শাহীন রহমান: এবার দেশে ডেঙ্গুর ভয়াবহ প্রকোপ অতীতের সব রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণেই সম্প্রতি সময়ে এডিস মশার বাহক বাড়ছে। ফলে ডেঙ্গুর মতো মশাবাহিত রোগ ভয়াবহ আকারে ছড়াচ্ছে। তারা জানান, দেশে ১২৬ প্রজাতির মশা রয়েছে। এর মধ্যে ২৬টি এডিস প্রজাতির। এডিস প্রজাতির মধ্যে আবার দুটি প্রজাতি রয়েছে এডিস ইজিপ্টি ও এডিস অ্যালবোপিকটাস। যেগুলো ডেঙ্গু ভাইরাসের প্রধান বাহক। ডেঙ্গুর চারটি ধরন, ডেন-১, ডেন-২, ডেন-৩ এবং ডেন-৪ এর মধ্যে কয়েক বছর ধরে দেশে ডেন-২ ও ডেন-৩-এর প্রাদুর্ভাব বেশি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডেঙ্গু জ্বর মূলত একটি মশাবাহিত ভাইরাল সংক্রমণ। এটি সাধারণত বিশ্বের গ্রীষ্মমন্ডলীয় এবং উপক্রান্তীয় অঞ্চলে দেখা যায়। এডিস প্রজাতির স্ত্রী মশার কামড়েই এটি হয়ে থাকে। এটি তখনই ঘটে, যখন মশা একটি সংক্রমিত ব্যক্তিকে কামড় দেয় এবং তারপর ভাইরাস বহন করার সময় একটি অ-সংক্রমিত ব্যক্তিকে কামড় দেয়। পৃথিবীতে প্রায় ৩ হাজার ৫০০ প্রজাতির মশার শতকরা ২৫ হচ্ছে এডিস। শুধু এই বছর নয় সাম্প্রতিক সময়ে দেশে মশাবাহিত রোগের প্রকোপ অনেক বাড়ছে। এর পেছনে জলবায়ু পরিবর্তনই মূল কারণ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যদি কার্বন নির্গমণ রোধ করা না যায়, তাহলে রোগ বহনকারী মশার বিস্তার আরো ভয়াবহ আকারে বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সাম্প্রতিক দশকে দেশে উষ্ণতার প্রভাব ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। এর কবল থেকে এ বছরের বর্ষকালও রেহাই পায়নি। প্রকৃতিতে এখন ঘোর বর্ষাকাল হলেও কাক্সিক্ষত বৃষ্টির দেখা মেলেনি। মূলত জলবায়ু পরিবর্তনে এমনটা ঘটছে বলে তারা উল্লেখ করেছেন। একই সঙ্গে তারা এও বলছেন, উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণে মশাবাহিত প্রাণঘাতী ডেঙ্গুর প্রভাব ক্রমেই বাড়ছে।
এর কারণ হিসাবে উল্লেখ করেছেন, রোগ বহনকারী মশা উষ্ণ পরিবেশে সহজে টিকে থাকতে পারে। শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্বের অনেক দেশে বিশেষ করে এশিয়া, আফ্রিকার উঁচু অংশে এবং লাতিন আমেরিকায়ও ম্যালেরিয়া ও ডেঙ্গু ক্রমেই বাড়ছে। যেখানে এ রোগ আগে ছিল না। এখন ইউরোপেও স্থায়ীভাবে ডেঙ্গু সংক্রমণ বাড়ছে, যা ২০ বছর আগেও অকল্পনীয় ছিল।
বিভিন্ন জরিপেও বলা হয়েছে, রোগ বহনকারী মশা নানা দেশে ছড়িয়ে পড়বে, যদি কার্বন নির্গমন না কমে। শুধু রোগে সংক্রমণ নয়। এর ফলে দেশের উপকূলীয় অঞ্চলে ঘূর্ণিঝড়ও আগের চেয়ে বেড়েছে। এছাড়া বন্যা, খরা, নদী ভাঙনের মতো দুর্যোগও দেশে বাড়ছে। কারণ জলবায়ু পরিবর্তন হলে প্রাণীরাও জায়গা বদলায়। তারা জীবন ধারণের জন্য অধিকতর উপযুক্ত স্থানে চলে যায়।
ফলে বিভিন্ন প্রাণীর দেহে বাস করা ভাইরাস মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ার এবং মহামারি সৃষ্টি করার সুযোগ তৈরি হয়। কোভিডের ক্ষেত্রে এ ঘটনা দেখা গেছে। চিকুনগুনিয়া ও ডেঙ্গুর প্রকোপের পেছনেও রয়েছে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঘটনা। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে অনেক সময় পরিবেশই এ ভাইরাসগুলো সংক্রমণের সহায়ক হয়ে ওঠে। আর এ বছর ডেঙ্গু আক্রান্তরা শক সিন্ড্রোমে মারা যাচ্ছেন বেশি। শীতের মৌসুম শুরু হলেও ডেঙ্গু জ্বরের প্রকোপ আশঙ্কাজকনভাবে বাড়ছে, যার জন্য মূলত দায়ী জলবায়ু পরিবর্তন।
আন্তর্জাতির বিভিন্ন গবেষকরা উল্লেখ করছেন, জলবায়ু পরিবর্তন বিশ্বে স্বাস্থ্য নিরাপত্তার ক্ষেত্রে এক বিরাট ঝুঁকি তৈরি হওয়ার ক্ষেত্রে সৃষ্টি হয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে তাপমাত্রা বেড়ে যাচ্ছে। ফলে বিশ্বের উষ্ণায়ন বাড়ছে। আর পরিবেশে গরম বেড়ে যাওয়ার কারণে ব্যাকটেরিয়া ও রোগ সহজে ছড়াচ্ছে। গরম আবহাওয়ায় ব্যাকটেরিায়া সহজেই বাড়ছে। ফলে কিছু রোগও সহজে ছড়াচ্ছে।
কলেরার উদাহরণ টেনে তারা বলেন, এটি একটি বিপজ্জনক রোগ। এ ব্যাকটেরিয়া পানিতে শ্যাওলা জাতীয় উদ্ভিদে পাওয়া যায়। উষ্ণ পানিতে বংশ বৃদ্ধি করে। বন্যার মতো জলবায়ু সংশ্লিষ্ট দুর্যোগের সময় পানিবাহিত রোগ বেড়ে যায়। তা পোকা-মাকড়কে আকৃষ্ট করে। ঠিক যেমন খরার সময় অনিরাপদ পানির মজুত হয়ে থাকে। পানির এ নিরাপদ উৎস কমে যাওয়ার কারণে ডায়রিয়া রোগের প্রকোপ সম্প্রতি সময়ে দেশে বেড়ে গেছে। বিশেষ করে গরম শুরু হলেই ডায়রিয়া প্রকোপ বেড়ে যাচ্ছে। এর প্রধান কারণ হলো অনিরাপদ পানি।
বিশিষ্ট কীটতত্তবিদ অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার বলেন, মাঠ পর্যায়ে কাজ করতে গিয়ে লক্ষ্য করা যায় বহুতল ভবনের গাড়ির গ্যারেজ, গাড়ি পরিষ্কারের স্থানে পানি জমে মশার সৃষ্টি হয়। কিন্তু এসব বহুতল ভবনে অনেক সচেতন মানুষ বসবাস করেন। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অনেক জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়। এসব স্থানে পানি নিষ্কাশনের উপযুক্ত ব্যবস্থা না থাকায় মশার বিস্তার লাভ করে। ডক্টরস ফর হেলথ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টের সভাপতি অধ্যাপক ড. এম আবু সাঈদ বলেন, দেশে অপরিকল্পিত নগরায়ণ ও ডি-ফরেস্টেশনের ফলে জলবায়ুর পরিবর্তন। এই জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন রোগব্যাধি বৃদ্ধি পাচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ষাটের দশকে দেশ থেকে ম্যালেরিয়া নির্মূল হয়েছিল। এখন আবার সেই ম্যালেরিয়ার প্রভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে। যেটা জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে এর প্রকোপ বাড়ছে। এটি আর শহর অঞ্চলে আবদ্ধ থাকছে না। সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। এটি প্রতিরোধে সরকার ও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিয়োমিত ব্রিফিংয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে দ্রুত ও কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে হবে। কারণ ডেঙ্গু সম্পূর্ণ মৃত্যু প্রতিরোধযোগ্য রোগ। সুতরাং দেশে এর জন্য উন্নত গবেষণা করে টিকা আবিষ্কার ও তা প্রদান জরুরি।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের মশা নিধনে দৃশ্যত তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য ও কার্যকর পদক্ষেপ লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। ডেঙ্গু আক্রান্ত বেশিরভাগ রোগীর কোনো উপসর্গ লক্ষ্য করা যায় না। সে কারণে দেশে প্রকৃত আক্রান্ত ও মৃত্যুর তথ্য পাওয়া যাচ্ছে না। যে সংখ্যা প্রকাশ করা হচ্ছে, প্রকৃত পক্ষে তার চেয়ে অনেক বেশি আক্রান্ত মৃত্যুবরণ করছে।
আক্রান্তের তুলনায় পরীক্ষা কেন্দ্র খুবই সামান্য। দেশে এতদিন ধরে হাজার হাজার মানুষ মারা গেল অথচ এ রোগ নিয়ে তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য গবেষণা ও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি। তিনি দেশে জনস্বাস্থ্যগত জরুরি অবস্থা জারি করার প্রস্তাব করেন। একই সঙ্গে দ্রুত ভ্যাকসিন সংগ্রহ ও প্রদানের দাবি জানান।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারের দায়িত্বশীল সংস্থা ও ব্যক্তি ডেঙ্গু নির্মূলে তাদের দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিয়েছে। তারা যদি সারা দেশের এডিস মশার প্রজননগুলো সময়মতো ধ্বংস করত তা হলে এ মশার বংশ বিস্তার নষ্ট হয়ে যেত। তারা ডেঙ্গুর হাত থেকে মুক্তিলাভে পোলিও খাওয়ানোর আদলে দেশে ডেঙ্গু নিধনের কীট ও প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম সরবরাহের ব্যবস্থা গ্রহণের আহব্বান জানান।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে এ বছর মশাবাহিত রোগে মোট মৃত্যুর সংখ্যা ৫ গুণ বেশি। ২০২২ সালে দেশে সর্বোচ্চ ২৮১ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। অথচ চলতি বছরের জুলাই মাসেই মারা গেছে ২০৪ জন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সংবাদ বিজ্ঞপ্তি অনুসারে, এ বছর ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মৃতের সংখ্যা ৩০৩ জন। ডেঙ্গুতে মোট আক্রান্ত ৬৩ হাজার ৯৬৮ জন। ঢাকায় ৩৪ হাজার ৫২৩ এবং ঢাকার বাইরে ২৯ হাজার ৪৪৫ জন। ডেঙ্গুর মৌসুম গত বছরের মতো দীর্ঘ হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে, যা আগামী নভেম্বর পর্যন্ত হতে পারে। মূলত জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ডেঙ্গুর মতো রোগের সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে।
ভোরের আকাশ/নি