logo
আপডেট : ২৬ জুলাই, ২০২৩ ২০:১৯
পুলিশের অভিযানে কিশোরীর রহস্যজনক মৃত্যু
সেই রাতে পল্লবীতে কী ঘটেছিল?
ইমরান খান

সেই রাতে পল্লবীতে কী ঘটেছিল?

ইমরান খান: রাজধানীর পল্লবীতে পুলিশের অভিযানের সময় বৈশাখী নামে ১৭ বছরের এক কিশোরীর মৃত্যু নিয়ে ধূম্রজাল তৈরি হয়েছে। কেউ বলছেন পুলিশের প্ররোচনায় ওই কিশোরী আত্মহত্যা করেছে। আবার কেউ বলছেন অভিযানে ওই কিশোরীর মা লাভলিকে বিবস্ত্র করে নির্যাতনের প্রতিবাদে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেছে বৈশাখী। অন্যদিকে পুলিশ বলছে, মা লাভলির গ্রেপ্তার এড়াতে পুলিশকে ভয় দেখাতে গিয়েই আত্মহত্যা করেছে ওই কিশোরী।

 

জানা গেছে, গত সোমবার রাতে মিরপুর ১১ নম্বরের আদর্শ নগর এলাকার ১১ নম্বর রোডের ২১ নম্বর বাড়িতে মাদকবিরোধী অভিযান চালায় পুলিশ। এ সময় মাদক উদ্ধারের অভিযোগে নিহত বৈশাখীর মা লাভলিকে আটক করার সময় কিশোরীর রহস্যজনক মৃত্যু হয়। এ ঘটনার পর লাভলিকে বিবস্ত্র করে নির্যাতন ও তার মেয়ে বৈশাখীর আত্মহত্যায় প্ররোচনার অভিযোগ এনে বাড়িটিতে অভিযানরত এসআই জহির ও এএসআই ফেরদৌসকে আটক করে মারধর করেন স্থানীয়রা। এ নিয়ে পুলিশের সঙ্গে স্থানীয়দের ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। পরে এসআই জহির ও এএসআই ফেরদৌসকে উদ্ধার করে পুলিশ। সেই দিন রাত আটটা থেকে ভোর চারটা পর্যন্ত মিরপুর ১১ নম্বরের আদর্শ নগর এলাকায় থমথমে অবস্থা বিরাজ করছিল। এই ঘটনার পর ওই এলাকার স্থানীয়রা প্রায় ১০টি গাড়ি-মোটরসাইকেল ভাঙচুর করে।

 

নিহত কিশোরী বৈশাখীর মা লাভলি অভিযোগ করে বলেন, সোমবার সন্ধ্যায় পল্লবী থানার উপপরিদর্শক (এসআই) জহির তার কয়েকজন সোর্স ও এক নারী কনস্টেবলসহ আমাদের বাসায় মাদক আছে বলে অভিযান চালায়। কিন্তু তারা কোনো মাদক পায়নি। এক পর্যায়ে তারা আমার কাছে ৫ লাখ টাকা দাবি করে। সেই টাকা দিতে রাজি না হলে তারা আমাকে ধরে নিয়ে যেতে চায়। তখন আমার মেয়ে বৈশাখী আক্তার (১৬) এসে বাধা দেয়। কিন্তু এরপরেও তারা আমাকে নিয়ে যেতে চায়। তখন আমাকে তারা পাশের বাসায় আটকে রাখে। কিছুক্ষণ পর শুনতে পাই যে, তারা বলছে আমার মেয়ে আত্মহত্যা করেছে। পরে আমাদের বাসার নিচতলার রুমে গিয়ে দেখতে পাই আমার মেয়ের মরদেহ ঝুলছে।

 

বৈশাখীর ভাই আতাউর রহমান আকাশ বলেন, রড দিয়ে তিন তলার রুমের দরজার তালা ভেঙেছে পুলিশ। পরে তারা বৈশাখীকে ওই রুমে ঢুকাইছে। আমি মানুষের কাছে শুনে বাসায় এসে জানালা দিয়ে দেখি বৈশাখী ফাঁসি দিছে। তখন আমি চিৎকার দিছি। তিনি জানান, মাদক কারবারের জন্য এক বছর আগে গ্রেপ্তার হইছিল তার মা লাভলি।

 

ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ও বৈশাখীর ১১ বছর বয়সি ছোটবোন ফাতেমা বলে, সোর্সরা পুলিশ নিয়ে আসে। তখন বাসার মেইন গেটে তালা ছিল। পুলিশ সেটা খুলতে বলে, না হলে ভেঙে ফেলবে। এজন্য আমার নানি গেট খুলে দেয়। তখন পুলিশের এসআই ফেরদৌস, জহির ও তাদের সোর্সরা বাসায় ঢুকেছিল। আমার মা, বোন চারতলায় ছিল। তারা বৈশাখীকে তিন তলায় নিয়ে আসে। তখন সিঁড়িতে থাপ্পড়, লাথি ও ঘুষিও দেয়। পরে রুমের মধ্যে তাকে আটকিয়ে বাইরে থেকে তালা দিয়ে দেয়। তখন আমার বোন বলছিল আপনি যদি দরজা না খোলেন তাহলে আমি ফাঁসি দিমু। এটা আমি ৪ তলায় গিয়ে আমার আম্মুরে বলতে যাই। তখন দেখি সোর্সরা আমার আম্মুর সঙ্গে জোরাজুরি করছে। তখন জহির আবার ৪ তলায় আসে। আমি তাকে জিজ্ঞেস করি আমার বোন কই। সে বলে তোর বোনকে রাখছি জায়গামতো। ফাতেমা বলে, জহির জোর করে মাকে নিচে নামায়। সোর্সরা জোরাজুরি করে আমার আম্মুর জামাকাপড় ছিঁড়ে ফেলে। আম্মু তখন লজ্জায় দৌড়ে পাশে নানুর বাসায় যায়। তখন ফেরদৌস দৌড়ে এসে বলছে বৈশাখী ফাঁসি দিছে। তিনতলায় ফেরদৌসের সামনেই ফাঁসি দিছে। জানালা দিয়া দেখলাম লাশ ঝুলছিল। ফেরদৌস একা ছিল বাইরে। সে তালা খুলে নাই। আমার বোন বলছিল, তালা খুলে দেন নইলে আমি ফাঁসি দিমু। তারপরও জহির তালা খুলে নাই।

 

এই বিষয়ে পল্লবী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বা সংশ্লিষ্ট কেউ কথা বলতে রাজি হননি। তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক থানার একজন উপপরিদর্শক বলেছেন, পল্লবীর আদর্শ নগরের ২১ নম্বরের এক বাসায় মাদক উদ্ধারে যায় পল্লবী থানা পুলিশ। চোরাকারবারের অভিযোগে অভিযান চালিয়ে মাদকসহ লাভলি নামে এক নারীকে আটক করা হয়। লাভলি মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। পুলিশ তাদের বাসায় অভিযানে গেলে বাধা দেয়ার জন্য বৈশাখী আত্মহত্যার হুমকি দেয়। পুলিশের হাত থেকে মাকে ছাড়িয়ে নিতে একপর্যায়ে বাসার ভেতর ওই কিশোরী আত্মহত্যা করে। এমনকি আত্মহত্যা করা কিশোরী বৈশাখীর নামেও মাদক মামলা রয়েছে।

 

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মিরপুর ১১ নম্বরের আদর্শ নগর এলাকার ১১ নম্বর রোডের ২১ নম্বর বাড়িটির মালিক লাভলি। লাভলি ও তার দুই মেয়ের বিরুদ্ধে একাধিক মাদক মামলা রয়েছে। একাধিকবার পুলিশের হাতে মাদকসহ গ্রেপ্তার হয়েছে তারা। আত্মহত্যা করা কিশোরী বৈশাখীর নামেও মাদকের চারটি মামলা রয়েছে। এসব কারণেই প্রায়ই তাদের বাসায় পুলিশ অভিযান চালাত।

 

এদিকে অভিযানের সময়ে পুলিশ সদস্যদের মোবাইলে ধারণ করা একাধিক ভিডিও ফুটেজ এসেছে দৈনিক ভোরের আকাশের হাতে। সেই ভিডিওগুলোতে দেখা গেছে, লাভলির বাসা থেকে ২ কেজি ১০০ গ্রাম গাঁজা ও ৪০০ পিস ইয়াবা উদ্ধার করা হয়। এ সময় লাভলিকে আটক করা হলে সে অজ্ঞান হয়ে পড়ে। সেখানে লাভলির দুই মেয়ে চাঁদনি ও বৈশাখীও ছিল। তখন চাঁদনি পুলিশকে বলতে থাকে ‘স্যার মাল তো পাইসেন কিন্তু ওতো না। আমার মা স্টকের রোগী তাকে ছাড় দেন স্যার।’ এরপর চাঁদনিকে ওই রুম থেকে বের হয়ে সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠতে দেখা যায়। এরপরই শোনা যায় সে আত্মহত্যা করেছে। অন্য একটি ভিডিওতে পল্লবী থানার এসআই জহিরসহ স্থানীয়দের একটি দরজা ভাঙার চেষ্টা করতে দেখা গেছে।

 

পল্লবী জোনের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (এডিসি) নাজমুল হাসান ফিরোজ বলেন, এই ঘটনায় পুলিশের দায় আছে কিনা তা তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। তিনি আরো বলেন, লাভলির বিরুদ্ধে সাতটি এবং বৈশাখীর বিরুদ্ধে চারটি মাদকের মামলা আছে। এরা পুরো পরিবারটিই মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। ওই দিন অভিযানের ঘটনায় আমাদের কাছে ভিডিও ফুটেজ রয়েছে। তাদের ঘরে ইয়াবা ও গাঁজা পাওয়া গেছে।

 

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ডিএমপির মিরপুর বিভাগের উপ-কমিশনার জসীম উদ্দীন মোল্লা বলেন, তদন্তের জন্য ৪ সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্তের পর বিস্তারিত জানাবো।

 

ভোরের আকাশ/আসা