logo
আপডেট : ২ আগস্ট, ২০২৩ ১৪:১১
বিএনপির আন্দোলন ও নেতাকর্মীদের অসহায়ত্ব
মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী

বিএনপির আন্দোলন ও নেতাকর্মীদের অসহায়ত্ব

গত ২৯ জুলাই বিএনপি ঢাকার প্রবেশমুখে অবস্থান নিতে গিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং নেতাকর্মীরা সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। বেশকিছু যানবাহনে অগ্নিসংযোগ, ভাঙচুর, যাত্রী সাধারণের অবর্ণনীয় দুঃখ-দুর্দশা, বেশকিছু সময়ের জন্য ঢাকা ও বাইরের মানুষের যাতায়াত সংকটাপন্ন এবং গোটা ঢাকা শহরে একটা আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।

 

এ ধরনের কর্মসূচি দেয়া হবে সেটি আগে থেকে কেউ জানত না। তা ছাড়া রাজধানীর সব প্রবেশমুখে অবস্থান নেয়ার কর্মসূচির অর্থ দাঁড়ায় ঢাকাকে অবরোধ করা, ঢাকা থেকে গোটা দেশকে বিচ্ছিন্ন করা যা কোনোভাবেই নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের সঙ্গে যায় না। সময়টি এখন বেজায় গরমের। রাস্তাঘাটে চলাফেরা এমনিতেই বেশ কষ্টদায়ক।

 

এর ওপর যখন যানবাহন সংকট, ঢাকার পরিস্থিতি উত্তপ্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে তখন মানুষের জীবন ও সম্পদ কতটা অনিশ্চয়তার মুখে পড়ে সেদিন সেটির অভিজ্ঞতা যাদের হয়েছিল তারাই ভালো বুঝতে পেরেছিলেন। তা ছাড়া দিনটি ছিল মুসলমানদের পবিত্র আশুরা পালনের। সাধারণত ধর্মীয় কোনো বিশেষ দিনে রাজনৈতিক কোনো কর্মসূচি থাকে না।

 

কিন্তু বিএনপি ২৮ তারিখে নয়াপল্টনে অনুষ্ঠিত মহাসমাবেশ থেকে আকস্মিকভাবেই ২৯ তারিখ ঢাকার প্রবেশমুখে অবস্থান করার কর্মসূচির কথা ঘোষণা করে। নয়াপল্টনে উপস্থিত নেতাকর্মীরাও এমন কর্মসূচির জন্য অনেকটাই অপ্রস্তুত ছিল। তারা জানত যে, এই মহাসমাবেশে আসার পর নতুন কর্মসূচি নিয়ে তারা বাড়ি ফিরে যাবে। কিন্তু ঘটনার পূর্বাপর গভীরভাবে বিশ্লেষণ করলে যে বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যায় যে, নেতৃত্বের কোনো না কোনো জায়গা থেকে এই সমাবেশের ওপর দাঁড়িয়ে কঠিন কোনো কর্মসূচিতে যাওয়ার গোপন কোনো পরিকল্পনা ছিল।

 

সেটি হয়তো কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের সবার নাও জানা থাকতে পারে। কিন্তু ঢাকার এই মহাসমাবেশে ব্যাপক উপস্থিতি ঘটিয়ে বিএনপি তাদের শক্তি-সামর্থতা দেখানোর কথা গণমাধ্যমে বলার চেষ্টা করেছে, টিভি টকশোতে কোনো কোনো নেতা ৫০ লাখ নেতাকর্মীর উপস্থিতির কথা শোনানোর চেষ্টাও করেছে। এসব নেতাকর্মী দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে আসবে, সেটিও বলা হয়েছিল। কিন্তু কেন এখনই এত বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মীকে দেশের সব উপজেলা থেকে ঢাকায় আনা হবে তা অনেকের কাছেই বোধগম্য ছিল না।

 

জুলাই মাসব্যাপী বিএনপি দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে তারুণ্যের সমাবেশ ঘটিয়ে তাদেরই আন্দোলনের অগ্রসেনানি হিসেবে অভিহিত করে দেশ, জাতি ও গণতন্ত্রের জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগের প্রস্তুতি নিয়ে উদ্দীপ্ত করেছিল। বোঝাই যাচ্ছিল বিএনপি তরুণদেরই এবারের আন্দোলনের সম্মুখে ঠেলে দেয়া পরিকল্পনা নিয়ে তাদের আবেগকে চমৎকারভাবে কাজে লাগিয়েছিল। সর্বশেষ ২২ জুলাই ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে উদ্দীপিত তরুণদের নিয়ে একটি বড় ধরনের শোডাউন করা হয়েছিল।

 

তাতে অবশ্য আরো কিছু ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর কেউ কেউ র‌্যাব, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং সরকারের নানা নির্যাতনের বিষয়ে তাদের মতো করে বক্তৃতা প্রদানের মাধ্যমে শ্রোতাদের আবেগকে নাড়া দেয়ারও চেষ্টা করেছে। ২২ তারিখের এই সমাবেশের পর ২৭ তারিখ মহাসমাবেশ অনুষ্ঠিত হবে এমনটি শরিকদেরও অবহিত করা হয়নি বলে পত্রপত্রিকা থেকে জানা গেছে। এখানে বিএনপির কোনো বিশেষ এজেন্ডা ছিল, এটি এখন অনেকটাই পরিষ্কার।

 

২৭ তারিখের সভাটি ২৮ তারিখ অনুষ্ঠিত হলো। সেখানেই উপস্থিত তরুণদের পরদিন ঢাকার ধর্মঘটে অবস্থান নেয়ার আহব্বান জানানো হলো। তাদের ঢাকায় থাকার কথাও কেউ কেউ বললেন। পুরো বিষয়টাই সবার কাছে রহস্যাবৃত মনে হলো। যারা দূর-দূরান্ত থেকে এসেছিল তাদের অনেকেরই ঢাকায় দীর্ঘসময় থাকার মতো প্রস্তুতি ছিল না। তবে অনেকেই থেকে গেলেন, কেউ কেউ ফিরেও গেলেন। এরপরের ঘটনা সবারই জানা।

 

কিন্তু একটি মহাসমাবেশ থেকে পরদিন ঢাকার প্রবেশমুখে অবস্থান ধর্মঘট করার মতো কর্মসূচিকে মোটেও শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের ধারাবাহিকতা হিসেবে বলা যায় না। এটি ছিল বাজিয়ে দেখার চিন্তাভাবনা। সরকার কতটা রিয়েক্ট করে বা কর্মীরা কতটা ঝাঁপিয়ে পড়ে তাও দেখা থেকে ‘যদি লেগে যায়’ তেমন কোনো চিন্তাও হতে পারে। তবে সিদ্ধান্তটি যে লন্ডনে থাকা শীর্ষ নেতা তারেক জিয়ার কাছ থেকে এসেছে এমনটি পরে বোঝা গেছে। বিএনপির মহাসচিবও সিদ্ধান্তটি জানলেও খুব বেশি খোলাসা করে কিছু বলেননি।

 

যে প্রক্রিয়ায় ২৯ তারিখের অবস্থান নেয়ার সিদ্ধান্ত দেয়া হয়েছিল তা ছিল চাপিয়ে দেয়া এবং দলের নেতাকর্মীদের অপ্রস্তুত অবস্থানে ফেলে দেয়ার নামান্তর। ২৯ তারিখের ঘটনায় তেমন দৃশ্যই দেখা আছে। অনেক নেতাই মাঠে থাকতে পারেননি, আবার কয়েকটি জায়গায় অবস্থান ধর্মঘটকারীরা জানতই না তারা রাস্তায় বসে পড়বে নাকি রাস্তায় পাশে অবস্থান নেবে- এ নিয়েও ছিল ধোঁয়াশা। টিভি টকশোতে নেতাদের অনেকেই ভিন্ন ভিন্ন কথা বলেছেন। কেউ কেউ অবস্থান কর্মসূচিকে তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার বলার চেষ্টাও করেছেন।

 

কিন্তু ঢাকার প্রবেশমুখে অবস্থান নেয়ার বিষয়টি কোনোভাবেই গণতান্ত্রিক অধিকারের সীমায় পড়ে বলে গণতন্ত্রের তাত্তি¡করাও বলবেন বলে মনে হয় না। এটি হতে পারে একমাত্র যখন কোনো আন্দোলনে ব্যাপক জনগণের উপস্থিতি ও সমর্থন থাকে, যখন আন্দোলনটি গণঅভ্যুত্থানের কোনো পর্যায়ে উত্তরণ ঘটায়, তখন জনগণের রাস্তা জনগণই নিয়ন্ত্রণ করে। কারো ভোগান্তি সেভাবে করার চেষ্টা হয় না, তবে কিছু হলেও সেটি মেনে নেয়ার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু তেমন পরিস্থিতি তো বিএনপির এক দফা আন্দোলন ঘোষণাই পর থেকে দেশে সৃষ্টি হওয়ার বাস্তবতাই দেখা যায়নি।

 

বিএনপির এই কর্মসূচিটি ছিল যেমন আকস্মিক তেমনি হঠকারী হিসেবেও রাজনৈতিকভাবে চিহ্নিত করা যায়। আন্দোলনে এভাবে ক্লাইম্যাক্সে ওঠা যায় না। উঠতে গেলে বিপদ ঘটে, জনসমর্থন হারায় এবং দলের কথা ও কাজের মধ্যে বৈপরীত্য ঘটে। বিএনপির কিছু কিছু সিদ্ধান্ত যে রহস্যাবৃত থাকে তা নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। ১০ ডিসেম্বরের হাঁকডাক এবং ৭ তারিখেই নয়াপল্টনের অফিস সম্মুখে নেতাকর্মীদের জড়ো করা ছিল এক ধরনের রহস্যাবৃত কর্মকান্ড। যা নিয়ে তখন বিএনপির কয়েক নেতা গ্রেপ্তারও হন। কিছুদিন বেশ জটিল পরিস্থিতি বিএনপিকে অতিক্রম করতে হয়েছিল।

 

সেই সময়ে যে হেফাজতের ৫ মে’র মতো আরেকটি অবস্থান নেয়ার পরিকল্পনা ভেতরে ভেতরে কারো কারো মধ্যে ছিল- সেটিরই আলামত খোঁজা হলেও অনেকে তা স্বীকার করতে চান না। বিএনপির রাজনীতিতে মাঝে মধ্যে এ ধরনের ঘটনা ঘটানোর ঐতিহ্যের সন্ধান পাওয়া যায়। ২০১১ সালের ১৮ ডিসেম্বর বিএনপি ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে ‘মুক্তিযোদ্ধা সমাবেশ’ আহব্বান করেছিল। কিন্তু আগের রাতে সারা দেশ থেকে জামায়াত-শিবির এবং ছাত্রদলের ক্যাডাররা বাসযোগে ঢাকা অভিমুখে যাত্রা করে।

 

বিষয়টি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নজর এড়িয়ে যায়নি। কয়েকটি বাস মধ্যরাতে ঢাকায় পৌঁছেও যায়। কিন্তু ঢাকায় এবং পথিমধ্যে সেসব বাস আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আটকে দেয়। মূলত তখন যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিরুদ্ধে জামায়াত এবং বিএনপির একটি অবস্থান সবার কাছে স্পষ্ট ছিল। মুক্তিযোদ্ধা সমাবেশের নামে সেদিন ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনের সম্মুখে ‘আরব বসন্তের’ মতো রাস্তায় বসে পড়ার একটি গোপন পরিকল্পনা ছিল, যা বিএনপির নেতাদের কারোরই জানা ছিল না। সেটি নিশ্চয়ই শীর্ষ নেতৃত্বের ইঙ্গিতেই ঘটেছিল।

 

২০১৪ এবং ২০১৫ সালে অনেক কিছুই ঘটেছিল, যা কোনো বিপ্লবী কিংবা নিষিদ্ধ ঘোষিত রাজনৈতিক দলের অজ্ঞাত স্থান থেকে বার্তা দেয়ার অনুসরণে বিএনপি-জামায়াতও তখন সরকারবিরোধী আন্দোলনে ব্যবহার করেছিল। এসব হঠকারী পরিকল্পনা শেষ পর্যন্ত ভেস্তে গিয়েছে। ২৯ জুলাই পরবর্তী আগস্ট মাসে দেশে দ্রুত একটা অস্থিতিশীল অবস্থা তৈরি করার যে চেষ্টা শীর্ষ পর্যায়ের কোনো নেতার মধ্যে ছিল সেটি আসলে শেষ পর্যন্ত বিএনপির চলমান আন্দোলনকে অনেকটাই নিচের দিকে নামিয়ে দেয়া হলো।

 

এটি অনেকটাই তৈলাক্ত বাঁশে অন্ধ বানরের ওঠানামার দৃশ্য শিয়ালদের দেখার গল্পের কথাই মনে করিয়ে দেয়। শিয়ালরা অন্ধ বানরকে নিয়ে এমন খেলা খেলতে চেয়েছিল। বানরটি এক হাত কষ্টে-পৃষ্ঠে উঠলেও বাঁশটি তৈলাক্ত হওয়ার কারণে তাকে ২ হাতেরও বেশি নেমে যেতে হয়। আবার তার সেটির ওপরে ওঠার চেষ্টা একই দৃশ্যেরই পুনরাবৃত্তি ঘটায়। নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতিতে উগ্র ও হঠকারিতার আশ্রয় নিলে অগ্রগতি যেটুকু অর্জিত হয় তা থেকে তাকে অনেক বেশি পিছিয়ে যেতে হয়।

 

লেখক : অধ্যাপক (অবসরপ্রাপ্ত), ইতিহাসবিদ ও কলামিস্ট।

 

ভোরের আকাশ/নি