স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, চলতি বছর জুনে যেসংখ্যক মানুষ ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হয়েছিল, তার চেয়ে সাতগুণ বেশি আক্রান্ত হয়েছে জুলাইয়ে। তবে সবচেয়ে ভয়ংকর খবর হলো ডেঙ্গুর পিকটাইম ধরা হয় আগস্ট মাসকে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আগস্টে দেশে ডেঙ্গু পরিস্থিতি আরো খারাপ হতে পারে। এ মাসই হতে পারে চলতি বছরের ‘পিক সিজন’।
এদিকে আগস্টের শুরুতে মঙ্গলবার দেশে এক দিনে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন আরো ২ হাজার ৫৮৪ জন। তাদের মধ্যে ১ হাজার ৪৫৩ রোগীই ঢাকার বাইরের। আর ঢাকায় ভর্তি হয়েছেন ১১৩১ রোগী। নতুন আক্রান্তদের নিয়ে এ বছর ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫৪ হাজার ৪১৬ জনে।
মশাবাহিত এ রোগে এক দিনে আরো ১০ জনের মৃত্যু হয়েছে। এতে এ বছর ডেঙ্গু আক্রান্ত মোট ২৬১ জনের মৃত্যু হলো। দেশে এর আগে শুধু ২০১৯ এবং ২০২২ সালে এর চেয়ে বেশি রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল। আর ২০২২ সালে ২৮১ জনের মৃত্যু হয়েছিল ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে, যা এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ।
তবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরও আশঙ্কা করছেন আগস্টে ভর্তি রোগী ও মৃত্যুর এ সংখ্যা আরো বাড়তে পারে। তারা জানায় মঙ্গলবার পর্যন্ত সারা দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ৯ হাজার ২৬৪ ডেঙ্গু রোগী ভর্তি আছে। তাদের মধ্যে ঢাকায় ৪ হাজার ৮৬৯ জন এবং ঢাকার বাইরের বিভিন্ন জেলায় ৪ হাজার ৩৯৫ জন। তারা জানায় এ বছর ডেঙ্গুর প্রকোপ দ্রুত বাড়ছে।
জুন মাসে যেখানে ৫ হাজার ৯৫৬ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন, জুলাই মাসে ভর্তি হয়েছেন ৪৩ হাজার ৮৫৪ রোগী। জুন মাসে ৩৪ জনের মৃত্যু হলেও জুলাই মাসে প্রাণ যায় ২০৪ জনের। এছাড়া মাসের হিসাবে জানুয়ারিতে ৫৬৬, ফেব্রুয়ারিতে ১৬৬, মার্চে ১১১, এপ্রিলে ১৪৩, মে মাসে ১ হাজার ৩৬ এবং জুনে ৫ হাজার ৯৫৬ রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। তাদের মধ্যে থেকে জানুয়ারিতে ছয়, ফেব্রুয়ারিতে তিন, এপ্রিলে ও মে মাসে দুজন করে এবং জুনে ৩৪ জনের মৃত্যু হয়েছে।
এ বছর এডিস মশা শনাক্তে চালানো জরিপে ঢাকায় মশার যে উপস্থিতি দেখা গেছে, তাকে ঝুঁকিপূর্ণ বলছেন বিশেষজ্ঞরা। এ অবস্থায় সামনে ডেঙ্গুর প্রকোপ আরো বাড়ার আশঙ্কা করেছেন তারা। ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে এ বছর যাদের মৃত্যু হয়েছে, তাদের প্রায় সবাই ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভারে ভুগছিলেন এবং শক সিনড্রোমে মারা গেছেন। এডিস মশাবাহিত এ রোগে আক্রান্ত হয়ে গত বছর ৬২ হাজার ৩৮২ রোগী হাসপাতালে ভর্তি হন। তাদের মধ্যে রেকর্ড ২৮১ জনের মৃত্যু হয়। এর আগে ২০১৯ সালে দেশের ৬৪ জেলায় ১ লাখের বেশি মানুষ ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে গিয়েছিলেন, যা এ যাবৎকালের সর্বোচ্চ। সরকারি হিসাবে সে বছর মৃত্যু হয়েছিল ১৭৯ জনের।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশে ডেঙ্গু রোগের মৌসুম ধরা হয় মে থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোয় ডেঙ্গু সারা বছরব্যাপী হচ্ছে। এর মধ্যে আক্রান্তের গ্রাফ সবচেয়ে ওপরের দিকে থাকে জুলাই ও অগাস্ট মাসে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মুখপাত্র অধ্যাপক রোবেদ আমিন বলেছেন, আগস্ট মাসে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়তে থাকবে বলে তাদের অনুমান।
যত বৃষ্টিপাত হবে, গরম বেশি পড়বে, যত আর্দ্রতা বাড়বে যত বেশি অপরিকল্পিত নগরায়ন হবে, তত বেশি ডেঙ্গুবাহী এডিস মশার সংখ্যা বাড়তে থাকবে। এডিসের জন্য আমরা সারা বছর একটা অনুকূল পরিবেশ তৈরি করেছি।
চলতি বছরের আগস্টেও পরিস্থিতি বিরূপ আকার ধারণ করতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, এ বছরের শুরু থেকেই ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব বেশি এবং এ পর্যন্ত রেকর্ডসংখ্যক ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়েছে। গত ৫ বছরে ডেঙ্গু রোগীর পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে বলেন ডেঙ্গুতে চলতি বছরের জুলাই পর্যন্ত যত মানুষ রোগী মারা গেছে, তা এর আগে কোনো বছরের প্রথম ছয় মাসে হয়নি। এ বছর দেশের ৬৪টি জেলায় ডেঙ্গু ছড়িয়েছে। এর আগে শুধু ২০১৯ সালে সারা দেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী পাওয়া গিয়েছিল।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক কীটতত্ত¡বিদ অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার বলেন, বর্তমানের ডেঙ্গু পরিস্থিতি আগস্ট মাসে আরো ভয়াবহ হবে এবং সেটাই হতে পারে ‘পিক সিজন’। ডেঙ্গুর ভাইরাস বহনকারী এডিস মশার ধরন ও বৈশিষ্ট্য বদলানোর কারণে এদের প্রকৃতিতে মানিয়ে নেয়ার ক্ষমতা এখন আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে।
তিনি বলেন, আগে যেখানে এ মশা শুধু দিনের বেলায় কামড়াত, এখন এটি দিনে রাতে দুই বেলায় কামড়ায়। আগে যেখানে মশাটি স্বচ্ছ পানিতে বংশবিস্তার করত, বর্তমানে ময়লা পানিতেও এর অস্তিত্ব পাওয়া গিয়েছে। বাইরের কৃত্রিম আলোয় সক্রিয় থাকায় এ মশা লম্বা সময় ধরে ডেঙ্গু সংক্রমণ করে যেতে পারছে। তিনি বলেন, জলবায়ু পরিবর্তন, বর্ষা দেরিতে শুরু হওয়ায় ডেঙ্গু মৌসুম দীর্ঘায়িত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
এছাড়া বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আগস্টে বৃষ্টি সিজন থাকে পুরোপুরি, এ সময় এডিস মশা তার বংশ বিস্তারের জন্য সবচেয়ে উপযোগী পরিবেশ পায়। তাছাড়া বছরের এ সময়ে নির্মাণ কাজ বেড়ে যায়। পানির ব্যবহার বাড়ে। সেখানেও মশা বিস্তার লাভ করে। গত বছর বাংলাদেশে ডেঙ্গুর পিক সিজন ছিল অক্টোবর ও নভেম্বরে এবং এ বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত রোগ শনাক্ত হয়েছে। এমনটা আগে কখনো হয়নি।
সেক্ষেত্রে আগস্ট থেকে সামনের চার মাসই ডেঙ্গু বিস্তারের জন্য আশঙ্কার বলে শঙ্কা প্রকাশ করেন তারা। দেশে প্রথম ডেঙ্গু সংক্রমণ দেখা গিয়েছিল ১৯৬৪ সালে ঢাকায়। পরে ২০০০ সালে সাড়ে ৫ হাজার ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়, মৃত্যু হয় ৯৩ জনের।
ওই বছর সরকার দেশে প্রথম ডেঙ্গুকে রোগতত্ত্বের জায়গায় গুরুত্ব দেয়া হয় বলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এবং রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের থেকে জানা গিয়েছে। সে হিসাবে গত ২৩ বছরে (২০২৩ সালের জুলাই পর্যন্ত) বাংলাদেশে ৩ লাখের বেশি ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল। এর মধ্যে মারা গেছেন ১০৫০ জনের মতো রোগী।
ভোরের আকাশ/নি