logo
আপডেট : ২ আগস্ট, ২০২৩ ১০:২৭
প্রকল্পের কাজ শেষ হলেও বিশ হাজার গাড়ির হদিস নেই
মোতাহার হোসেন

প্রকল্পের কাজ শেষ হলেও বিশ হাজার গাড়ির হদিস নেই

মোতাহার হোসেন: প্রকল্প শেষ হলেও প্রকল্পের কাজে ব্যবহৃত গাড়িগুলো বুঝে পাচ্ছে না সরকার। নিয়মানুযায়ী, প্রকল্প সমাপ্তির পর প্রকল্পের কাজে ব্যবহৃত গাড়ি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন পরিবহন পুলে জমা দিতে হয়। বাস্তবে প্রকল্পের কাজ শেষ হয়েছে দুই বছর আগে, কিন্তু এসব প্রকল্পের গাড়ি এখনো বুঝে পায়নি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। এমনকি এ-সংক্রান্ত হালনাগাদ কোনো তথ্যও জানানো হয়নি যানবাহন অধিদপ্তরকে। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের।

 

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের একটি দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, ৫৮টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগের আওতাধীন ২৫টি সংস্থা থেকে সমাপ্ত প্রকল্পের যানবাহনের তথ্য দেয়া হয়েছিল। তাতে গাড়ির সংখ্যা ছিল প্রায় ৯ হাজার। বাকি মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলো প্রকল্পের যানবাহনের তথ্য দেয়নি। এজন্য আবারো সমাপ্ত প্রকল্পের গাড়ির তথ্য চেয়েছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ যানবাহন অধিদপ্তর।

 

যানবাহন অধিদপ্তরের পরিবহন কমিশনার (অতিরিক্ত সচিব) আবুল হাছানাত হুমায়ুন কবীর মঙ্গলবার দৈনিক ভোরের আকাশকে জানান, বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের কাছে সমাপ্ত প্রকল্পের মোট গাড়ির সংখ্যা কত হতে পারে, সে তথ্য তাদের জানা নেই। তবে সমাপ্ত প্রকল্পগুলোর যানবাহনের সংখ্যা ২০ হাজারের মতো হতে পারে বলে পরিবহন পুলের একাধিক কর্মকর্তা জানান।

 

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ২০০৬ সাল থেকে ‘সমাপ্ত উন্নয়ন’ প্রকল্পের সব যানবাহনের তথ্য চাওয়া হয়েছে। সরকারি যানবাহন অধিদপ্তরের ‘পরিবহন পুল’ শাখার চাহিদার ভিত্তিতে সম্প্রতি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগের কাছে এ তথ্য চাওয়া হয়েছে। এর আগেও বিভিন্ন সময়ে এ তথ্য চাওয়া হয়েছিল; তবে অনেক মন্ত্রণালয় ও বিভাগ প্রকল্পভুক্ত গাড়ির তথ্য প্রদানে নানা অজুহাত তুলে প্রয়োজনীয় তথ্য ও প্রকল্পে ব্যবহৃত গাড়ি ফেরতে অনীহা প্রকাশ করছে।

 

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের পরিবহন শাখা থেকে সম্প্রতি ‘সমাপ্ত উন্নয়ন প্রকল্পের যানবাহন সরকারি যানবাহন অধিদপ্তরের অধীনে কেন্দ্রীয় পরিবহন পুলে জমাকরণ’ শীর্ষক নির্দেশনা জারি করা হয়। এর আগে গত ৩০ জানুয়ারি এবং গত বছরের ২১ ডিসেম্বর সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগের কাছে যানবাহনের তথ্য চেয়ে চিঠি দেয় পরিবহন পুল। ২০২১ সালেও সমাপ্ত প্রকল্পের গাড়ি জমা দেয়ার জন্য একাধিবার তাগিদপত্র দেয়া হয়েছিল। কিন্তু অনেক মন্ত্রণালয় ও বিভাগ এ-সংক্রান্ত হালনাগাদ তথ্য দিচ্ছে না।

 

জানতে চাইলে সরকারি যানবাহন অধিদপ্তরের পরিবহন এক কর্মকর্তা জানান, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে দেশে সরকারিভাবে নতুন করে আর গাড়ি কেনা হচ্ছে না। প্রশাসনিক প্রয়োজনে তবে গাড়ির চাহিদা আছে। এজন্য সমাপ্ত প্রকল্পের গাড়ির তথ্য চাওয়া হয়েছে। সমাপ্ত প্রকল্পের সচল গাড়ি পেলে সেগুলো চাহিদা অনুযায়ী নতুন কর্মকর্তাদের দেয়া যাবে।

 

যেকোনো প্রকল্প সমাপ্ত হওয়ার ৬০ দিনের মধ্যে প্রকল্পের সব গাড়ি ‘পরিবহন পুলে’ জমা দেয়ার বিধান রয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘অন্যান্য মালামালও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে বুঝিয়ে দেয়ার নিয়ম রয়েছে। আমাদের কাছে যদি গাড়ি বুঝিয়ে না দেয় আমরা জোর করে কাউকে আইন মানাতে পারি না। আমাদের সেই শক্তি নেই। কারণ প্রকল্পগুলো মনিটরিং করে আইএমইডি।’

 

সর্বশেষ চিঠিতে সরকারি যানবাহন অধিদপ্তরের অধীন কেন্দ্রীয় পরিবহন পুলে ‘জমাকরণ, ব্যবহার ও নিষ্পত্তি সম্পর্কিত’ বিষয়ে ২০০৬ সালের পরিপত্রের আলোকে গাড়ির তথ্য পাওয়া হয়েছে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনায় বলা হয়, ‘সমাপ্তকৃত সকল উন্নয়ন প্রকল্পের যানবাহন সরকারি যানবাহন অধিদপ্তরে জমা প্রদানের কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ এবং সংযুক্ত ছক মোতাবেক মন্ত্রণালয়ভিত্তিক টিওঅ্যান্ডই (সাংগঠনিক কাঠামো)বহিভর্‚ত/টিওঅ্যান্ডভুক্ত যানবাহনের তথ্যাটি প্রেরণের জন্য অনুরোধ করা হয়।’

 

পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় থেকে জানা গেছে, বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের অধীনে বর্তমানে সরকারের ১ হাজার ৩৬৩টি প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে। এর মধ্যে আগামী জুনের মধ্যে অন্তত তিন শতাদিক প্রকল্পের বাস্তবায়ন শেষ হচ্ছে বা অর্থায়ন বন্ধের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এসব প্রকল্পের অনেকগুলোর মেয়াদ কয়েক দফা বৃদ্ধি করা হলেও বাস্তবায়ন এগুচ্ছে না। কিন্তু প্রকল্পগুলির অধীনে ৫/৭টি বা এরও বেশি যানবাহন থাকায় নানাভাবে প্রকল্পগুলি ঠিকিয়ে রাখা হয়েছে। এতে সরকারের বিপুল অঙ্কের টাকা অপচয় হচ্ছে।

 

এ বিষয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা জানান, বারবার চিঠি দেয়ার পরও প্রকল্পের গাড়ি সংক্রান্ত বিস্তারিত তথ্য সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগ থেকে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে আসছে না। এসব গাড়ি কারা, কোথায় ও কীভাবে ব্যবহার করছেন, তা তাদের জানা নেই।

 

যানবাহন অধিদপ্তর সূত্র জানায়, সরকারের ৫৮টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগ রয়েছে। এগুলোর অধীনে ৩৫৩টি অধিদপ্তর ও অন্যান্য সংস্থা রয়েছে। অর্ধেকেরও কম মন্ত্রণালয় ও বিভাগ থেকে গত বছরের মাঝামাঝি সময়ে পরিবহন পুলে সমাপ্ত প্রকল্পের যানবাহনের তথ্য দেয়া হয়েছিল। তাতে মোট গাড়ির সংখ্যা দাঁড়ায় ৯ হাজারের কাছাকাছি।

 

এগুলোর মধ্যে প্রায় অর্ধেকেরই বেশি ছিল মোটরসাইকেল। অন্যান্য গাড়ির মধ্যে জিপ, কার ও মাইক্রোবাস ছিল। সমাপ্ত প্রকল্পের সবচেয়ে বেশি গাড়ির ব্যবহার হচ্ছে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগ (এলজিইডি), গণপূর্ত প্রকৌশল অধিদপ্তর, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের (ইইডি) অধীনে। এসব সংস্থা যেসব মন্ত্রণালয় ও বিভাগের অধীনস্থ সেখানকার কর্মকর্তারাই বেশিরভাগ গাড়ি ব্যবহার করছেন।

 

বিদ্যমান নিয়মানুযায়ী, প্রকল্প শেষ হওয়ার দুই মাসের মধ্যে সব সচল গাড়ি কেন্দ্রীয় পরিবহন পুলে জমা দিতে হয়। নির্ধারিত ৬০ দিনের মধ্যে যানবাহন জমা না হলে যানবাহন অধিদপ্তর বিষয়টির জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে জানাবে। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের প্রকল্প শেষ হওয়ার সর্বোচ্চ ছয় মাসের মধ্যে অচল যানবাহন নীতিমালা অনুযায়ী বিক্রি করে অর্থ সরকারের সংশ্লিষ্ট খাতে জমা দিয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়, পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি) এবং যানবাহন অধিদপ্তরকে জানাতে হবে। অনেকেই এ নিয়ম মানা হচ্ছে না।

 

সূত্র জানায়, সমাপ্ত প্রকল্পের বিপুলসংখ্যক গাড়ি ‘অবৈধভাবে’ বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগ ব্যবহারের একশ্রেণির কর্মকর্তা-কর্মচারী। এতে জ্বালানি তেল খরচ বাবদ সরকারের মোটা অঙ্কের অর্থ অপচয় হচ্ছে। সরকার উপসচিব থেকে ওপরের স্তরের সব কর্মকর্তাকে গাড়ি কেনার জন্য বিনা সুদে সর্বোচ্চ ৩০ লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণ দিচ্ছে। একইসঙ্গে এসব গাড়ির জ্বালানি ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য কর্মকর্তাদের মাসে ৫০ হাজার করে টাকা খরচও দেয়া হচ্ছে।

 

এ সুবিধা ভোগ করেও কোনো কোনো কর্মকর্তা প্রকল্পের গাড়িও ব্যবহার করছেন। সংশ্লিষ্ট শীর্ষ কর্মকর্তা ও ব্যক্তি বা তাদের অধীনস্থরাই নানাভাবে গাড়ির সুবিধা নিচ্ছেন। এ ধরনের অনিয়মের কারণে প্রাধিকারভুক্ত হয়েও কোনো কোনো কর্মকর্তা যাতায়াতের সরকারি গাড়ির সুবিধাই পাচ্ছেন না। দীর্ঘদিন ধরেই এ-সংক্রান্ত অভিযোগ থাকলেও এর সুরাহা মিলছে না।

 

নিয়মানুযায়ী, কোনো সরকারি প্রকল্প শেষ হওয়ার ৯০ দিন আগে প্রকল্প পরিচালক (পিডি) প্রকল্পের শ্রেণিভিত্তিক যানবাহনের সংখ্যা, অবস্থান এবং বর্তমান অবস্থা (সচল/অচল) বিস্তারিত উল্লেখ করে একটি পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন আইএমইডির কাছে দাখিল করতে হয়। এরপর এর অনুলিপি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ও যানবাহন অধিদপ্তরে পাঠাবে। প্রকল্প শেষে নির্ধারিত সময়ে প্রকল্পের যানবাহন কেন্দ্রীয় পরিবহন পুলে জমা না দিলে সংশ্লিষ্ট অধিদপ্তর, সংস্থা বা মন্ত্রণালয় পিডির বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেবে। এক্ষেত্রে অন্য কেউ দায়ী হলে তার বিরুদ্ধেও আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়ার পরিপত্র রয়েছে।

 

২০২০ সালের ‘প্রাধিকারপ্রাপ্ত’ সরকারি কর্মকর্তাদের সুদমুক্ত ঋণ এবং গাড়ি সেবা নগদায়ন নীতিমালা অনুযায়ী, ঋণের টাকায় গাড়ি কিনলে অধিদপ্তরের গাড়ি ব্যবহারের সুবিধা বাতিল হয়ে যাবে। এ বিষয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় বেশ কয়েক দফা চিঠি দিয়ে সব মন্ত্রণালয়কে সতর্ক করেছে।

 

১০০ শতাংশ রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় গ্রহণের ক্ষেত্রে সুদমুক্ত ঋণের অর্থে কেনা গাড়ি অফিসের কাজে ব্যবহার করতে হবে। কোনোভাবেই মন্ত্রণালয়, বিভাগ, দপ্তর, সংস্থা ও উন্নয়ন প্রকল্পের যানবাহন ব্যবহার করা যাবে না বলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সতর্ক করেছে। কিন্তু পরিস্থিতির তেমন উন্নতি ঘটেনি বলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা।

 

পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) ১ হাজার ৩৬৩টি প্রকল্প আছে। করোনা মহামারি এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে সরকারের প্রকল্পেও এর প্রভাব পরেছে। অর্থনৈতিক চাপের কারণে গত বছর এ প্রকল্পগুলোকে ‘এ’, ‘বি’ এবং ‘সি’ শ্রেণিতে ভাগ করা হয়। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে করা এ তালিকায় ‘এ’ শ্রেণির প্রকল্পকে সবচেয়ে বেশি অগ্রাধিকার হিসেবে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। গুরুত্ব বিবেচনায় এসব প্রকল্পে চলতি অর্থবছরে এডিপিতে যা বরাদ্দ আছে, তা পুরোটাই ব্যয় করা হবে।

 

‘বি’ শ্রেণির প্রকল্পগুলোয় বরাদ্দ (দেশজ উৎসের অর্থ) ২৫ শতাংশ কমানো হয়েছে। আর ‘সি’ শ্রেণির প্রকল্পগুলোকে নামমাত্র বরাদ্দ দিয়ে ঠিকিয়ে রাখা হয়েছে। পরবর্তী সময়ে গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা বিবেচনায় নিয়ে ‘বি’ শ্রেণির অনেক প্রকল্পকে ‘সি’ শ্রেণিতে ফেলা হয়েছে। এ গত বছরের ডিসেম্বর নাগাদ ৬৪৬টি প্রকল্প ‘এ’ শ্রেণিতে; ৬৩৬টি প্রকল্প ‘বি’ শ্রেণিতে এবং ৮১টি প্রকল্প ‘সি’ শ্রেণিতে রাখা হয়।

 

এগুলোর বাইরেও এডিপিতে ৯টি প্রকল্প রয়েছে, যেগুলোকে কোনো শ্রেণিতে রাখা হয়নি। এগুলোর মধ্যে ‘বি’ ও ‘সি’ শ্রেণির তিন শতাধিক প্রকল্পের সমাপ্ত হচ্ছে হয়েছে। জুনের মধ্যে।

 

ভোরের আকাশ/নি