নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে দেশের ডেঙ্গু পরিস্থিতি। দৈনিক মৃত্যু ও আক্রান্তের অস্বাভাবিক হারে মহামারির উপসর্গ দেখা যাচ্ছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, ভয়াবহ রূপ নিয়েছে দেশের ডেঙ্গু পরিস্থিতি। সরকারি হাসপাতালে সিট মিলছে না ডেঙ্গু রোগীর। চিকিৎসা দিতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যসেবীরা। বেসরকারি হাসপাতালের উচ্চ চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে না পেরে অসহায় হয়ে পড়ছেন অনেক রোগী।
মঙ্গলবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের ইনচার্জ ডা. মো. জাহিদুল ইসলামের সই করা ডেঙ্গুবিষয়ক প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে গত ২৪ ঘণ্টায় সারা দেশে ১৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়ে চলতি বছর ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২০১ জনে।
এছাড়া গত ২৪ ঘণ্টায় নতুন করে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন দুই হাজার ৪১৮ জন, যা এক দিনে এ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। এর আগে গত সোমবার এক দিনে দুই হাজার ২৯৩ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। গত ২৪ ঘণ্টায় মারা যাওয়া ১৬ জনের মধ্যে ১৪ জনই ঢাকা সিটির ভেতরের এবং ২ জন ঢাকা সিটির বাইরের।
প্রতিবেদনে আরো জানানো হয়, গত সোমবার সকাল ৮টা থেকে মঙ্গলবার সকাল ৮টা পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে দেশের বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন দুই হাজার ৪১৮ জন। তাদের মধ্যে ঢাকার বাসিন্দা এক হাজার ১৬২ জন ও ঢাকার বাইরের এক হাজার ২৫৬ জন।
চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ২৫ জুলাই পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছেন ৩৭ হাজার ৬৮৮ জন। তাদের মধ্যে ঢাকার বাসিন্দা ২২ হাজার ৩৪৯ জন। ঢাকার বাইরের হাসপাতালগুলোতে ভর্তি হয়েছেন ১৫ হাজার ৩৩৯ জন। একই সময়ে হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র পেয়েছেন ২৯ হাজার ৫৬০ জন। তাদের মধ্যে ঢাকার বাসিন্দা ১৭ হাজার ৫৪১ জন এবং ঢাকার বাইরের ১২ হাজার ১৯ জন।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এডিস মশার লার্ভা নিধনে সফলতা না পাওয়ায় প্রাপ্তবয়স্ক মশার সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে। যতই বলা হোক নাগরিক, সিটি করপোরেশন এবং স্থানীয় দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রশাসন এ ব্যাপারে সচেতন নয়। ডেঙ্গু শুরু হলে আমরা কথা বলি। কিন্তু এডিস মশার প্রজনন ঠেকাতে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া হয় না। সবাই জানেন স্বচ্ছ ও বদ্ধ পানিতে এডিস মশার প্রজনন হয়। কিন্তু আগাম কোনো প্রস্তুতি থাকে না বলে ক্ষোভ প্রকাশ করেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানায়, ২০২৩ সালে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা যথাক্রমে জানুয়ারিতে ৫৬৬ জন ও ৬ জন, ফেব্রুয়ারিতে ১৬৬ জন ও ৩ জন, মার্চে আক্রান্ত ১১১ জন, এপ্রিলে ১৪৩ জন ও ২ জন, জুনে ৫ হাজার ৯৫৬ জন ও ৩৪ জন এবং জুলাইয়ের ২৫ দিনে ২৯ হাজার ৭১০ জন ও ১৫৪ জন। চলতি বছরে ২৫ জুলাই পর্যন্ত ডেঙ্গুতে মারা গেছেন মোট ২০১ জন ।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর আরো জানায়, ২০২২ সালে জানুয়ারিতে ১২৬, ফেব্রুয়ারিতে ২০ জন, মার্চে ২০ জন, এপ্রিলে ২৩ জন, মে মাসে ১৬৩ জন, জুনে ৭৩৭ জন, জুলাইয়ে ১ হাজার ৫৭১ জন, আগস্টে ৩ হাজার ৫৩১ জন, সেপ্টেম্বরে ৯ হাজার ৯১১ জন, অক্টোবরে ২১ হাজার ৯৩২ জন, নভেম্বরে ১৯ হাজার ৩৩৪ জন এবং ডিসেম্বরে ৫ হাজার ২৪ জন ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়েছে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন।
ওই বছরে দেশে ডেঙ্গুতে মোট ২৮১ জনের মৃত্যু হয়েছে। তাদের মধ্যে জুনে ১ জন, জুলাইয়ে ৯ জন, আগস্টে ১১ জন, সেপ্টেম্বরে ৩৪ জন, অক্টোবরে ৮৬ জন, নভেম্বরে ১১৩ জন এবং ডিসেম্বরে ২৭ জন মারা গেছেন বলে জানিয়েছে অধিদপ্তর। তবে বেসরকারি পরিসংখ্যানে প্রকৃত ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা আরো বেশি হবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
রোগতত্ত, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) পরিচালক তাহমিনা শিরিন ভোরের আকাশকে বলেন, ডেঙ্গু ভাইরাসের চারটি ধরন রয়েছেÑ ডেন-১, ২, ৩ ও ৪। এবার এই চার ধরনের মধ্যে একাধিক ডেন সক্রিয় রয়েছে। বিভিন্ন হাসপাতাল থেকে সংগ্রহ করা ২০০ নমুনা পরীক্ষা করে দেখা গেছে, এ বছর ডেন-১ ও ৪-এ বেশি আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) অধ্যাপক আহমেদুল কবীর ভোরের আকাশকে বলেন, এ বছর ডেঙ্গু রোগীর অবস্থা হঠাৎ খারাপ হয়ে পড়ছে। ঢাকায় এডিস মশার ঘনত্ব যে হারে বেড়েছে, পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ হবে। ডেঙ্গুর তিনটি ধরন এখন সক্রিয় রয়েছে। এবার গরমের পরিমাণ অনেক বেশি। ফলে মশা দ্রুত বংশবিস্তার করছে। এসব কিছু মাথায় রেখে ডেঙ্গু চিকিৎসার নির্দেশনা হালনাগাদ করা হয়েছে। নতুন নির্দেশিকা ব্যবহার করে ডেঙ্গু রোগী ব্যবস্থাপনার বিষয়ে চিকিৎসকদের বলা হয়েছে।
সাধারণ মানুষের সক্রিয় অংশগ্রহণ প্রয়োজন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এডিসবাহী রোগ নির্ণয় কর্মসূচির ডেপুটি প্রোগ্রাম ম্যানেজার ডা. মো. ইকরামুল হক বলেন, মশা নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে রোগী আরো অনেক বাড়বে। ডেঙ্গুবাহিত মশার উৎস শনাক্ত ও ধ্বংসের ক্ষেত্রে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরসহ প্রতিটি সংস্থার সম্মিলিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। একই সঙ্গে সাধারণ মানুষের সক্রিয় অংশগ্রহণের প্রয়োজন আছে জনসচেতনতা তৈরির জন্য ।
প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক, মেডিসিন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. এম আব্দুল্লাহ ভোরের আকাশকে বলেন, দেশের ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ে বেড়েছে উদ্বেগ। সব জেলায় ছড়িয়ে পড়েছে ডেঙ্গু রোগী। এটা ডেঙ্গুর মৌসুম। গত বছরও এই সময়ে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ছিল। এবার থেমে থেমে বৃষ্টি বেশি হওয়ায় এডিস মশাও বেশি। আক্রান্তও বেশি হচ্ছে। তবে শিশুদের মধ্যে আক্রান্তের হার বেশি।
তিনি বলেন, সচেতনতার অভাবেই প্রতি বছর এভাবে ডেঙ্গু হানা দেয়। শিশুদের এই সময়ে হাত-পা ঢাকা জামা কাপড় পরানো উচিত। তারা দিনে ঘুমালে মশারি টানিয়ে দেয়া উচিত। ডেঙ্গুর জন্য দায়ী এডিস মশা দিনে কামড়ায়। তখন অধিকাংশ শিশু স্কুলে থাকে। স্কুল থেকেও কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয় না। এখন করোনাও আছে। তাই করোনার টেস্ট করালে সঙ্গে ডেঙ্গুর টেস্টও করাতে হবে। জ্বর হলে অপেক্ষা না করে দ্রুত টেস্ট করালে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী দ্রুত শনাক্ত করা যায়। ফলে ঝুঁকি কমে যায়। আর জ্বর হলে নিজের চিকিৎসা নিজে না করে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। আমাদের ডেঙ্গু চিকিৎসায় কোনো সংকট নেই। তবে আবহাওয়া এবং সচেতনতার অভাবের কারণে ডেঙ্গু রোগী আরো বাড়বে বলে আশঙ্কা করছি অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ।
সরকারের রোগতত্ত, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা অধ্যাপক ডা. মুশতাক হোসেন ভোরের আকাশকে বলেন, দেশে ডেঙ্গু নতুন কোনো রোগ নয়। কিন্তু প্রাদুর্ভাবের সময় এবং মৃত্যুসংখ্যার বিবেচনায় দেশের ডেঙ্গু পরিস্থিতি যেন রেকর্ড ভেঙেছে।
তিনি আরো বলেন, বিগত বছরগুলোতে বছরজুড়ে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব দেখা যায়নি। জুন থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হওয়ার খবর পাওয়া যেত। কিন্তু এ বছর রেকর্ড সংখ্যক ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হচ্ছে, যা আমাদেরকে শঙ্কিত করে তুলেছে বলে জানান ডা. মুশতাক হোসেন।
হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগীদের শয্যা বাড়াতে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর নির্দেশ: দেশের সব সরকারি হাসপাতালে শয্যা বাড়াতে নির্দেশ দিয়েছেন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী জাহিদ মালেক। ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসা নির্বিঘ্নে করতে মঙ্গলবার দুপুরে স্বাস্থ্য বিভাগের সকল পর্যায়ের কর্মকর্তাদের নিয়ে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে তিনি এই নির্দেশনা দেন।
বৈঠকে তিনি রাজধানীর প্রত্যেক মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগীদের জন্য একশ থেকে দুইশ শয্যা বাড়াতে নির্দেশ দেন। একই সঙ্গে রাজধানীতে কমপক্ষে ১ হাজার ৫০০ শয্যা বাড়ানোর নির্দেশনা প্রদান করেন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সম্মেলন কক্ষ থেকে বৈঠকে অধিদপ্তরের সব পরিচালক, সব বিভাগীয় পরিচালক, সিভিল সার্জন, তত্ত্বাবধায়ক, উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কর্মকর্তারা সংযুক্ত ছিলেন। অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বৈঠকের সমন্বয় করেন।
বৈঠকে উপস্থিত একাধিক কর্মকর্তা ভোরের আকাশকে বলেন, শুরুতেই মন্ত্রী প্রধান প্রধান হাসপাতাল পরিচালকদের কাছ থেকে সামগ্রিক পরিস্থিতি সম্পর্কে অবগত হন। পরবর্তীতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে অন্তত ২০০ শয্যা, স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ও মিটফোর্ড হাসপাতালে একশ, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল একশ, কুর্মিটোলা ও কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালে অন্তত একশ করে শয্যা বাড়াতে নির্দেশ দিয়েছেন।
পাশাপাশি শ্যামলী ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট টিবি হাসপাতালকে ডেঙ্গু ডেডিকেটেড করা যায় কিনা সে বিষয়ে খোঁজ নিতে বলেছেন। এ ছাড়া ঢাকার বাইরে ডেঙ্গুর হটস্পট রাজশাহী, বরিশাল ও চট্টগ্রাম মেডিকেলে কলেজ হাসপাতালেও কমপক্ষে একশ শয্যা বাড়ানোর নির্দেশ দেন তিনি।
ভোরের আকাশ/নি