logo
আপডেট : ২০ আগস্ট, ২০২৩ ১১:০২
পহেলা সেপ্টেম্বর থেকেই বিএনপির লাগাতার কর্মসূচি
এম সাইফুল ইসলাম

পহেলা সেপ্টেম্বর থেকেই বিএনপির লাগাতার কর্মসূচি

এম সাইফুল ইসলাম: আগামী পহেলা সেপ্টেম্বর দলের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর দিন থেকেই চলমান সরকারবিরোধী আন্দোলনে গতি বাড়ানোর পরিকল্পনা করছে বিএনপি। রাজপথের এই বিরোধী দলটি ওই দিন ঢাকায় বড় শোডাউনের মাধ্যমে লাগাতার মাঠে থাকার কথা ভাবছে। আন্দোলনে হামলা-মামলাসহ সব ধরনের প্রতিবন্ধকতার আশঙ্কা মাথায় রেখেই এবার মাঠে থাকার প্রস্তুতি নিচ্ছে দলটি।

 

বিএনপি ছাড়াও দলটির সঙ্গে সরকারবিরোধী যুগপৎ আন্দোলনে যুক্ত থাকা দলগুলোও রাজপথে নামার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। লাগাতার মাঠে থেকে পর্যায়ক্রমে আন্দোলন তুঙ্গে উঠাতে চায় সরকারবিরোধীরা। এক্ষেত্রে তারা হটকারী কোনো সিদ্ধান্ত নিতে নারাজ।

 

বিএনপিসহ যুগপৎ আন্দোলনে থাকা দলের নেতারা এসব তথ্য স্বীকার করে বলছেন, সরকারের ওপর দেশি-বিদেশি নানা চাপ থাকলেও আওয়ামী লীগকে হটাতে আগামীতে রাজপথে এক দফার কঠোর আন্দোলনের কোনো বিকল্প নেই। সরকারকে পদত্যাগে বাধ্য করে তত্ত্বাবধায়ক বা দলনিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি আদায়ে রাজপথই একমাত্র ভরসা।

 

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের এখনো চার মাস বাকি। তারপরও রাজনীতির মাঠ এখন বেশ সরগরম। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সংবিধানের কথা বলে বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচন করতে অনড়। আর বিএনপি সরকারের পদত্যাগের ‘এক দফা’ দাবিতে এখন রাজপথে।

 

গত ২৪ মে বাংলাদেশে সুষ্ঠু ভোটের বিষয়ে মার্কিন নতুন ভিসানীতির ঘোষণার পর বিএনপির নেতাকর্মীদের মনোবল চাঙ্গা হয়। মার্কিন, ইইউ ছাড়াও পশ্চিমা দেশসমূহ এবং উন্নয়ন সহযোগীরা এবার সুষ্ঠু ভোটের ব্যাপারে স্পষ্ট অবস্থান নিয়ে তৎপরতা চালাচ্ছে। এসব তৎপরতায় বিএনপির আন্দোলনে গতি বাড়ছে। মনোবল দৃঢ় হচ্ছে রাজপথের এই বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের। প্রায় দুই বছর ধরে বেশ সতর্কভাবে মাঠের কর্মসূচি নিয়ে পথচলা বিএনপি নিজেদের দাবি আদায়েও এবার বেশ সিরিয়াস।

 

বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে যুক্ত ১২ দলীয় জোট, জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট, গণতন্ত্র মঞ্চ, গণঅধিকার পরিষদ যুগপৎভাবে কর্মসূচিতে মাঠে রয়েছে। যুগপথে না থাকলেও জামায়াতে ইসলামী, কর্নেল (অব.) অলি আহমদের এলডিপিসহ কয়েকটি দল ও সংগঠন বিএনপির এক দফা দাবির সমর্থনে কর্মসূচি পালন করছে।

 

সবশেষ গত শুক্রবার এই কাতারে যুক্ত হয়েছে ব্যারিস্টার আন্দালিব রহমান পার্থের বাংলাদেশের জাতীয় পার্টি। চলতি মাসেও যুগপৎ কর্মসূচিতে থাকা দলগুলোর হাইকমান্ডের সঙ্গে বিএনপি নেতারা ফের বৈঠক করেছেন। এসব বৈঠকে চূড়ান্ত আন্দোলনে কর্মসূচি ও কৌশল নিয়েই বেশি আলোচনা হয়েছে। বিএনপির পক্ষ থেকে পহেলা সেপ্টেম্বর থেকে এসব দলগুলোকে শক্তভাবে মাঠে নামার প্রস্তুতি নিতে বলা হয়েছে।

 

বিএনপির একাধিক সূত্র বলছে, আগামী ১ সেপ্টেম্বর বিএনপির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। ওই দিন ঢাকায় বড় শোডাউন করতে চায় দলটি। প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে ফের মহাসমাবেশ করার পরিকল্পনাও রয়েছে বিএনপির। যদিও সেটি এখনো চূড়ান্ত নয়। লাভ-ক্ষতির হিসাব করে শেষ পর্যন্ত চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে দলটি। যদি মহাসমাবেশ করা না যায়, সেক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে র‌্যালি করতে পারে দলটি। ওই র‌্যালিতে গত ২৮ জুলাইয়ের মতো ব্যাপক জনসমাগম ঘটাতে চায় বিএনপি। ওই দিন পরবর্তী কর্মসূচিও ঘোষণা করবে তারা।

 

দলটির একজন যুগ্ম-মহাসচিব ভোরের আকাশকে বলেছেন, বিএনপি শান্তিপূর্ণ কর্মসূচির মধ্যেই থাকতে চায়। দলটি হঠকারী কোনো সিদ্ধান্ত নিতে চায় না। সেক্ষেত্রে তারা প্রথম কয়েকদিন ফের বিক্ষোভ কর্মসূচি ও পদযাত্রা কর্মসূচি পালন করতে চায়। তবে কর্মসূচিতে পুলিশ বা সরকারি দলের বাধা এলে আর নরম কর্মসূচিতে থাকবে না বিএনপি।

 

এক পর্যায়ে ‘অবরোধ, অবস্থান ধর্মঘট ও ঘেরাও কর্মসূচি’ বেছে নেবে। চূড়ান্ত দাবি আদায়ে দলটি সড়ক ও রেলপথ, পানিপথ অবরোধের মতো সিদ্ধান্তে যেতে পারে। এছাড়া সরকারি অফিস যেমন উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কার্যালয়, স্থানীয় নির্বাচন অফিস, থানা, জেলা প্রশাসকের অফিস, এসপি অফিস ঘেরাওয়ের কর্মসূচি দেয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। ঢাকায় সচিবালয়, নির্বাচন কমিশন, গণভবন ঘেরাও কর্মসূচি আসতে পারে।

 

এছাড়া জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার সামনে লাগাতার অবস্থান ধর্মঘটের কর্মসূচি দেয়ার পক্ষে সিদ্ধান্ত হয়েছে। এরপরও দাবি না মানলে লাগাতার অবরোধ বা হরতালের মতো কর্মসূচিও দেয়ার পরিকল্পনা আছে বিএনপিতে। অতীতের ব্যর্থতা থেকে এবার ‘ঢাকাকে আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু’ করার সিদ্ধান্ত বিএনপির।

 

আন্দোলনে পুলিশি গ্রেপ্তারের বিষয়টি মাথায় রয়েছে বিএনপির। শীর্ষ বা সহযোগী সংগঠনের নেতারা গ্রেপ্তার হলে পরবর্তীতে কারা দায়িত্ব পালন করবেন, সে বিষয়েও হাইকমান্ড সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছে বলে জানা গেছে। শীর্ষ নেতারা গ্রেপ্তার হলে আন্দোলন যেন থমকে না পড়ে, সেজন্য নেতৃত্বে তিন ধাপের নেতা বাছাই করা হয়েছে বলেও ছাত্রদলের এক নেতা জানিয়েছেন।

 

জানা গেছে, আওয়ামী লীগ সরকার হটানোর আন্দোলনে মাঠের শক্তিতে জামায়াত একটি বড় ফ্যাক্টর। কিছুদিন গতিহীন থাকলেও দলটি ফের সক্রিয়। গত ১০ জুন জামায়াত রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিশনে সমাবেশ করে নিজেদের সক্ষমতার জানান দেয়। দলটি আগামীতে বর্তমান সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনে অংশ না নেয়ার ঘোষণা দিয়েছে।

 

বিশেষ করে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় আজীবন দন্ড প্রাপ্ত জামায়াতের নায়েবে আমির মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী গত ১৪ আগস্ট মারা যাওয়ার পর ঢাকায় জানাজা করতে না দেয়ার বিষয়টি ভালোভাবে নেয়নি দলটির নেতাকর্মীরা। ঘরোয়া এক দোয়ার অনুষ্ঠানে কঠোর আন্দোলনের ইঙ্গিত দিয়ে শুক্রবার জামায়াত নেতা ড. শফিকুল ইসলাম মাসুদ আগামীতে সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করার জন্য প্রস্তুত থাকতে নেতাকর্মীদের প্রতি আহব্বান জানিয়েছেন।

 

গত এক মাসে জামায়াতের ঘরোয়া বৈঠকে দলটির কেন্দ্রীয় নেতারা তত্ত্বাবধায়ক অধীনে নির্বাচন ও কারারুদ্ধ নেতাদের মুক্তির দাবিতে আগামীতে সর্বোচ্চভাবে কর্মীদের মাঠে নামার প্রস্তুতি নিতে বলেছেন। বিএনপির সঙ্গে জামায়াত নেতাদের বর্তমানে পর্দার আড়ালে নিয়মিত কথা হচ্ছে বলেও খবর প্রকাশিত হয়েছে। বিএনপি শক্তভাবে মাঠে নামলে জামায়াতও মাঠে থাকবে বলে দল দুটির একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে। এছাড়া সাঈদীর মৃত্যুতে বিএনপির প্রতিক্রিয়া বেশ ভালোভাবেই নিয়েছে জামায়াত। জামায়াত ছাড়াও অন্যান্য দল ও জোট এখন মাঠে রয়েছে। আগামীতে আরো শক্তভাবে মাঠে নামতে সর্তকভাবে তারা প্রস্তুতি নিচ্ছেন।

 

আন্দোলন ও দলের অবস্থান প্রসঙ্গে কেন্দ্রীয় নায়েবে আমির ও সাবেক সংসদ ডা. আব্দুল্লাহ মুহাম্মদ তাহের ভোরের আকাশকে বলেন, সরকারের দমন-পীড়ন-নির্যাতন আমাদের নেতাকর্মীরা ভুলে যায়নি। তিনি বলেন, দলনিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন আদায়ে যা কিছু করা দরকার গণতান্ত্রিক অন্যান্য দলের মতো জামায়াতও তাই করবে। সেক্ষেত্রে সময়মতো মাঠে নামার প্রস্তুতিও তাদের রয়েছে বলে জানিয়েছেন তিনি।

 

বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহীম ভোরের আকাশকে বলেন, আগামীতে দাবি আদায়ে এক দফার আন্দোলনের কোনো বিকল্প নেই। তাই বিএনপি শিগগিরই যে আন্দোলনের ডাক দেবে, সেখানে শরিকদের সর্বাত্মক মাঠে থাকার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।

 

১২ দলীয় জোটের সমন্বয়ক ও জাপার (জাফর) নেতা মোস্তফা জামাল হায়দার বলেছেন, বিএনপির সঙ্গে সাম্প্রতিক সময়ে বৈঠকে কর্মসূচির ধরন ও কৌশল নিয়ে আলোচনা হয়েছে। বিএনপি আমাদেরকে সিরিয়াসলি মাঠে থাকার জন্য বলেছে। আন্দোলনেই ভরসা বলেও মনে করেন তিনি।

 

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও ফরেন অ্যাফেয়ার্স কমিটির চেয়ারম্যান আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী ভোরের আকাশকে বলেন, সবাই এখন জানে আওয়ামী লীগের অধীনে নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব নয়। মার্কিন ভিসানীতি তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ। ক্রমাগতভাবে বিদেশিরা এখন সুষ্ঠু নির্বাচনের কথা বলছেন। তারা জানে গত দুই নির্বাচনে মানুষ এখানে ভোট দিতে পারেনি।

 

তিনি বলেন, নির্বাচন ঘনিয়ে আসছে। তাই দ্রুত সময়ে বিএনপি শান্তিপূর্ণ এক দফার আন্দোলনের কর্মসূচিতে যাবে। তার জন্য বিএনপি ও তার মিত্ররা প্রস্তুত। এক দফার আন্দোলনের কোনো বিকল্প দেখছে না তারা। পদত্যাগের আগে সরকার টোপ হিসেবে সংলাপে ডাকতে পারে। তাতে বিএনপির যাওয়ার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। দাবি মানতে বাধ্য করাতে রাজপথের কোনো বিকল্প নেই।

 

ভোরের আকাশ/নি