বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ যেমন পরস্পর অভিন্ন, তেমনি নদনদীসহ প্রাকৃতিক জলসম্পদ ও নৌপরিবহণ ব্যবস্থা এ দেশের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। এর সঙ্গে মিশে আছেন কালের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এককথায় নৌপরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়নে বঙ্গবন্ধুর অবদান ছিল প্রথম পথপ্রদর্শক।
নৌপথের উন্নয়নে বঙ্গবন্ধুর অবদান প্রসঙ্গে নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেন, বঙ্গবন্ধু বুঝতে পেরেছিলেন, মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত পাকিস্তানের রেখে যাওয়া ‘খনক’ নামের একটি মাত্র ড্রেজার দিয়ে বিশাল আয়তনের অভ্যন্তরীণ নৌপথের নিয়মিত পলি অপসারণ ও নদী খনন সম্ভব নয়। বঙ্গবন্ধু তার সংক্ষিপ্ত শাসনামলে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের জন্য দুই দফায় নেদারল্যান্ডস থেকে সাতটি উন্নতমানের ড্রেজার সংগ্রহ করেছিলেন, যেগুলো এখনো বিআইডব্লিউটিএর বহরে যুক্ত ও সচল রয়েছে।
বঙ্গবন্ধু উপলব্ধি করেছিলেন, নদীমাতৃক কৃষিপ্রধান ও প্রাকৃতিক মৎস্যনির্ভর প্রিয় মাতৃভূমিকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করে আত্মনির্ভরশীল করতে অমূল্য জলসম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার অনস্বীকার্য। সেজন্য নদনদী সচল রাখা, নৌপরিবহণ ব্যবস্থার উন্নয়ন ও উন্মুক্ত জলসম্পদ রক্ষা করা আবশ্যক। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনসহ নানা ঝুঁঁকি মোকাবিলায় শত ব্যস্ততা ও প্রতিকূলতার মধ্যেও তিনি নদী খননে মনোযোগী ছিলেন। ব
ঙ্গবন্ধু সরকারের আমলে নেদারল্যান্ডস থেকে আনা জলযান বা ড্রেজারগুলো হলো ডেল্টা-১, ডেল্টা-২, ড্রেজার-১৩৫, ড্রেজার-১৩৬, ড্রেজার-১৩৭, ড্রেজার-১৩৮ ও ড্রেজার-১৩৯। এর মধ্যে প্রথম দুটি ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধুকে শুভেচ্ছাস্বরূপ দিয়েছিল নেদারল্যান্ডস। অন্য পাঁচটি ১৯৭৫ সালে সে দেশ থেকে ক্রয় করা হয়েছিল।
জাতির পিতা বাংলাদেশের অনন্য প্রাকৃতিক সম্পদ সুন্দরবনকে নিয়েও ভাবতেন এমনটি উল্লেখ রয়েছে সাংবাদিক আশীষ কুমার দে’র লেখা বই ‘নদী রক্ষা ও নৌখাতের উন্নয়ন: বঙ্গবন্ধু থেকে শেখ হাসিনা’তে। তার লিখিত বইয়ে বঙ্গবন্ধুর অবদান সম্পর্কে বেশ ধারণা পাওয়া যায়। দূরদর্শী নেতা বঙ্গবন্ধু সুন্দরবনের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদগ্রীব ছিলেন। যেহেতু আন্তর্জাতিক সমুদ্রবন্দর মংলার সঙ্গে শিল্প ও বন্দরনগরী খুলনাসহ দেশের অন্যান্য স্থানের নৌ যোগাযোগ অপরিহার্য ছিল।
বঙ্গবন্ধু তার উপলব্ধি থেকে মোংলা বন্দর ও খুলনার মধ্যে বিকল্প নৌপথ সৃষ্টির উপায় খুঁজতে থাকেন। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে সেখানকার পরিস্থিতি সরেজমিন পরিদর্শনে ছুটে যান তৎকালীন নৌ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকা মন্ত্রী জেনারেল আতাউল গণি (এমএজি) ওসমানী, যিনি ছিলেন মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি। ঢাকায় রাষ্ট্রীয় দপ্তরে বসে ওসমানীকে পাঠিয়েই দায়িত্ব শেষ করেননি বঙ্গবন্ধু। বিকল্প নৌপথ খুঁজতে পরবর্তী সময়ে নিজেও ছুটে গিয়েছিলেন মোংলায়।
রাষ্ট্রনায়ক ও সেনানায়কের পরিদর্শন শেষে লুপ কার্টিং ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে বাগেরহাট জেলার মোরেলগঞ্জ উপজেলার ঘষিয়াখালী থেকে রামপাল উপজেলার বেতিবুনিয়া পর্যন্ত ৬.৫ কিলোমিটার সংযোগ খাল খনন করা হয়। এর পর ১৯৭৪ সালে ৩১ কিমি দীর্ঘ মোংলা-ঘষিয়াখালী চ্যানেল বা নৌপথ। যার মূল লক্ষ্য ছিল সুন্দরবনকে অক্ষত রেখে মোংলা সমুদ্রবন্দরের পণ্য আনা-নেয়ার ক্ষেত্রে স্বল্প দূরত্বের বিকল্প পথ আবিষ্কার করা। চালুর অল্পদিনের মধ্যেই নতুন নৌপথটি সার্বিক বিবেচনায় হয়ে ওঠে জনপ্রিয়।
বাংলাদেশ-ভারত নৌবাণিজ্য প্রটোকল রুটের অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় চ্যানেলটি আন্তর্জাতিক নৌপথের স্বীকৃতি পেয়েছে। শেলা নদীর ওপর দিয়ে বাণিজ্যিক জাহাজ চলাচল বন্ধ হওয়ায় পরিত্যক্ত বিষাক্ত জ্বালানি তেল ও ভয়াবহ শব্দদূষণ থেকে সুন্দরবন রক্ষা পেয়েছে। মোংলা-ঘষিয়াখালী বিকল্প চ্যানেল সৃষ্টির বঙ্গবন্ধুর ওই পদক্ষেপ ছিল যুগান্তকারী, যা ইতিহাসের মাইলফলক হিসেবে চিহ্নিত।
বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে ১৯৭৪ সালে বিআইডব্লিউটিএ কর্তৃক প্রকাশিত জরিপে জানা যায়। বাংলাদেশে নৌপথের দৈর্ঘ্য ২৫,১৪০ কিলোমিটার, যা বঙ্গবন্ধু হত্যা-পরবর্তী ৩০ বছরে মাত্র ৫,৯৬৮ কিলোমিটারে নেমে এসেছিল। প্রসঙ্গত, নেদারল্যান্ডসের সংস্থা ঘঊউঊঈঙ-র একটি বিশেষজ্ঞ দল ১৯৬৫-৬৭ পর্যন্ত ওই জরিপ চালালেও তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান সরকার তা যথাসময়ে প্রকাশ করেনি, যা বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে প্রকাশ করা হয়। বঙ্গবন্ধুই এ দেশের নদনদী, নৌপথ ও সুন্দরবন রক্ষা এবং নৌপরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়নের প্রথম পথপ্রদর্শক বলে উল্লেখ করেন নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী।
সাবেক সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট মীর শওকত আলী বাদশার ভাষ্যে বঙ্গবন্ধুর নদীপ্রেম ফুটে ওঠে। ১৯৭৩ সালের শেষভাগে নগরবাড়ী-আরিচা ও নগরবাড়ী-দৌলতদিয়া নৌপথের ড্রেজিং কার্যক্রম উদ্বোধনে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গী ছিলেন তিনি। নগরবাড়ী ঘাট এলাকায় প্রমত্ত যমুনায় ড্রেজিং কার্যক্রম উদ্বোধনের পর সেখানে এক সংক্ষিপ্ত সমাবেশে বঙ্গবন্ধু সেদিন বলেছিলেন, ‘নদীমাতৃক এ দেশের সাধারণ মানুষের যাতায়াত ও পণ্য পরিবহনের প্রধান মাধ্যম নৌপথ। কৃষিতে সেচকাজে নদনদীর পানি ব্যবহার করে কৃষক। মাঝিরা নদীতে নৌকা বেয়ে জীবিকা নির্বাহ করে। জেলেরা বংশপরম্পরায় নদীতে মাছ ধরে বেঁচে আছে।
এ নদীকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের শহর, বন্দর, নগর, ব্যবসা-বাণিজ্যকেন্দ্র গড়ে উঠেছে।’ ওই বছর (১৯৭৩ সাল) নেদারল্যান্ডস থেকে উপহার হিসেবে দুটি ড্রেজার পাওয়ায় দেশটির প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বঙ্গবন্ধু সেদিন বলেন, ‘নেদারল্যান্ডস সরকারের এ উপহার আমার যুদ্ধবিধ্বস্ত সোনার বাংলা পুনর্গঠনে সহায়ক হবে।’
নৌ খাতে শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়নে বঙ্গবন্ধুর অবদান প্রসঙ্গে নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী আরো বলেন, বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে ১৯৭৩ সালে তৎকালীন সোভিয়েত প্রজাতন্ত্রের আর্থিক ও কারিগরি সহায়তায় চট্টগ্রামে প্রতিষ্ঠা করা হয় মেরিন ফিশারিজ একাডেমি। এ একাডেমি প্রতিষ্ঠার মূল লক্ষ্য ছিল সাগর ও গভীর সমুদ্র থেকে মৎস্য আহরণের জন্য প্রযুক্তি জ্ঞানসম্পন্ন প্রয়োজনীয় জনবল তৈরি এবং দেশের চাহিদা মিটিয়ে একাডেমির ডিগ্রিধারী দক্ষ জনবল বিদেশে রপ্তানি করে রেমিট্যান্স অর্জন।
মেরিন ফিশারিজ একাডেমি থেকে স্নাতক ডিগ্রিধারী প্রকৌশলীরা এখন দেশের সরকারি-বেসরকারি নৌ সংস্থায় চাকরির পাশাপাশি বিদেশে সমুদ্রগামী জাহাজে চাকরি করছেন। প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা পাঠাচ্ছেন তারা। বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশন (বিএসসি) প্রতিষ্ঠা করেন।
এটি রাষ্ট্রায়ত্ত একটি বাণিজ্যিক সংস্থা। সংস্থাটির মূল কাজ এর নিজস্ব বহরে থাকা সমুদ্রগামী জাহাজ পরিচালনা করা। সমুদ্রপথে বিদেশ থেকে পণ্য আমদানি এবং বাংলাদেশ থেকে বিদেশে রপ্তানির ক্ষেত্রে বিএসসি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সেসব পণ্যের একটি বড় অংশ এ সংস্থার জাহাজগুলোয় পরিবহন হয়ে থাকে। এসব কারণে বিশ্বের বিভিন্ন সমুদ্রবন্দরে এখন বিএসসির মালিকানাধীন বাংলাদেশি পতাকাবাহী জাহাজ দেখা যায়। তথ্যসূত্র : বাসস।
ভোরের আকাশ/নি