logo
আপডেট : ২৬ জুলাই, ২০২৩ ১০:৪৮
জবাবদিহির ভয়ে ব্যাংক ঋণে আগ্রহী উদ্যোক্তারা
মুস্তাফিজুর রহমান নাহিদ

জবাবদিহির ভয়ে ব্যাংক ঋণে আগ্রহী উদ্যোক্তারা

মুস্তাফিজুর রহমান নাহিদ: বর্তমানে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানির সংখ্যা ৩৫৬। অথচ আরজেএসসির তথ্যানুযায়ী, চলতি বছরের জুন পর্যন্ত নিবন্ধিত কোম্পানির সংখ্যা ২ লাখ ৮৩ হাজার ৩২১। এর মধ্যে পাবলিক লিমিটেড কোম্পানির সংখ্যা ৩ হাজার ৬৬ এবং প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানি ২ লাখ ৫ হাজার ৪৮৪। অর্থাৎ দেশে যে পরিমাণ কোম্পানি রয়েছে, সেই তুলনায় পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানির হাতেগোনা। ব্যাংক থেকে ঋণ সহজলভ্য হওয়ার কারণে এমনটি হয়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

 

তারা বলছেন, যৌথ মূলধন কোম্পানি ও ফার্মগুলোর পরিদপ্তর (আরজেএসসি) থেকে নিবন্ধন পাওয়া কোম্পানির সংখ্যা এবং দেশের অর্থনীতির আকার বিবেচনায় নিলে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানির সংখ্যা খুবই কম। এর মূল কারণ হলো উদ্যোক্তারা খুব সহজেই ব্যাংক থেকে দীর্ঘ মেয়াদে ঋণ পাচ্ছেন। ফলে ভালো উদ্যোক্তারা পুঁজিবাজারে আসতে খুব একটা আগ্রহী হচ্ছেন না। কারণ পুঁজিবাজারে এলে জবাবদিহির মধ্যে চলে আসতে হয় এবং অনেক নিয়মকানুন মেনে চলতে হয়।

 

এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, পুঁজিবাজার থেকে গত ১০ অর্থবছরে প্রায় কোটি টাকা তুলে নিয়েছেন উদ্যোক্তারা। ব্যবসা সম্প্রসারণ, ঋণ পরিশোধের পাশাপাশি বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে এ অর্থ ব্যয় করা হয়েছে। দেশের অর্থনীতির আকার ও নিবন্ধিত কোম্পানির সংখ্যা বিবেচনায় নিলে পুঁজিবাজার থেকে উদ্যোক্তাদের নেয়া এ অর্থের পরিমাণ খুবই কম বলছেন পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্টরা।

 

জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, পুঁজিবাজারে যে পরিমাণ কোম্পানি এসেছে, এ সংখ্যাটা অত্যন্ত নিম্নমানের। জিডিপির তুলনায় আমাদের মার্কেট ক্যাপিটালাইজেশন নেপালের তুলনায়ও কম। আমাদের দেশের কোম্পানিগুলোর অনীহা আছে পুঁজিবাজারে আসার ক্ষেত্রে। কারণ পুঁজিবাজারে এলে জবাবদিহি বেড়ে যায়। যাতে ভালো কোম্পানি পুঁজিবাজারে আসে, সেজন্য বিএসইসি ও মার্চেন্ট ব্যাংকগুলোকে ভূমিকা পালন করা দরকার। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোও পুঁজিবাজারে আনার চেষ্টা করতে হবে।

 

একই বিষয়ে জানতে চাইলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি ব্রোকারেজ হাউসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, কোনো কোম্পানি পুঁজিবাজারে এলে তাকে অনেক জবাবদিহি করতে হয়। সে কারণে কোম্পানি কর্তৃপক্ষ সবসময় এটা এড়িয়ে চলতে চান। তাছাড়া কাক্সিক্ষত কর ছাড় না পাওয়ার কারণে কোম্পানিগুলো পুঁজিবাজারে আসতে চাই না।

 

উদ্যোক্তাদের একটি অংশ আছে, যারা কোম্পানির মালিকানার ভাগ অন্যদের দিতে চান না। আবার কিছু উদ্যোক্তা আছেন ভ্যাট, ট্যাক্স কম দেয়ার জন্যও পুঁজিবাজারে আসতে চান না। সবকিছু বিবেচনায় নিয়েই ভালো কোম্পানি পুঁজিবাজারে আনার উদ্যোগ নিতে হবে। এক্ষেত্রে প্রয়োজন হলে প্রণোদনা দিতে হবে ভালো কোম্পানিগুলোকে। একই সঙ্গে নিয়মনীতিতে আনতে হবে কিছু পরিবর্তন।

 

তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০১৩-১৪ অর্থবছর থেকে ২০২২-২৩ অর্থবছর পর্যন্ত পুঁজিবাজার থেকে বিভিন্ন কোম্পানির উদ্যোক্তারা ১৫ হাজার ৫৪৭ কোটি ৬৬ লাখ ১৩ হাজার ৮১২ কোটি নিয়েছেন। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি নিয়েছেন ২০১৩-১৪ অর্থবছরে। ওই অর্থবছরে ১৬টি কোম্পানি প্রাথমিক গণপ্রস্তাবের (আইপিও) মাধ্যমে শেয়ার ছেড়ে ৭ হাজার ৫৫১ কোটি ৫৬ লাখ ৫৪ হাজার ৪০০ টাকা সংগ্রহ করে।

 

গত ১০ বছরের মধ্যে উদ্যোক্তারা পুঁজিবাজার থেকে সবচেয়ে কম অর্থ নেন ২০১৯-২০ অর্থবছরে। ওই অর্থবছরে মাত্র দুটি কোম্পানি শেয়ার এবং একটি কোম্পানি বন্ডের মাধ্যমে শেয়ারবাজার থেকে অর্থ সংগ্রহ করে। এ তিন প্রতিষ্ঠানের নেয়া অর্থের পরিমাণ ছিল ৩০৭ কোটি টাকা। দেশের পুঁজিবাজারে এক অর্থবছরে এত কম অর্থ আর উত্তোলন হয়নি।

 

ওই অর্থবছরে পুঁজিবাজার থেকে অর্থ উত্তোলন কম হওয়ার কারণ ছিল। ২০১৯ সালে বিভিন্ন মহল থেকে অভিযোগ ওঠে খায়রুল হোসেনের নেতৃত্বাধীন নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি একের পর এক দুর্বল কোম্পানির আইপিও অনুমোদন দিচ্ছে। ফলে সার্বিক পুঁজিবাজার ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি সমালোচনা হয় কপারটেক ইন্ডাস্ট্রিজের আইপিও অনুমোদন নিয়ে। একপর্যায়ে বড় ধরনের সমালোচনার মুখে পড়ে ২০১৯ সালের ৩০ এপ্রিল কমিশন সভা করে নতুন আইপিও না দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় বিএসইসি।

 

ওই সভায় সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (পাবলিক ইস্যু) রুলস ২০১৫ সংশোধন না হওয়া পর্যন্ত ৩০ এপ্রিল থেকে আইপিও সংক্রান্ত নতুন কোনো আবেদন গ্রহণ করা হবে না। অবশ্য ওই সিদ্ধান্তের আড়াই মাসের মধ্যে আইপিওতে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কোটা বাড়িয়ে পাবলিক ইস্যু রুলস ২০১৫-এর সংশোধন আনে বিএসইসি। এরপরও দীর্ঘসময় আইপিও দেয়া থেকে বিরত থাকে খায়রুল হোসেনের নেতৃত্বাধীন কমিশন। ফলে ২০২০ সালের প্রথম পাঁচ মাসও আইপিও শূন্য থাকে।

 

একসময় বাংলাদেশ সিকিউরিটি অ্যান্ড একচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) আইনে কোনো কোম্পানির পরিশোধিত মূলধনের পরিমাণ ৫০ কোটি টাকার বেশি হলেই পরবর্তী এক বছরের মধ্যে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্তির বাধ্যবাধকতা ছিল। তবে ২০১৯ সালে বিএসইসির আইন থেকে এ বিধান বাতিল করা হয়। এদিকে ২০২০ সালের মে মাসের শেষ দিকে অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল ইসলাম বিএসইসির চেয়ারম্যান হিসেবে যোগ দেয়ার পর আবার আইপিও মার্কেট সরগম হয়ে ওঠে। শিবলী রুবাইয়াত-উল ইসলাম নেতৃত্বাধীন কমিশন দায়িত্ব নেয়ার পর প্রথম অর্থবছরেই (২০২০-২১) ১৬টি প্রতিষ্ঠান আইপিওর মাধ্যমে ১ হাজার ৬১০ কোটি ৮৭ লাখ ২৩ হাজার ৪৫ টাকা উত্তোলন করে।
এরপর ২০২১-২২ অর্থবছরে আটটি কোম্পানি আইপিওতে শেয়ার ছেড়ে ৬৯৯ কোটি ৩৬ লাখ ৯ হাজার ৪০ টাকা সংগ্রহ করে। পাশাপাশি সুকুকের মাধ্যমে একটি প্রতিষ্ঠান ৪২৫ কোটি ৭ লাখ ৯৫ হাজার টাকা নেয়।

 

এছাড়া করপোরেট বন্ডের মাধ্যমে ৪ হাজার ৪৭৩ কোটি ৮০ লাখ ১৩ হাজার ৮০ টাকা সংগ্রহের অনুমোদন পায় ছয় প্রতিষ্ঠান। সর্বশেষ ২০২২-২৩ অর্থবছরে আইপিওর মাধ্যমে ছয়টি প্রতিষ্ঠান শেয়ার ছেড়ে পুঁজিবাজারের বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে ৬২১ কোটি ২৬ লাখ ১১ হাজার ৬০ টাকা নিয়েছে। এছাড়া বন্ডের মাধ্যমে তিনটি প্রতিষ্ঠান ৭২৫ কোটি টাকা সংগ্রহের অনুমোদন পায়। অর্থাৎ শিবলী রুবাইয়াত-উল ইসলাম নেতৃত্বাধীন কমিশন ২০২২-২৩ অর্থবছরে সবচেয়ে কম আইপিও অনুমোদন দিয়েছে।

 

এদিকে আইপিও নিয়ে বিতর্ক ওঠার আগে খায়রুল হোসেনের নেতৃত্বাধীন কমিশনের অধীনে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ১৩টি কোম্পানি এবং একটি মিউচুয়াল ফান্ড পুঁজিবাজার থেকে আইপিওর মাধ্যমে ৫৭১ কোটি ৬৭ টাকা নেয়। তার আগে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৯টি কোম্পানি ও দুটি মিউচুয়াল ফান্ড ৫৪১ কোটি ২৫ লাখ টাকা, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ছয়টি কোম্পানি ও তিনটি মিউচুয়াল ফান্ড ৩৯০ কোটি টাকা, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ৯টি কোম্পানি ও দুটি মিউচুয়াল ফান্ড ৮৫৮ কোটি ৩০ লাখ এবং ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ১৫টি কোম্পানি ও একটি মিউচুয়াল ফান্ড ১ হাজার ২৪৬ কোটি ৯৭ লাখ ২১ হাজার ২০০ টাকা উত্তোলন করে।

 

জানতে চাইলে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) পরিচালক মো. শাকিল রিজভী বলেন, আমাদের দেশের অর্থনীতির সঙ্গে তুলনা করলে গত ১০ বছরে পুঁজিবাজারে আসা কোম্পানির সংখ্যা বেশ কম। শেয়ারবাজারে এলে কোম্পানির জবাবদিহি বেড়ে যায়। একইসঙ্গে বেশকিছু নিয়মকানুন পরিপালন করতে হয়। আবার ব্যাংকে গেলে খুব সহজেই দীর্ঘমেয়াদি ঋণ পেয়ে যাচ্ছে কোম্পানিগুলো। সবকিছু মিলেই তালিকাভুক্ত কোম্পানির সংখ্যা কম।

 

তিনি বলেন, ব্যাংক থেকে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ দেয়ার কারণে খেলাপি ঋণের পরিমাণও বেশি। প্রতিষ্ঠানগুলো যাতে দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়নের ক্ষেত্রে ব্যাংকে না গিয়ে পুঁজিবাজারে আসে, সেজন্য সার্বিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে নিয়মনীতি পরিবর্তন করা উচিত।

 

একই বিষয়ে বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মোহাম্মদ রেজাউল করিম বলেন, পুঁজিবাজারে কোম্পানি আনার দায়িত্ব পালন করে মার্চেন্ট ব্যাংক ও ইস্যু ম্যানেজাররা। কমিশনের কাজ অনুমোদন দেয়া। ভালো কোম্পানি পুঁজিবাজারে আনার জন্য কমিশন খুবই আন্তরিক।

 

ভোরের আকাশ/নি