেই। তাদের কোনো জমি নেই। দুই শতক জমিতে একটা ছাপড়া ঘর করে থাকেন। তাও এই দুই শতকের মালিক আসমারা তিন বোন। যা হোক, আসুন আমরাও জলবায়ু-দুর্গতি বোঝার জন্য আসমার সঙ্গে ডুমুরিয়া গ্রামে ঘুরে আসি।

 

অষ্টাশির ঝড়ের সময় আসমা ‘ন্যাদা (কোলের বাচ্চা)’ ছিলেন। সিডরের সময় তার বিয়ে হয় চকবারা গ্রামে। আসরের পর ঝড় শুরু হয়, সারারাত ধরে চলে। ঘরের টিন উড়ে যায়, পানিতে ডুবে যায় গ্রাম। অন্ধকারে ঝড়ের ভেতর একটা উঁচু বাড়িতে আশ্রয় নেন। ডুবন্ত গ্রামে দুদিন পায়খানা করার কোনো জায়গা ছিল না। চকবারা থেকে কাজের সন্ধানে পূর্ব ডুমুরিয়া ফিরে আসেন।

 

কিন্তু সিডরে তাদের পরিবারের ঘরের কোনো চিহ্ন ছিল না, ঠাঁই নেন নানাবাড়িতে। সিডরের পর আইলা, বুলবুল, ফণী, আমফান ঝড়ের সাক্ষী আসমা। আমফান ঝড়ে আবারো তার ঘর ধসে যায়। দুই মাস পরের বাড়িতে ঘুরে ঘুরে আশ্রয়ে থাকেন। ৪০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে আবার একটা ঘর তোলেন। আসমা জানান, কপালে ঝড়ের দাগ নিয়াই আমাদের জন্ম। ঝড়-বন্যাই আমাদের কপাল, এই দাগ কী আর মুছবে?

 

আসমার বিশ্লেষণে আইলা ঝড়েই তাদের সবচেয়ে বেশি সর্বনাশ হয়েছে। গ্রামের মধ্যবিলে যেসব বাড়ি ছিল সব ভেসে যায়। মানুষ, গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগি মরেছিল অনেক। কিছু লাশ ভেসে উঠেছিল। ১৪টি লাশ কাদাময় বাঁধের ওপর সারি করে রাখা হয়েছিল। এখনো ঝড় এলে আসমার সামনে সেই ১৪ লাশ তাকিয়ে থাকে। আইলার সেই স্মৃতি টানতে গিয়ে কেঁপে ওঠেন আসমা। ‘... তিন দিন পিটপিটাইয়া বর্ষা ও বাতাস হইছিল।

 

সোমবার ছিল, জ্যৈষ্ঠ মাসের ৫ তারিখ। দুপুর ১২টার সময় হঠাৎ নদীর চাইরকানা দিয়া ওয়াপদা ভাইঙ্গা তুফুনের মতো পানিতে সব চুরমার হইয়ে যায়। কেউ কিচ্ছু নিয়া ঘর থেইকে গেওরাইতে পারে নাই। একটা দানাপানি কিচ্ছু না। যা পরন ছিল তাই নিয়া জান বাঁচাইছি। একটা ঘর নাই গাবুরায় আগের। সব আইলার পর হইছে। আইলার পর আমার বাচ্চাকাচ্চা হইছে।’

 

বৃষ্টি আর পুকুরের পানি ব্যবহার করলেও আইলার পর শ্যামনগরে এই বাস্তবতা পাল্টে যায়। গ্রাম থেকে গ্রাম বাঁধ ভেঙে লবণপানিতে তলিয়ে যায় সব। বাড়তে থাকে নোনা। শুরু হয় পানির নির্দয় জ্বালা। পানি আনতে কয়েক কিলোমিটার হাঁটতে হয় মেয়েদের। আসমাকে প্রতিদিন দুবার বাড়ি থেকে এক কিলোমিটার দূরের এক পুকুর থেকে পানি আনতে হয়। পাড়ি দিতে হয় একটি বাঁশের সাঁকো আর কর্দমাক্ত পিচ্ছিল ভঙ্গুর পথ। পিচ্ছিল পথে প্রায়ই ঘটে দুর্ঘটনা। এমনকি কলসটাও থিতু হয়ে যায়।

 

আগের দিনে মাটির কলস ব্যবহৃত হলেও এখন সিলভারের কলসই ব্যবহার করে সবাই। দীর্ঘসময় কলসভর্তি পানি বহনের ফলে মেয়েদের কোমর ও হাঁটুতে ব্যথা হয়, কিডনিতে সমস্যা হয়। আসমা জানান, মাটির কলসে চাপ কম কারণ মাটির কলসের নিচটা গোল থাকে। সিলভারের কলসের নিচটা সমান থাকে এবং এটি বারবার পেছলে যায় এবং কোমরে চাপ ফেলে বেশি। মাটির কলস নড়ে কম, কিন্তু সিলভারের কলস নড়ে বেশি। আগের দিনের মতো মাটির জিনিস নিয়ে পাইকার গ্রামে আসে না, এখন বেশি চলে প্লাস্টিক ও সিলভারের জিনিস।

 

আসমা জানান, বাপদাদার আমল থেকে এখন ঘূর্ণিঝড়ও বাড়ছে আর লবণাক্ততাও বাড়ছে। কেন বাড়তেছে জানতে চাইলে আসমা জবাব দেন, জলবায়ুর কারণে বাড়িছে। জলবায়ু জিনিসটা কী তার কাছে জানার আগ্রহ হয়। তিনি জানান, জলবায়ু জিনিসটা হলো এখন তাপমাত্রা বেশি, কলকারখানা বেশি, তাপমাত্রা যাবে কোথায়, তাই ঝড়বন্যা বেশি হচ্ছে। আসমার সঙ্গে ডুমুরিয়া গ্রাম ঘুরে বুঝতে পারি প্রায় সবার গল্পই একই রকমের।

 

তারপরও আসমারা টিকে থাকার লড়াই করছেন। পুকুরের পানিতে অল্প ফিটকিরি দিয়ে এই পানি ছেঁকে পান করছেন। ঘরের ভিটা, ছাগলের ভিটা উঁচু করেছেন। উঁচু মাচা করে কয়েক হাত জায়গায় কিছু সবজি বুনেছেন। মেয়েকে স্কুলে দিয়েছেন। ‘জলবায়ু’ শব্দটি আসমা এনজিওদের কাছ থেকে শুনেছেন। যার কাছ থেকেই শোনা হোক না কেন, আসমারা দুঃসহ জলবায়ু সংকটের মাঝে বসবাস করছেন। জানবাজি রেখে টিকে থাকার লড়াই করছেন।

 

জলবায়ু অভিযোজন, প্রশমন, তহবিল, জলবায়ু চুক্তি, ক্ষয়ক্ষতি তর্ক কিংবা জলবায়ু ন্যায্যতা এমন বৈশ্বিক জলবায়ু বাহাসগুলো আসমাদের জানা না থাকলেও আজ আসমাদের জীবনে এই জলবায়ু জিজ্ঞাসাগুলো নিদারুণভাবে জড়িয়ে গেছে। বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনের ২৮তম আসরটি এবার দুবাইয়ে। একের পর এক সম্মেলন আর একের পর এক মিথ্যা অঙ্গীকার। পৃথিবীর জলবায়ু গণিত কিন্তু সবার সামনেই পাল্টাচ্ছে। জলবায়ুকে উল্টেপাল্টে দেয়ার নয়াউদারবাদী প্রতিযোগিতায় আসমাদের বিন্দুমাত্র কোনো দোষ নাই।

 

তাহলে একের পর এক ঝড়ে আসমার ঘর কেন ভাঙবে? ছেলেকে কেন স্কুল ছাড়তে হবে? একটা কাপড় কেনার জন্য অপেক্ষা করতে হবে দুটি বছর? পানির কলস টানতে টানতে হারাতে হবে কোমর? যেসব ধনী দেশ আর করপোরেটদের জন্য কার্বণ নিঃসরণ থামছে না, তাদের জন্য ডুমুরিয়ার আসমার জরায়ুর নালীতে কেন ঘা হবে? এসব প্রশ্নের উত্তর কী দিতে পারবে আসন্ন দুবাই জলবায়ু সম্মেলন? ১৪টি লাশের স্মৃতি নিয়ে আসমাকে অপেক্ষা করতে হবে আরেকটি ঘূর্ণিঝড়ের। আসমা জানে এরপর আবারো আরেক ঝড় আসবে। আবারো দিনমজুরির খোঁজে ঘুরতে হবে গ্রামের পর গ্রাম।

লেখক : গবেষক ও কলামিস্ট

 

ভোরের আকাশ/নি