logo
আপডেট : ১৭ আগস্ট, ২০২৩ ১৪:৪৪
উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ন্যূনতম বিশেষায়িত চিকিৎসা সুবিধা নেই
নিখিল মানখিন

উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ন্যূনতম বিশেষায়িত চিকিৎসা সুবিধা নেই

সরকারি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোতে বিশেষায়িত চিকিৎসাসেবার ন্যূনতম সুুযোগ-সুবিধা নেই। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যসেবার উচ্চ ব্যয়ের চাপ কমাতে উপজেলাকেন্দ্রিক একটি শক্তিশালী স্বাস্থ্য ও চিকিৎসাসেবা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। প্রতিটি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে একাধিক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পদ রয়েছে। কিন্তু তাদের পদ খালি। অ্যানেস্থেসিয়া, গাইনি ও সার্জারি চিকিৎসকের অভাবে অপারেশন চলে না। প্রাইমারি চিকিৎসাসেবার কেন্দ্র হিসেবেই ভূমিকা রেখে আসছে উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলো। ফলে ছোট সমস্যা নিয়েও গ্রামাঞ্চলের রোগীদের ছুটে যেতে হয় বিভাগীয় ও জেলা পর্যায়ের হাসপাতালগুলোতে।

 

বিশেষজ্ঞরা বলেন, দেশের স্বাস্থ্য ও চিকিৎসাসেবা প্রদানে উপজেলা স্বাস্থ্যকমপ্লেক্সগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। এসব প্রতিষ্ঠানের অপারেশন থিয়েটারে টিউমার, ফোঁড়া, অর্থোপেডিকসসহ বিভিন্ন ছোট ও মাঝারি অপারেশনের ব্যবস্থা থাকার কথা রয়েছে। শুধু তাই নয়, প্রতিটি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গাইনি, মেডিসিন, শিশু, কার্ডিওলজি, অর্থোপেডিকস, সার্জারি, চর্ম ও যৌন, চক্ষু, নাক-কান ও গলা বিশেষজ্ঞসহ ১১ জন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পদ রয়েছে। পদসমূহ খালি রয়েছে।

 

চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যসেবার উচ্চ ব্যয়ের চাপ কমাতে সরকারি উদ্যোগে উপজেলা পর্যায়ে বিশেষায়িত চিকিৎসাসেবার পরিধি বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, চিকিৎসা ব্যয় ও ওষুধের দামও লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েই চলেছে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহের উন্নত চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যসেবা ব্যয় দেশের অধিকাংশ মানুষের নাগালের বাইরে। তার চাপ গিয়ে পড়ছে বিনামূল্যে বা নামমাত্র খরচে স্বাস্থ্য ও চিকিৎসাসেবা প্রদানকারী সরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহের ওপর। সরকারি হাসপাতালের তুলনায় অনেক গুণ বেশি চিকিৎসা খরচ হয়ে থাকে বেসরকারি হাসপাতালে। আর্থিক সংকটে জটিল রোগে আক্রান্ত রোগীর অকালে মৃত্যুর ঘটনাও বিরল নয়। এমতাবস্থায় বেসরকারি হাসপাতালগুলোর চিকিৎসাসেবার উচ্চ ব্যয় থেকে দরিদ্র জনগণকে বাঁচাতে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।

 

স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ডা. ইকবাল আর্সলান ভোরের আকাশকে বলেন, বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবার অবকাঠামো ও উন্নয়ন অতুলনীয় এবং বিশ্বের জন্য অনুকরণীয় হয়ে উঠেছে। কেন্দ্র থেকে মফস্বল পর্যন্ত তথ্যপ্রযুক্তিতে সাজানো হয়েছে। স্বাস্থ্যসেবার এমন অবকাঠামো বিশ্বের কোথাও নেই। তিনি বলেন, দেশের স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা ব্যয় বিবেচনায় সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহের মধ্যে অনেক পার্থক্য বিদ্যমান। দেশের বেসরকারি চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান চালু রাখা অনেক ব্যয়বহুল। তাই ওইসব প্রতিষ্ঠানে খরচও অনেক। তবে থানা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোতে সীমিত পরিসরে হলেও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ও সার্জারি নিশ্চিত করা গেলে সাধারণ মানুষের বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে যাওয়ার স্রোত হ্রাস পেত।

 

ডক্টরস ফর হেলথ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টের সাবেক সভাপতি অধ্যাপক রশিদী-ই মাহবুব ভোরের আকাশকে বলেন, সরকারি উদ্যোগে জেলা ও থানা পর্যায়ে বিশেষায়িত চিকিৎসাসেবার পরিধি বাড়াতে হবে। থানা পর্যায়ে উন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থা থাকলে মানুষ অর্থ ব্যয় ও কষ্ট করে জেলা পর্যায়ে যাবে না। আর জেলা পর্যায়ে পর্যাপ্ত সরকারি ব্যবস্থা থাকলে বিভাগীয় পর্যায়ে যাবে না। এটা তো সহজ হিসাব।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ডা. শারফুদ্দিন আহমেদ ভোরের আকাশকে বলেন, টাকার অভাবে উন্নত চিকিৎসাসেবা গ্রহণ করতে পারে না এমন মানুষের সংখ্যা কম নয়। সারা দেশে নামমাত্র খরচে চিকিৎসাসেবা প্রদান, ওষুধ বিতরণ, রোগীদের খাওয়া-দাওয়া ইত্যাদি সেবা দিয়ে যাচ্ছে সরকার। সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি উদ্যোক্তাদেরও এগিয়ে আসা উচিত। সরকারি উদ্যোগে থানা পর্যায়ে বিশেষায়িত চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত হলে বেসরকারি চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানে রোগীদের যাওয়া কমে যাবে।

 

সম্প্রতি একটি অনুষ্ঠানে উপজেলা, ইউনিয়ন এবং কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোতে রোগীর সেবার মানের মৌলিক পরিবর্তন আনতে জরিপভিত্তিক বেশ কিছু সুপারিশ তুলে ধরেন সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী অধ্যাপক ডা. আ ফ ম রুহুল হক, এমপি। তিনি বলেন, উপজেলা হাসপাতালে পদ থাকা সত্ত্বেও বেশিরভাগ পদ খালি থাকে। স্থানীয়ভাবে শূন্য পদগুলোতে সাথে সাথে নিয়োগ দেয়া সম্ভব, অনেক দেশেই এ ব্যবস্থা আছে। আমাদের জন্য কোন ব্যবস্থাটি সঠিক তা নির্ধারণ করতে হবে। হাসপাতালের ভর্তি রোগীরা প্রায় সব ঔষধ বিনা পয়সায় পেয়ে থাকে কিন্তু বহির্বিভাগের রোগীদের জন্য ওষুধ বরাদ্দ খুব কম। এ বিষয়ে পরির্বতন আনতে হবে। এছাড়া নানাবিধি অসুবিধার কারণে মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও বিশেষায়িত হাসপাতালে অনেক বেশি রোগীর ভিড় থাকায় রোগীদের মানসম্মত চিকিৎসা দেয়া যাচ্ছে না। উপজেলা হাসপাতালে রোগীরা ডাক্তার পায় না, ঠিকমত ওষুধ পায় না। ফলে তারা জেলা ও মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভিড় করে। যে কারণে এসব হাসপাতালে একসঙ্গে অনেক রোগী থাকায় আমরা মানসম্মত চিকিৎসা সেবা দিতে পারছি না। চিকিৎসাসেবায় কমিউনিটি ক্লিনিক থেকে ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্র হয়ে রোগীদের উপজেলা ও জেলাভিত্তিক ইনডোর স্বাস্থ্যসেবা পেতে ডিজিটাল রেফারেল সিস্টেম চালু করতে হবে এবং অপেক্ষাকৃত জটিল রোগের জন্য উপজেলা থেকেই জেলা, বিভাগীয় ও বিশেষায়িত হাসপাতালগুলোতে রেফারেল সিস্টেমের মাধ্যমে রোগী পাঠানোর ব্যবস্থা করতে হবে বলে জানান সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী।

 

সম্প্রতি স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক সাংবাদিকদের বলেন, উপজেলা পর্যায়ের সরকারি স্বাস্থ্যসেবার মান দ্বিগুণ বাড়ানো হচ্ছে। উপজেলা পর্যায়ের সরকারি হাসপাতালের কাক্সিক্ষত সেবা বাদ দিয়ে দেশের মানুষের স্বাস্থ্যসেবার মানোন্নয়ন সম্ভব নয়। অথচ উপজেলা পর্যায়ের স্বাস্থ্যসেবাতেই আমাদের মূল ঘাটতি রয়ে গেছে। উপজেলা পর্যায়ের সরকারি স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রগুলোর অনেক জায়গাতেই মেশিন নষ্ট ছিল। কিছু জায়গায় তো মেশিনই ছিল না। লোকবলের তীব্র অভাব ছিল। উপজেলা পর্যায়ে ডাক্তাররা বদলি নিয়ে ঢাকা বা জেলা পর্যায়ে চলে যেতেন। এগুলো আমরা আগে বুঝতে পারিনি। দেশের ৮টি বিভাগের বিভাগীয় পর্যায়ের স্বাস্থ্যসেবার মান সরেজমিনে পরিদর্শন করে ও ঘুরে ঘুরে দেখে এগুলো আমরা জানতে পেরেছি।

 

স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, জেলা পর্যায়ের মতো করে উপজেলা পর্যায়ে আমরা বিশেষ নজর দিয়েছি। নষ্ট মেশিন মেরামত করা ও প্রয়োজন অনুযায়ী নতুন মেশিন কেনা হয়েছে। তদবির করে উপজেলা পর্যায় থেকে বদলি নিয়ে ঢাকায় আসা বন্ধ করা হয়েছে। পর্যাপ্ত লোকবল নিয়োগ দেয়া হচ্ছে। পর্যাপ্ত টেকনিশিয়ান ও ফার্মাসিস্ট নিয়োগ দেয়ার কাজ চলমান আছে। উপজেলা পর্যায়ে বেড সংখ্যা বৃদ্ধি করা, ডায়ালাইসিস বেড দেয়া, উপজেলা হাসপাতালেই অপারেশন থিয়েটারে অপারেশন করার উদ্যোগ নেয়াসহ নানাবিধ কাজ করে উপজেলা পর্যায়ের সরকারি স্বাস্থ্যসেবার মান দ্বিগুণ বাড়ানো হচ্ছে। আমরা বুঝে গেছি, উপজেলা পর্যায়ে সেবার মান না বাড়িয়ে দেশের মানুষের জন্য কাক্সিক্ষত সেবা নিশ্চিত করা অসম্ভব।

 

ভোরের আকাশ/মি