শাহীন রহমান: গরিবের পুষ্টির অন্যতম উৎস ডিম। বাজারে যখন চড়া দ্রব্যমূল্যের কারণে সাধারণ ক্রেতার মাথায় হাত, তখনো ডিমের দাম ক্রয়ক্ষমতার মধ্যেই ছিল। কিন্তু সম্প্রতি লাগামহীন দাম বেড়ে যাওয়ায় প্রান্তির জনগোষ্ঠীর পুষ্টির প্রধান উৎস হাতছাড়া হতে চলেছে। ডিমের দাম এখন প্রতি ডজন ১৭০ টাকা করে বিক্রি হচ্ছে।
বিক্রেতারা জানান, আগামী কয়েকদিনের ডিমের দাম আরো বেড়ে যাওয়ার বার্তা পেয়েছেন তারা। দোকানিরা বলছেন, এখনই লাগাম টানা না গেলে ডিমের ডজন ২০০ টাকা পার হয়ে যাওয়া সময়ের ব্যাপার মাত্র।
এ কথা সর্বজনবিদিত, প্রোটিনের ভালো উৎস ডিম। ডিম শরীরের জন্য খুবই উপকারী। কেউ হাঁসের ডিম খেতে পছন্দ করেন, কেউ আবার মুরগির। দবে বাজারে খামারের মুরগির দাম এতদিন বেশি সস্তায় হওয়ায় বেশিরভাগ মানুষ চাহিদা এ ডিমের প্রতি।
পুষ্টিবিদদের মতে, একটি বড় ডিমের ওজন প্রায় ৫০ গ্রাম হয়ে থাকে। একটি সেদ্ধ ডিম থেকে যেসব পুষ্টি উপাদান পাওয়া যায় তার মধ্যে ৭৭ গ্রাম ক্যালরি পাওয়া যায়। ডিম দীর্ঘসময় শক্তি জোগায় এবং ক্ষুধা কমায়। তাই ওজন নিয়ন্ত্রণের জন্য ডায়েটে ডিম রাখা জরুরি। সকালের নাশতায় একটি ডিম সারা দিনের পুষ্টি চাহিদা অনেকটুকুই পূরণ করতে সহায়তা করে। একটি ডিম থেকে প্রায় ৬.৩ গ্রাম উচ্চমানের প্রোটিন পাওয়া যায়। ডিমের প্রোটিন শরীরে খুব সহজে শোষিত হয়। শরীরের গঠন ও ক্ষয়পূরণের জন্য প্রোটিন অত্যাবশ্যকীয়।
এছাড়া প্রোটিন বিভিন্ন অঙ্গ, ত্বক, চুল এবং শরীরের বিভিন্ন টিস্যু পুনর্গঠনে সহায়তা করে। তবে পুষ্টির এ সহজলভ্য উৎস গরিবের হাত ছাড়া হতে চলেছে। রাজধানীতে প্রতিদিনই বেড়ে চলছে বিভিন্ন নিত্যপ্রণ্যের দাম। এর মধ্যে ডিমের দাম বাড়ছে লাগামহীনভাবে। এতে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত মানুষের কপালে পড়েছে দুশ্চিন্তার ভাঁজ।
তবে এ মুহূর্তে ডিমের দাম কেন বাড়ল স্বাভাবিকভাবেই সবার মনে প্রশ্ন জেগেছে। ডিমের দাম এভাবে বেড়ে যাওয়ায় প্রান্তিক খামারিদের সংগঠন বাংলাদেশ পোলট্রি অ্যাসোসিয়েশন (বিপিএ) পক্ষ থেকে বড় আশঙ্কার কথা শোনানো হয়েছে। সংগঠন থেকে এ বিষয়ে প্রেস বিজ্ঞপ্তিও জারি করা হয়েছে। এতে করপোরেট সিন্ডিকেট ভাঙতে না পারলে ডিমের দাম আরো বাড়বে এমন আশঙ্কার কথাই জানানো হয়েছে।
সংগঠনের সভাপতি সুমন হাওলাদার স্বাক্ষরিত বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ডিম ও মুরগির দাম বেড়ে বাজারে অস্থিরতা সৃষ্টির অন্যতম কারণ প্রান্তিক পর্যায়ের অধিকাংশ ছোট ছোট খামার বন্ধ হয়ে যাওয়া। এ কারণে সরবরাহ ঘাটতি তৈরি হয়েছে, যার প্রভাব পড়ছে বাজারে। আর এ খাতে করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যবসায় সরকারি তদারকি না থাকায় পোলট্রি শিল্পে তাদের আধিপত্য বেড়েছে, যার খেসারত দিচ্ছে জনগণ।
সুমন হাওলাদার বলেন, ছোট খামারি ও ডিলাররা পোলট্রি শিল্পের বিকাশ ঘটালেও তারা অসহায়। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত ৫০ লাখ প্রান্তিক উদ্যোক্তার অধিকাংশই ব্ল্যাঙ্ক চেকের মাধ্যমে জিম্মি হয়ে পড়েছেন কোম্পানির দাদন ব্যবসার কাছে। বর্তমানে প্রান্তিক পর্যায়ে একটি ডিমের উৎপাদন খরচ ১০ টাকা ৮৭ পয়সা থেকে ১১ টাকা পর্যন্ত। ১ কেজি ব্রয়লার মুরগির উৎপাদন খরচ ১৭০ থেকে ১৭৫ টাকা। কিন্তু প্রান্তিক খামারিদের বাধ্য হয়ে ২০ থেকে ২৫ টাকা কমে ১৩০ থেকে ১৪০ টাকায় মুরগি বিক্রয় করতে হচ্ছে।
সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, উৎপাদন খরচ যাচাই করে পোলট্রি ফিডের দাম কমানোর উদ্যোগ নেয়া উচিত সরকারের। ২০২১ সালে ১ কেজি ভুট্টার দাম ছিল ২৮ টাকা, ৫০ কেজির ১ বস্তা পোলট্রি খাবারের দাম ছিল ২ হাজার ৫০০ টাকা। ২০২২ সালের শুরুতে ভুট্টার দাম ছিল ২৮ টাকা, আর ৫০ কেজির ১ বস্তা খাবারের দাম ছিল ২ হাজার ৭০০ টাকা।
২০২২ সালে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের দোহাই দিয়ে লাগামহীনভাবে খাবারের দাম বাড়িয়ে দেয়া হয়। গত ফেব্রুয়ারিতে ভুট্টার দাম হয় ৪১ টাকা কেজি। আর পোলট্রি খাবারের ৫০ কেজি বস্তার দাম পৌঁছায় ৩ হাজার ৭৪০ টাকায়। এতে বলা হয়, চলতি বছরের মার্চ মাসে ভুট্টার দাম কমে দাঁড়ায় ২৪ থেকে ২৬ টাকা কেজি।
অথচ পোলট্রি খাবারের দাম কেজিপ্রতি ২৫ টাকা বাড়ানোর পরে কমানো হয়েছে মাত্র ৩ টাকা। খাবার প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানের সিন্ডিকেট ভেঙে দেয়ার পাশাপাশি বাজারে ডিম ও মুরগির দাম যৌক্তিক পর্যায়ে রাখতে প্রান্তিক খামারিদের উৎপাদিত পণ্যের উপযুক্ত মূল্য নিশ্চিতের দাবি জানিয়েছে বিপিএ।
এদিকে শুধু ডিমের দাম নয়। অস্বাভাবিকহারে দাম বেড়েছে সোনালি মুরগির দামও। কিছুদিন আগেও যেখাকে কেজি প্রতি মুরগি বিবিক্রি করা হয়েছে ২৪০ টাকা কেজি। বর্তমানের প্রতি কেজির দাম ৩২০ টাকার বেশি বিক্রি হচ্ছে। ব্রয়লার মুরগি ১৮০ থেকে ১৯০ টাকা কেজি বিক্রি হচ্ছে। অথচ এগুলোই গরিবে উৎস হিসেবে বিবেচিত। লাগামহীনভাবে দাম বেড়ে যাওয়া সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে। তাদের কপালে চিন্তার ভাজ স্পষ্ট হচ্ছে। তারা বলছেন, বিরামহীনভাবে দগাম বাড়লে সিন্ডিকেট ভাঙার কেই নেই। গরিবের কথাটি সরকারের মাথায় নেই।
এছাড়া এখন চলছে ইলিশ মাছের ভরা মৌসুম। কিন্তু বাজারের দামে এর কোনো প্রভাব নেই। বাজারে ৬০০ বা ৭০০ গ্রামের ইলিশ বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার থেকে ১ হাজার ২০০ টাকায়। ৯০০ গ্রাম থেকে ১ কেজি বা তারও বেশি ওজনের ইলিশের কেজি ১ হাজার ৬০০ থেকে ১ হাজার ৮০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। একইসঙ্গে বাজারে রুই-কাতলা ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। আর তেলাপিয়া, পাঙ্গাসের কেজি ২২০ থেকে ২৫০ টাকা। গরুর মাংসের কেজি বাজারভেদে ৭৫০ থেকে ৭৮০ টাকা। খাসির মাংসের কেজি ১১০০ টাকা।
কাঁচামরিচের ঝাঁঝ এখনো কমেনি। মিরপুর বিভিন্ন বাজারের অনুসন্ধ্যা করে দেখা গেছে, দেশি কাঁচামরিচের জোগান নেই বললেই চলে। বাজার ভর্তি ইন্ডিয়ান মরিচ। দাম চড়া। আড়াই গ্রাম মরিচের দাম রাখা হচ্ছে ৬০ টাকার। কেজিতে বিক্রি করা হচ্ছে ২৪০ থেকে ২৫০ টাকা কেজি দরে। শাকসবজির মধ্যে ৪০ টাকা দরে পাওয়া যাচ্ছে পটোল আর ঢ্যাঁড়শ।
তবে করলা বিক্রি করা হচ্ছে প্রতি কেজি টাকা দরে। বেগুনের লম্বাটা ৬০ টাকা কেজি এবং গোল বেগুন বিক্রি হচ্ছে ৮০ টাকা দরে। পেঁপের দাম ৪০ টাকা কেজি। কুমড়া কেজি ৪০ টাকায়। আলুর কেজি ৪০ টাকা। ঝিঙা ৮০ টাকা, বরবটি ১০০ টাকা, শসা ৫০ থেকে ৮০ টাকা, গাজর ১৬০ টাকা, কাঁচকলার হালি ৪০ টাকা। পেঁয়াজের দাম প্রতি কেজি ৮০ টাকা। তবে সরকার বলছে দেশে পর্যপ্ত পেয়াজের সরবরাহ রয়েছে। কিন্তু দাম নিয়ন্ত্রণের সরকারের কোনো পদক্ষেপ নেই। দ্রব্যমূল্যে এ চাপ সম্পূর্ণ বহন করতে হচ্ছে সাধারণ জনগণকে।
বাজারের মসলার দাম এখনো চড়া। বাজারের প্রতি জেরা বিক্রি হচ্ছে ১১০০ টাকায়। এছাড়া এলাচ, লবঙ্গ দারুচিনির দাম বেশ চড়া। আদার কেজি ১৮০ টাকা। চাল, ডাল, আটা, ময়দা, চিনি, সয়াবিন তেলের মতো অধিকাংশ নিত্যপণ্যের দাম আকাশচুম্বী। প্রতি লিটার সয়াবিন বিক্রি হচ্ছে ১৮০ টাকায়। বোতলজাত পামওয়েলের লিটার ১৫০ টাকা। প্যাকেটজাত চিনি ১৫০ টাকা।
আগের বাড়তি দামেই গরুর মাংসের কেজি বাজারভেদে ৭৫০ থেকে ৭৮০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। খাসির মাংসের কেজি ১ হাজার ১০০ টাকা পর্যন্ত। দেশি প্রতি কেজি মুরগি বাজারভেদে ৫৫০ থেকে ৬০০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। মসুর মোটা ডালের কেজি ১০০ টাকা, চিকন ডাল ১৩০ থেকে ১৪০ টাকা, মুগ ডাল ১৩০ টাকা। ছোলার ডাল ৯০ টাকা কেজি। রসুনের দাম বেড়েছে। সব রসুনের কেজি এখন ২২০ থেকে ২৩০ টাকা।
ভোরের আকাশ/নি