এম সাইফুল ইসলাম: বিএনপির সরকারবিরোধী আন্দোলন ‘চূড়ায়’ পৌঁছালে শক্তভাবে মাঠ নামার পরিকল্পনা করছে জামায়াত। দলটির নেতারা ইতোমধ্যে এ বার্তা সারা দেশে পৌঁছে দিয়েছেন। লাভ-ক্ষতির হিসাব মেলানো ও মাঠে নামতে সঠিক সময় নির্ধারণে বিএনপির আন্দোলনের ওপর ‘বিশেষ নজর’ রাখছেন জামায়াত নেতারা।
শেষ পর্যন্ত এককাতারে বা যুগপৎভাবে হলেও সরকারবিরোধী আন্দোলনে যুক্ত হবে জামায়াত। নানা মান-অভিমান ভুলে বিএনপি নেতাদের সঙ্গে ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন এগিয়ে নিতে ফের জামায়াতের বৈঠক হয়েছে বলেও খবর রটেছে।
জামায়াতের কেন্দ্রীয় একাধিক নেতা বলেছেন, দেশে গণতন্ত্র ও ভোটাধিকার ফিরিয়ে আনতে তৎপর রয়েছেন তারা। নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি আদায়ে ‘আপসহীন’ থাকার ঘোষণা দিয়ে তারা বলছেন, শেষ পর্যন্ত জামায়াত শক্তভাবে মাঠে নামবে। আর বিএনপির সঙ্গে বৈঠকের বিষয়ে তারা কৌশলী বক্তব্য দিচ্ছেন।
জানা গেছে, ক্ষমতার মেয়াদ শেষ হওয়ার পর প্রায় দুই বছর ১/১১-র পরিস্থিতি পার করে ফের ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে জোটগতভাবে ভোট করে বিএনপি-জামায়াত। ওই ভোটে আওয়ামী লীগের কাছে হেরে যায় জোটটি। এরপর সরকার গঠন করে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার শুরু করে আওয়ামী লীগ। সেই বিচারে জামায়াতের জ্যেষ্ঠ ৯ নেতার বিরুদ্ধে রায় কার্যকর করা হয়েছে।
এছাড়া ২০১৩ সালের আগস্টে সর্বোচ্চ আদালত জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল করলে দলটি নিজস্ব প্রতীক ‘দাঁড়িপাল্লা’ নিয়ে ভোট করার ক্ষমতাও হারিয়ে ফেলে। নেতাদের বিরুদ্ধে রায় ঘোষণা ও কার্যকর করা এবং ২০১৪ সালে নির্বাচন ঠেকানো ইস্যুতে জ্বালাও পোড়াও আন্দোলনের ঘটনায় অসংখ্য মামলার ঘানি টানতে শুরু করেন দলটির নেতাকর্মীরা।
২০১৪ সালের নির্বাচনের পর জামায়াত নিজেদের মাঠের রাজনীতিতে গুটিয়ে নিয়ে ‘দাওয়াতি’ ও সামাজিক কর্মকান্ডে ব্যস্ত থাকে। ২০১৮ সালের নির্বাচনের পর পরাজিত হয়ে দলটি বিভিন্ন সেক্টরে দক্ষ লোকবল সৃষ্টির মিশনে মাঠে নামে। ইতোপূর্বে আন্দোলনে বিএনপিকে পাশে না পাওয়াসহ নানা অবিশ্বাস ও মান-অভিমানে ২০১৮ সালের নির্বাচনের পর ২০-দলীয় জোটও অকার্যকর হয়ে পড়ে। বিএনপিও অনেকটাই ‘একলা চলো’ নীতিতে এগোতে থাকে। সেই প্রেক্ষাপটে গত বছরের ২৭ আগস্ট জামায়াতের আমির ডা. শফিকুর রহমান বিএনপি জোট ছাড়ার ঘোষণা দেন।
২০২২ সালের ৯ ডিসেম্বর গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে জোটের এক অনানুষ্ঠানিক সভায় বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট কার্যত ভেঙে দেয়া হয়। ১০ ডিসেম্বর রাজধানীর জনসভায় ১০ দফা দাবি আদায়ে কর্মসূচি ঘোষণা করে বিএনপি। এরপর গণতন্ত্র মঞ্চ, ১১ দলীয় জোট, জাতীয়তাবাদী সমমনা জোটসহ কয়েকটি দল নিজস্বভাবে বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ কর্মসূচি পালনের ঘোষণা দেন। ওই দিন বিকেলেই জামায়াতের আমির ডা. শফিকুর রহমান বিএনপির কর্মসূচির সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করে বক্তব্য দেন। দুই দিন পর জামায়াতের আমির গ্রেপ্তার হলেও বিএনপি কোনো বিবৃতি না দেয়ায় জামায়াত বেশ মনোক্ষুণ্ণ হয়।
প্রথমদিকে বিএনপির যুগপৎ কর্মসূচিতে মাঠে ছিল জামায়াত। যুগপৎ কর্মসূচির প্রথমেই ৩০ ডিসেম্বর গণমিছিল পালনকালে রাজধানীর মৌচাকে পুলিশের সঙ্গে জামায়াত কর্মীদের সংঘর্ষের ঘটনায় বিএনপির পক্ষ থেকে কোনো বিবৃতি দেয়া বা খোঁজখবর না নেয়ায় জামায়াত-বিএনপি সম্পর্কে ফের টানাপড়েন শুরু হয়।
এছাড়া কর্মসূচি গ্রহণে জামায়াতের কোনো পরামর্শ না নেয়ায় বিএনপির প্রতি ক্ষুব্ধ হন দলটির নেতারা। ২০১৩-১৪ সালের মতো বিএনপিকে আন্দোলনে পাশে না পাওয়ার অভিজ্ঞতায় ফের যুগপৎ কর্মসূচিতে অংশ না নিয়ে নিজদের মতো চলতে থাকে দলটি।
দীর্ঘদিন এভাবে নীরবতা পালনের পর বাংলাদেশে অবাধ, নিরপেক্ষ ভোটে বাধা প্রদানকারীদের বিষয়ে গত ২৪ মে যুক্তরাষ্ট্র ভিসানীতি ঘোষণার পর নড়েচড়ে বসে জামায়াত। দলটি ৫ জুন রাজধানীর বায়তুল মোকাররম মসজিদের উত্তর গেটে বিক্ষোভ সমাবেশের ঘোষণা দেয়। পরে এই সমাবেশের অনুমতির আবেদন নিয়ে ডিএমপি কার্যালয়ে যান দলটির কয়েকজন আইনজীবী।
তাদের প্রথমে আটক করলেও পরবর্তীতে ছেড়ে দেয় পুলিশ। ৫ জুন জামায়াতকে পুলিশ সমাবেশের অনুমতি না দিলে দলটি কর্মসূচি পালন থেকে সরে এসে আবারো ১০ জুন কর্মসূচি পালনে অনুমতি চেয়ে আবেদন দেয়। পরে জামায়াতকে রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিশনে সমাবেশের অনুমতি দেয়। সমাবেশের আগের দিন রাতে অনুমতি দিলেও দলটির বিপুল সংখ্যক নেতাকর্মী সমাবেশে যোগ দেয়।
২০১৩ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি ঢাকার মতিঝিলে পুলিশের অনুমতি নিয়ে বড় ধরনের শোডাউন করেছিল বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। এর পর প্রকাশ্যে কোনো কর্মসূচি করার সুযোগ না পেয়ে মাঝে মধ্যেই ঝটিকা মিছিল আর ঘরোয়া কর্মসূচি পালন করেছে জামায়াত।
১০ জুনের ওই সমাবেশের পর নতুন করে আলোচনায় আসে জামায়াত। পর দলটিকে ভিসানীতির প্রভাবে পুলিশ সমাবেশ করতে দিতে বাধ্য হয়েছে বলে আলোচনা শুরু হয়। আবার আগামী নির্বাচন সামনে রেখে জামায়াতের সঙ্গে সরকারের কোনো আপস কিনা তা নিয়েও আলোচনা শুরু হয়। অবশ্য পরবর্তীতে দলটি সিলেট ও চট্টগ্রামে এবং ফের ঢাকায় সমাবেশ করতে চেয়ে অনুমতি না পাওয়ায় জামায়াতকে নিয়ে সন্দেহ বা অবিশ্বাস আর হালে পানি পায়নি।
জামায়াতের একাধিক সূত্র জানিয়েছে, মূলত ভোটাধিকার ফিরিয়ে আনতে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলনের জন্য সক্রিয় হচ্ছে দলটি। গত ১০ দিনের জামায়াতের কর্মতৎপরতায় দেখা গেছে, কেন্দ্রীয় নেতারা বিভিন্ন জেলার নেতাদের নিয়ে যে ‘দায়িত্বশীল বৈঠক’ বা প্রশিক্ষণ কর্মশালা করেছেন, সেখানে প্রাধান্য পেয়েছে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যু।
কারণ জনরায়ে সরকার পরিবর্তনের সুযোগ না হওয়া পর্যন্ত জামায়াত যে বিপর্যয়ের মধ্যে থাকবে সেটি দলটির নেতাদের কাছে স্পষ্ট। তারা মনে করছেন, বর্তমান সরকার ফের ক্ষমতায় আসতে পারলে আগামীতে জামায়াতের অস্তিত্ব আরো সংকটে ফেলতে সব পদক্ষেপ নেয়া হবে। এছাড়া তৃণমূলের নেতাদের নামে থাকা সব রাজনৈতিক মামলায় বিচারকাজ শেষ করবে সরকার।
দলটির পর্ববেক্ষণ, পশ্চিমা দেশসমূহ ছাড়া বিশ্বের গণতন্ত্রকামী বেশিরভাগ দেশ এখন নিরপেক্ষ নির্বাচনের ব্যাপারে কথা বলছে। একটি অবাধ নির্বাচনের ব্যাপারে সরকারের ওপর নিকট অতীতে এভাবে চাপও সৃষ্টি হয়নি। তাই এই ইস্যুতে আন্দোলনের মোক্ষম সময় বলেও মনে করছে জামায়াত। বিএনপিসহ যেসব দল নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে ‘এক দফা’ আন্দোলনে আছে, সেখানে জামায়াতেরও সক্রিয়ভাবে আন্দোলনে থাকা জরুরি বলে দলটির উপলব্ধি। সেজন্য আন্দোলনে মাঠ ঘোছাতে দলটির কেন্দ্রীয় নেতাদের সমন্বয়ে প্রতিদিন কোনো না কোনো জেলায় কর্মসূচি পালিত হচ্ছে।
জানা গেছে, বিএনপির আন্দোলন টিকে থাকার মতো বা সরকারকে চ্যালেঞ্জের মতো পর্যায়ে গেলে সেই আন্দোলনে সর্বশক্তি দিয়ে মাঠে নামতে চায় জামায়াত। রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু না থাকলেও ইতোমধ্যে দলটির তৃণমূল স্পষ্ট যে, এই সরকারের অধীনে জামায়াত নির্বাচনে যাচ্ছে না। আগামীতে বিএনপির আন্দোলন একটা পর্যায়ে গেলে নেতাকর্মীদের মাঠে থাকার স্পষ্ট বার্তা দিয়েছে কেন্দ্রীয় জামায়াতের নেতারা। দলটির তৃণমূল থেকে কেন্দ্রীয় একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্যের সত্যতাও পাওয়া গেছে।
এদিকে, দীর্ঘদিনের মিত্র জামায়াতের সঙ্গে দূরত্ব কমাতে বিএনপির হাইকমান্ড কাজ করছে বলে জানা গেছে। দুই দলের শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের সম্প্রতি বৈঠকের খবরও প্রকাশিত হয়েছে। একটা পর্যায়ে গিয়ে এককাতারে এসে নাকি যুগপৎভাবে আন্দোলন চলবে, তা নিয়েও কথাবার্তা চলছে দল দুটির নেতাদের মধ্যে।
রাজধানীর রমনা থানা জামায়াতের সেক্রেটারি আতিকুর রহমান ভোরের আকাশকে বলেন, অতীতে জামায়াত নেতাদের বিরুদ্ধে রায় দেয়াসহ একটা কঠিন সময়ে বিএনপিকে আমরা পাশে পাইনি। ন্যূনতম কোনো রাজনৈতিক সৌজন্যবোধ দেখাননি বিএনপি নেতারা। তারা সেটি উপলব্ধি করে এখন এগিয়ে আসছেন। অভিমান থাকলেও বিএনপি এগিয়ে এলে জামায়াতের দিক থেকে কোনো প্রতিবন্ধকতা নেই। জাতীয় স্বার্থে মাঠে নামতে আমাদরকে প্রস্তুত থাকতে বলা হয়েছে।
বিষয়টি নিয়ে যশোর জেলা জামায়াতের কর্মপরিষদ সদস্য ও শিক্ষা, সহিত্য ও সংস্কৃতিবিষয়ক সম্পাদক ফজলুল হক ভোরের আকাশকে বলেন, ভোটাধিকার ও গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার আন্দোলনে মাঠে আছে জামায়াত। আগামীতেও মাঠে থাকবে। তিনি বলেন, মানুষ ভোট দিতে চায়। সে চাওয়া-পাওয়ায় রূপান্তর করতে দলের নেতাকর্মীরা অগ্রণী ভূমিকা রাখবেন।
জামায়াতের কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য মাওলানা আজীজুর রহমান ভোরের আকাশকে বলেন, মানুষের ভোটাধিকার ফিরিয়ে আনার প্রশ্নে জামায়াত সমসময় অগ্রসর ছিল। কারণ, সবকিছুর মূলে হচ্ছে গণতন্ত্র। ভোটাধিকার প্রয়োগের মাধ্যমে জনপ্রতিনিধি নির্বাচনের সুযোগ না থাকলে সেখানে গণতন্ত্র থাকে না। সেটি এখন বাংলাদেশে বিরাজমান।
এ অবস্থার উত্তরণে দেশপ্রেমিক সব শক্তির সঙ্গে জামায়াতও আপসহীনভাবে মাঠে থাকবে। বিএনপির বা অন্য কারো সঙ্গে এই ইস্যুতে আলোচনার ব্যাপারে তিনি জানেন না বলে দাবি করেন।
আর জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য ও প্রচার সম্পাদক মতিউর রহমান আকন্দ বলেন, আমরা আন্দোলনে আছি। মানুষের ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠায় জামায়াত অগ্রণী ভূমিকা রাখবে। এই ইস্যুতে কোনো আপস করা বা ছাড় দেয়ার সুযোগ নেই।
তবে বিএনপির সঙ্গে বৈঠক বা আন্দোলনের বিষয়ে তিনি কৌশলী উত্তর দিয়েছেন। তিনি বলেন, কেয়ারটেকার ইস্যুতে যারাই মাঠে আছে বা কথা বলছে, জামায়াত তাদের সঙ্গেই আছে।
ভোরের আকাশ/নি