logo
আপডেট : ৭ আগস্ট, ২০২৩ ১১:১১
স্বর্ণপট্টিগুলোয় ক্রেতার আকাল, উদ্বিগ্ন ব্যবসায়ীরা
মুস্তাফিজুর রহমান নাহিদ

স্বর্ণপট্টিগুলোয় ক্রেতার আকাল, উদ্বিগ্ন ব্যবসায়ীরা

মুস্তাফিজুর রহমান নাহিদ: ইতিহাসের সর্বোচ্চ দামে রয়েছে স্বর্ণ। অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে এখন রেকর্ড দামে বিক্রি হচ্ছে ধাতুটি। বিশ্ব বাজারে হুহু করে কমছে এর দাম। তবে উন্নত অর্থনীতির সেসব দেশে ক্রেতার তেমন আকাল নেই। উল্টো চিত্র বাংলাদেশে। দাম বেড়ে যাওয়ায় এখন স্বর্ণের দোকানগুলোয় যাচ্ছেন না ক্রেতারা। ক্রেতার খরায় পুড়ছে স্বর্ণপট্টিগুলো।

 

বাংলাদেশে ইতোমধ্যে ভরিপ্রতি লাখ টাকা ছাড়িয়েছে স্বর্ণের দাম। ঊর্ধ্বমুখী এ দামের কারণে তা ক্রয়ক্ষমতার অনেকটা বাইরে চলে গেছে সাধারণ মানুষের। অন্যদিকে মার্কেটে ক্রেতা না থাকায় হতাশ ব্যবসায়ীরা। নামিদামি কিছু ব্র্যান্ডের দোকানে কিছুটা বেচা-বিক্রি হলেও মাঝারি ও ছোট ব্যবসায়ীদের মাথায় হাত। ব্যবসা টিকিয়ে রাখা কঠিন হয়ে গেছে অনেকের জন্য।

 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জুয়েলারি শিল্পের কথা মাথায় রেখে এবং সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার কথা চিন্তা করে এখনই কার্যকরী পদক্ষেপ না নিলে সাধারণ মানুষ যেমন শখ ও সৌখিনতা থেকে বঞ্চিত হবেন, তেমনি পথে বসতে পারে অসংখ্য ছোট ও মাঝারি জুয়েলারি ব্যবসায়ী। গত ২০ জুলাই দেশের বাজারে প্রথমবারের মতো লাখ টাকা ছাড়ায় স্বর্ণের দাম। বর্তমানে সবচেয়ে ভালো মানের প্রতি ভরি স্বর্ণের দাম ১ লাখ ৭৭৮ টাকা নির্ধারণ করেছে বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতি (বাজুস)।

 

পাশাপাশি ২১ ক্যারেটের প্রতি ভরি স্বর্ণ ৯৬ হাজার ২২৮ টাকা, ১৮ ক্যারেটের প্রতি ভরি স্বর্ণ ৮২ হাজার ৪৬৪ এবং সনাতন পদ্ধতির প্রতি ভরি স্বর্ণ ৬৮ হাজার ৭০১ টাকা নির্ধারণ করা হয়। স্থানীয় বাজারে তেজাবী স্বর্ণের (পাকা স্বর্ণ) দাম বাড়ার পরিপ্রেক্ষিতে এ দাম নির্ধারণ করেছে স্বর্ণ ব্যবসায়ীদের এ সংগঠনটি। দেশের বাজারে এমন সময় স্বর্ণের দাম বেড়েছে, যখন বিশ্ব বাজারে কমেছে স্বর্ণের দাম।

 

মার্কিন ডলার সম্প্রতি আরো শক্তিশালী হওয়ায় আন্তর্জাতিক বাজারে কমেছে স্বর্ণের দাম। ডলার শক্তিশালী হওয়ায় বেড়েছে বন্ড বিক্রিও। ফলে অন্তত ১ শতাংশ দাম কমেছে স্বর্ণের। চলতি সপ্তাহে মুদ্রানীতি ঘোষণা করবে যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফেডারেল রিজার্ভ (ফেড)। এ কারণে ব্যবসায়ীরা স্বর্ণে বিনিয়োগ কমিয়েছেন। এজন্যই মূলত কমেছে স্বর্ণের দাম।

 

গত ১ আগস্ট স্পট মার্কেটে বৈশ্বিক বেঞ্চমার্ক স্বর্ণের দাম কমেছে ১ শতাংশ। প্রতি আউন্সের মূল্য স্থির হয়েছে ১৯৪৪ ডলার ০২১৭ সেন্টে। গত সপ্তাহে যা ছিল ১৯৫০ ডলারের ওপরে। একই কার্যদিবসে ফিউচার মার্কেটে ইউএস বেঞ্চমার্ক স্বর্ণের দাম নিম্নমুখী হয়েছে ১.৩ শতাংশ। আউন্সপ্রতি দর নিষ্পত্তি হয়েছে ১৯৮১ ডলার ৬ সেন্টে। বাজার বাড়লে তো কাস্টমারের ওপর একটা ইফেক্ট পড়ে।

 

বাজার বাড়লে পরে আমাদের কমিয়ে রাখারও কোনো সুযোগ নেই। আমরা কখনোই চাই না মার্কেট প্রাইজটা হাই হোক। সাধারণত দেশের মানুষ স্বর্ণ কেনার সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন বোধ করে বিয়ের মৌসুমে বা বিয়ের অনুষ্ঠান উপলক্ষে। বিয়েতে কনেকে স্বর্ণ উপহার দেয়া এদেশের অতি প্রাচীন ঐতিহ্য। কিন্তু স্বর্ণের বদলে সিটিগোল্ড দিয়েই কাজ সারতে হচ্ছে।

 

স্বর্ণের ঊর্ধ্বমুখী দামে শুধু ক্রেতারাই নয়, ব্যবসা ভালো চলছে না ব্যবসায়ীদেরও। বড় কিছু নামিদামি ব্র্যান্ডের দোকান ছাড়া অধিকাংশ জুয়েলারি দোকান ক্রেতাশূন্য দেখা গেছে। রাজধানীর বৃহৎ জুয়েলারি মার্কেট বায়তুল মোকাররমের ব্যবসায়ীরা জানান, তাদের ব্যবসার অবস্থা খুব খারাপ যাচ্ছে।

 

মার্কেটের জনতা জুয়েলার্সের দোকানদার সুমন বলেন, ‘দেখতেই তো পাচ্ছেন মার্কেটের অবস্থা। বেচা-বিক্রি শুধু কমনি; নেই বললেই চলে। আমাদের দোকানে আমরা তিনজন আছি। তিনজনই মোবাইলে ভিডিও দেখে সময় কাটাচ্ছি। মানুষের হাতে টাকা নেই। আমাদের তো ছোট দোকান। এ দোকানে সাধারণত মধ্যবিত্ত বা নিম্নমধ্যবিত্ত ধরনের ক্রেতা আসে। বড় বড় যেসব শোরুম আছে তাদের কিছু কাস্টমার আছে যারা ধনী। তাদের তাদের হাতে সবসময় টাকা থাকে। ২ লাখ টাকা ভরি হলেও তাদের কোনো সমস্যা নেই। ওই ব্র্যান্ডের দোকানগুলায় যাচ্ছে।’

 

এদিকে গত তিন বছরের ব্যবধানে প্রতি ভরি স্বর্ণের দাম বেড়েছে ৩০ হাজার টাকা। প্রতি ভরি স্বর্ণের দাম এখন লাখ টাকা ছাড়িয়েছে, যা তিন বছর আগেও ছিল ৭০ হাজার টাকার কম। প্রতিবেশী দেশ ভারতের সঙ্গে তুলনা করলে বাংলাদেশের স্বর্ণের দাম অনেকটা লাগামছাড়া বেড়েছে। গত তিন বছরে বাংলাদেশে স্বর্ণের দাম বেড়েছে ৪৩ শতাংশ।

 

অন্যদিকে ভারতে দাম বেড়েছে ১৫ শতাংশ। ভারতের গত তিন বছরে ভরিপ্রতি স্বর্ণের দাম প্রায় ৮ হাজার রুপি বাড়লেও বাংলাদেশে বেড়েছে প্রায় ৩০ হাজার টাকা। গত শুক্রবার প্রতিবেশী ভারতে ২২ ক্যারেটের মূল্য ছিল ৫৫ হাজার ৪০০ ভারতীয় টাকা আর ২৪ ক্যারেট ৬০ হাজার ৪৪০ টাকা। ৩ বছর আগে ভারতের একই পরিমাণ ২২ ক্যারেট স্বর্ণের দাম ছিল ৪৮ হাজার ৯০৬ টাকা আর ২৪ ক্যারেট ছিল ৫২ হাজার ৫১৫ টাকা। আর তিন বছর আগে অর্থাৎ ২০২০ সালে বাংলাদেশের স্বর্ণের ভরি ছিল ৭০ হাজার টাকারও কম।

 

অন্যদিকে প্রতিবেশী দেশ ভারতের সঙ্গে তুলনা করলে বাংলাদেশের স্বর্ণের দাম অনেকটা লাগামছাড়া বেড়েছে। গত তিন বছরে বাংলাদেশে স্বর্ণের দাম বেড়েছে ৪৩ শতাংশ। অন্যদিকে ভারতে দাম বেড়েছে ১৫ শতাংশ। ভারতের গত তিন বছরে ভরিপ্রতি স্বর্ণের দাম প্রায় ৮ হাজার রুপি বাড়লেও বাংলাদেশে বেড়েছে প্রায় ৩০ হাজার টাকা।

 

বাংলাদেশ জুয়েলার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বাজুস) কেন্দ্রীয় কমিটির কোষাধ্যক্ষ উত্তম বণিক বলেন, ‘বাজার বাড়লে তো কাস্টমারের ওপর একটা ইফেক্ট পড়ে। বাজার বাড়লে পরে আমাদের কমিয়ে রাখারও কোনো সুযোগ নেই। আমরা কখনোই চাই না মার্কেট প্রাইজটা হাইহোক।’

 

বাজুস নেতা বলেন, ‘মানুষ এখন বেশিরভাগ সময় একচেঞ্জ করছে। লোকাল মার্কেটে স্বর্ণের দাম ১ লাখ টাকার ওপরে চলে যাওয়া নতুন করে অনেকেরই তৈরি করার সাধ্য থাকে না। সব মিলিয়েই আমাদের বেচাকেনা একটু কম হচ্ছে। ট্যাক্স বৃদ্ধিসহ নানা জটিলতার কারণে দেশের মার্কেটে স্বর্ণের দাম বাড়ছে। যার প্রভাব পড়ছে ক্রেতা-ব্যবসায়ীদের ওপর।’

 

ভোরের আকাশ/নি