বিশ্বখ্যাত অর্থনীতিবিদ নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক অমর্ত্য সেনের ভাষায়, ‘সুচিন্তিত গণতান্ত্রিক আন্দোলনের মাধ্যমে জাতীয় অধিকার প্রতিষ্ঠা যে সম্ভব শেখ মুজিবুর রহমান তার প্রমাণ সমগ্র পৃথিবীর সামনে তুলে ধরেছিলেন। বঙ্গবন্ধু শুধু বাঙালির বন্ধু ও অধিনায়ক ছিলেন না, তিনি ছিলেন মানবজাতির পথপ্রদর্শক ও মহানেতা।
তা ছাড়া বঙ্গবন্ধুর উৎসাহ শুধু রাজনৈতিক স্বাধীনতাতেই সীমাবদ্ধ ছিল না, তিনি চেয়েছিলেন বহুদলীয় গণতান্ত্রিক সভ্যতা, সর্বজনীন শিক্ষা-ব্যবস্থা, সব মানুষের মানবাধিকারের স্বীকৃতি। তার সাবলীল চিন্তাধারার সঠিক মূল্য শুধু বাংলাদেশ নয়, সব পৃথিবীও স্বীকার করবে এ আশা আমাদের আছে এবং থাকবে।
নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বাংলাদেশের মুক্তির আন্দোলনের নেতৃত্বের মধ্যে শেখ মুজিবের বিশাল মহিমার একটি প্রকাশ যেমন আমরা দেখতে পাই, তার মহামানবতার আরেকটি পরিচয় আমরা পাই তার চিন্তাধারার অসাধারণতায়।’
শোকাবহ আগস্ট। সীমাহীন ক্রন্দনের অনন্ত পথযাত্রা। ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ সাল শুধু বাংলাদেশ নয়; সভ্যতার ইতিহাসে নিকৃষ্ট এক কলঙ্কজনক অধ্যায়ের পরিশিষ্ট। কোমলমতি শিশু রাসেলসহ জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর সপরিবারে শাহাদাতবরণের নির্মম আর্তনাদ। নিবন্ধের শুরুতে শেখ রাসেল স্মরণে রচিত ভারতবর্ষের সর্বাধিক জনপ্রিয় বাঙালি কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কবিতার পঙ্ক্তিগুলো উচ্চারণ করতে চাই - ‘রাসেল, অবোধ শিশু, তোর জন্য আমিও কেঁদেছি/ খোকা, তোর মরহুম পিতার নামে যারা/ একদিন তুলেছিল আকাশ ফাটানো জয়ধ্বনি/ তারাই দু’দিন বাদে থুতু দেয়, আগুন ছড়ায়/ বয়স্করা এমনই উন্মাদ!/ তুই তো গল্পের বই, খেলনা নিয়ে সবচেয়ে পরিচ্ছন্ন বয়েসেতে ছিলি/ তবুও পৃথিবী আজ এমনই পিশাচী হলো/ শিশু রক্ত পানে গ্লানি নেই?/ সর্বনাশী, আমার ধিক্কার নে!/ যত নামহীন শিশু যেখানেই ঝরে যায়/ আমি ক্ষমা চাই, আমি সভ্যতার নামে ক্ষমা চাই!’ বিপুলসংখ্যক কবি-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবীর করুণ উপস্থাপনে প্রতিফলিত আগস্টের বেদনাগাথা।
দানবরূপী হিংস্র ঘাতক সৃষ্ট বর্বরতা ও নৃশংসতায় অভিশপ্ত হত্যাযজ্ঞের আচ্ছাদনে নিষ্ঠুর-নির্মমতায় আবৃত এক কঠিন শোকের দিন। মুক্তির মহানায়ক সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, বঙ্গমাতা ও পরিবারের প্রায় সব সদস্যের জীবন বিসর্জনের রক্তিম সূর্যাস্তের নিগূঢ় প্রেক্ষাপট। শোকাবহ আগস্টের এই দিনে তাদের স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন এবং মহান স্রষ্টার দরবারে তাদের আত্মার অফুরন্ত শান্তি প্রার্থনা করছি। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের কদর্য বাস্তবায়নে বঙ্গবন্ধু হত্যার সম্ভবত প্রধান উদ্দেশ্য ছিল পৃথিবী নামক এই গ্রহের মানচিত্রে লালসবুজের পতাকাবাহী প্রাণবিসর্জন ও ত্যাগের মহিমায় অবিনশ্বর ইতিহাসকে পাল্টে দিয়ে বাংলাদেশের সমৃদ্ধির অগ্রযাত্রাকে অবরুদ্ধ করা।
নির্বোধ ঘাতকচক্রের বোধোদয়ে অধীত ছিল বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে অন্ধকারের শক্তির কুৎসিত অবগাহনে দীর্ঘ স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মহান মুক্তিযুদ্ধের অবিনাশী শক্তিকে পরাভ‚ত করে প্রতিশোধপরায়ণতা কার্যকর করবে। তারা স্বপ্নেও ভাবেনি যে, বঙ্গবন্ধু কালান্তরে বিশ্বজয়ী নেতার মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হয়ে নিরন্তর বাংলাদেশসহ বিশ্বকে সামগ্রিক উন্নয়ন পরিক্রমায় অকৃত্রিম পথপ্রদর্শকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হবেন জাতির পিতা।
এটি সর্বজনবিদিত যে, চিরঞ্জীব বঙ্গবন্ধু একজন শহিদ নেতার চেয়েও সময়ের বিবর্তনে কতবেশি শক্তিমান হতে পারেন আজ পুরোবিশ্ব অবাক বিস্ময়ে তা সদাদীপ্ত অক্ষয় জ্যোতির মতো উপলব্ধি করতে পারছে। সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারকার্য পরিচালনায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির লক্ষ্যে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশসহ জঘন্য পন্থা অতিক্রান্তে কত যে দুরাক্রম পথ পাড়ি দিতে হয়েছে, তা দেশবাসী সম্যক অবগত আছেন। সত্যের কাঠিন্যে আরাধ্য বিচার কাজ সম্পন্ন ও বিচারের রায় কার্যকর করে বাংলাদেশ প্রমাণ করেছে আইনের শাসনই সভ্যসমাজ প্রতিষ্ঠার অপ্রতিবন্ধ মানদন্ড।
এ সম্পর্কে বঙ্গবন্ধুকন্যা দেশরত্ন শেখ হাসিনা লিখিত ‘সত্যের জয় অনিবার্য’ নিবন্ধের কিছু বিষয় প্রণিধানযোগ্য। তিনি লিখেছেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে একটা অপপ্রচার চলছে। ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর তথাকথিত সিপাহি জনতার বিপ্লবের মাধ্যমে মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের ক্ষমতা গ্রহণ প্রসঙ্গে মিথ্যা অপপ্রচার করা হতো যে, সিপাহি-জনতা জিয়াকে ক্ষমতায় বসিয়েছে, তার সঠিক চিত্র এতদিন পর এ রায়ের মাধ্যমে দেশবাসী জানতে পারলো।’
উল্লেখ্য, নিবন্ধে সংযুক্ত ছিল ‘১৯৭৭ সালের ২১ এপ্রিল রাষ্ট্রপতি সায়েম জিয়াকে রাষ্ট্রপতি পদে মনোনয়ন দিয়েছিলেন। যদিও সেনাপ্রধান হিসেবে জেনারেল জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সায়েমকে অস্ত্র দেখিয়ে বাধ্য করেছিল পদত্যাগ করতে এবং তাকে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করতে। এ কথা বিচারপতি সায়েমের বই- Bangabhaban : Last Phase-এ উল্লেখ করা হয়েছে। একজন ক্ষমতালিপ্সু উচ্চাভিলাষী সামরিক কর্মকর্তা ক্ষমতা দখলের জন্য উন্মাদ হয়ে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট রাষ্ট্রপতিকে হত্যা করে, আর এক রাষ্ট্রপতির কাছ থেকে অস্ত্র দেখিয়ে ক্ষমতা কেড়ে নেয়। অথচ তাকেই প্রচারমাধ্যমের বরাতে ‘গণতন্ত্রের প্রবক্তা’ বানানো হয়েছে।
এই মিথ্যা বয়ান শুনতে শুনতে জাতি যখন অতিষ্ঠ, তখন এ রায় ইতিহাসের ধ্রুব সত্যকে উদ্ভাসিত করেছে। এজন্য দেশবাসীর পক্ষ থেকে বিচারপতিদের আন্তরিক ধন্যবাদ জানাচ্ছি যে, একটা মিথ্যার হাত থেকে তারা জাতিকে বাঁচিয়েছেন। অন্তত আগামী প্রজন্ম সত্যকে জানতে পারছে। কারণ, ইতোমধ্যেই একটা প্রজন্ম এই মিথ্যা শুনে শুনে এটাকেই বিশ্বাসযোগ্য বলে ধরে নিয়েছে। জানি না, তারা পেছনে ফিরে আবার সব বিশ্লেষণ করে দেখবে কিনা বা তাদের আত্মোপলব্ধি হবে কিনা!
আমার কাছে মনে হয়, বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে জানতে হলে এ গ্রন্থটি একমাত্র প্রামাণ্য দলিল। আজও আমি বঙ্গবন্ধুর জীবনদর্শন থেকে অনুপ্রাণিত হই, বাঙালি হিসাবে তাকে নিয়ে গর্ববোধ করি। আসলে নিজের জাতিসত্তা সম্পর্কে গর্ববোধ না থাকলে কোনো জাতি বড় হতে পারে না। সেটিই বঙ্গবন্ধুর জীবন থেকে নেয়া আমার প্রথম শিক্ষা।’ ১৫ আগস্টের হত্যাকান্ড কে ঘিরে প্যারিসের বিখ্যাত ‘লা মঁদে’ পত্রিকার রবার্ট এসকারপি, লন্ডনের ‘দি ফাইন্যান্সিয়াল টাইমস’, ’দি লিসনার’ পত্রিকার সংবাদদাতা ব্রায়ন ব্যারনসহ দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে খ্যাতির শীর্ষে অধিষ্ঠিত বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা, সাময়িকী এবং খ্যাতিমান সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী ও সম্মানিত রাজনীতিক/রাষ্ট্রনায়কদের মন্তব্য এতই হৃদয়গ্রাহী ও আবেগঘন ছিল, যা শুধু বাঙালি নয় বিশ্বের সমগ্র শুভ, মঙ্গল ও কল্যাণকামী বিবেকবান জনগোষ্ঠীকে আপ্লুত করেছে এবং কাঁদিয়েছে। এই ক্রন্দন ধ্বনি এতবেশি সঞ্চারিত ও প্রবল বহমান, যা শোককে শক্তিতে রূপান্তর করে বাঙালি জাতিকে নিগূঢ় ব্রত গ্রহণে অপরিমেয় প্রমুদিত করেছে। আজ বাংলাদেশ বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণ এবং বিশ্বপরিমন্ডলে উঁচুমাত্রিকতায় উন্নয়ন অধ্যায় নির্মাণে সফল ও সার্থক হয়েছে।
অঁন্দ্রে মারলো বঙ্গবন্ধুকে ধারণ করেছেন এভাবে, ‘এক অশ্বারোহী সেনানায়ক যিনি ক্রুসেডের কালে অনায়াসে সালাহউদ্দীনের সেনাবাহিনীতে স্থান পেতে পারতেন, সেই পুরোনো দিনের সেনানায়কদের মতোই তিনি মর্যাদামন্ডিত, উদারমনা এবং ভাবপ্রবণ।’
ধারাবাহিকতায় অঁন্দ্রে মারলোকে উপস্থাপনে প্রযোজ্য বিষয়সমূহ বিশেষ তাৎপর্য বহন করে। ১৯৭১-এর সেপ্টেম্বরে ভারতের সর্বোদয় আন্দোলনের নেতা জয়প্রকাশ নারায়ণ বাংলাদেশের যথাযথ আন্তর্জাতিক উপলব্ধির জন্য আয়োজিত সম্মেলনে অঁন্দ্রে মারলো ছিলেন একজন আমন্ত্রিত অতিথি। তিনি সম্মেলনে যোগদান না করে বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টিকারী এক অসাধারণ চিঠিতে বাঙালিদের মুক্তিযুদ্ধের প্রতি তার অঙ্গীকারের প্রকৃতি ব্যক্ত করেন। তিনি লিখেছিলেন, ‘সম্মেলনে আলোচনা হবে, প্রবন্ধের মালমশলা সৃষ্টি হবে, কিন্তু ততক্ষণে পাকিস্তানি ট্যাঙ্কগুলো আরো অনেকদূর অগ্রসর হবে। আর বাংলাদেশের পক্ষে সেসব বুদ্ধিজীবীই কথা বলতে পারেন যারা বাংলাদেশের জন্য যুদ্ধ করতে প্রস্তুত।
আমি মুক্তিবাহিনীর অধীনে একটি দল পরিচালনার দায়িত্ব চাই।’ তিনি এক খোলা চিঠিতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিক্সনের উদ্দেশে লিখেছিলেন, ‘আপনার বিমানবাহী রণতরী কলকাতাকে বিপন্ন করতে পারলেও যুক্তরাষ্ট্র ওখানকার মৃত্যুমুখী শরণার্থী মানবগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করতে পারে না। পৃথিবীর সবচেয়ে পরাক্রমশালী সেনাবাহিনী যদি নগ্নপদ ভিয়েতনামিদের গুঁড়িয়ে দিতে সক্ষম না হয়, আপনি কি বিশ্বাস করেন ইসলামাবাদের সেনাবাহিনী ১২ শত মাইল দূর থেকে স্বাধীনতায় উদ্দীপ্ত একটি দেশকে আবার দখল করতে পারবে? পৃথিবীর ভাগ্য যখন ঝুঁকির মুখে, বঙ্গোপসাগরে বিমানবাহী রণতরী পাঠানো কোনো নীতি নয়Ñ অতীতের ধ্বংসাবশেষ মাত্র।’
তার সাবলীল চিন্তাধারার সঠিক মূল্য শুধু বাংলাদেশ নয়, সব পৃথিবীও স্বীকার করবে এ আশা আমাদের আছে এবং থাকবে। নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বাংলাদেশের মুক্তির আন্দোলনের নেতৃত্বের মধ্যে শেখ মুজিবের বিশাল মহিমার একটি প্রকাশ যেমন আমরা দেখতে পাই, তার মহামানবতার আরেকটি পরিচয় আমরা পাই তার চিন্তাধারার অসাধারণতায়।’
অসামান্য নির্ভীক সমাজমানস হিসেবে সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠা এবং বাঙালি জাতির অধিকার আদায়ের সংগ্রামে বঙ্গবন্ধুর মতো এত আত্মত্যাগ অন্য কারো পক্ষে সম্ভব হয়নি। এই মহান আত্মবিসর্জনে সবচেয়ে করুণ-হৃদয়বিদারক-গভীর ক্রন্দনের যে বিষয়টি পুরোবিশ্বকে আবেগতাড়িত করে তা হলো, অবুঝ-নিষ্পাপ শিশুপুত্র শহিদ শেখ রাসেলের হত্যাকান্ড।
এই গ্রহের সব বিবেকবান মানবজাতির হৃদয়গভীরে এই শোকগাথা বিদীর্ণ হলেও; নরপশুতুল্য কপিতয় অন্ধকারের শক্তিকে ন্যূনতম বেদনাবিধুর করেছে বলে মনে হয় না। এখনো হত্যাকারী-হত্যার ক্ষেত্র প্রস্তুতকারীদের অশুভ পদচারণায় দেশ প্রকম্পিত বলে প্রবল জনশ্রুতি রয়েছে। স্বল্পসংখ্যক হত্যাকারীর বিচারকার্য সম্পন্ন হলেও অধিকসংখ্যক অপরাধীর বিচার দৃশ্যমান নয়। অচিরেই হত্যার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবাইকেই আইনের আওতায় এনে শাস্তির ব্যবস্থা গ্রহণ আপামর জনগণের অন্তরের সুদৃঢ় দাবি।
লেখক : শিক্ষাবিদ, সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
ভোরের আকাশ/নি