logo
আপডেট : ২২ আগস্ট, ২০২৩ ১৪:৩৩
সারি সারি অর্জুনের গ্রাম ভান্ডারিয়ার পশ্চিম ভিটাবাড়ীয়া
ভান্ডারিয়া (পিরোজপুর) প্রতিনিধি

সারি সারি অর্জুনের গ্রাম ভান্ডারিয়ার পশ্চিম ভিটাবাড়ীয়া

পশ্চিম ভিটাবাড়ীয়া গ্রামে প্রবেশপথের দু’পাশে সারি সারি অর্জুনের গাছ

পিরোজপুরের ভান্ডারিয়া উপজেলার একটি গ্রাম পশ্চিম ভিটাবাড়ীয়া। মেঠোপথ ধরে গ্রামে ঢুকতেই খালের পাড় ধরে চোখে পড়ে সারি সারি অর্জুনের গাছ। অনেকের কাছে ওই গ্রাম অর্জুনের গ্রাম হিসেবে পরিচিত। ওই গ্রামের অধিকাংশ মানুষের পেশা কৃষি। চারপাশে চাষের জমির মাঝ বরাবর ওই গ্রামটি অবস্থিত।

 

জানা গেছে, বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কা অর্জুনের আদি নিবাস। বাংলাদেশের অধিকাংশ অঞ্চলে ঔষধি অর্জুন গাছ কমবেশি দেখা যায়। বিশেষত রাস্তার দু’পাশে এবং চট্টগ্রাম ও সিলেটের বনাঞ্চলে প্রচুর জন্মে থাকে। আর্দ্র ও নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়া অর্জুন গাছের জন্য উপযোগী।

 

সাধারণত দো-আঁশ মাটিতে এ গাছটি ভালো হয়ে থাকে। সাধারণত এ গাছে বৈশাখ-আষাঢ় মাসে ফুল ফুটে এবং পৌষ-ফাল্গুন মাসে ফল পাকে। অর্জুনের বীজ থেকে চারা উৎপাদন করা যায়। সাধারণত মার্চ-এপ্রিল মাসে পরিপক্ব ফল হতে বীজ সংগ্রহ করা হয়। বর্ষার শুরুতেই নির্দিষ্ট স্থানে রোপণ করতে হয়।

 

সরেজমিনে ওই গ্রামে দেখা যায়, স্থানীয় কাপালিহাট থেকে এক কিলোমিটার দূরে পশ্চিম ভিটাবাড়ীয়া গ্রামে প্রবেশপথের দু’পাশে সারি সারি অর্জুনের গাছ। রাস্তার দু’পাশে কোলাহল ও খাল রয়েছে।

 

স্থানীয়রা বলেন, অর্জুনের গাছে ফুল ও ফল ধরে। গাছে ফুলের পাশাপাশি বেশ কিছুটা হলুদ বর্ণের ফল ধরে। গাছের ছাল খুব মোটা এবং ধূসর বর্ণের। গাছ থেকে সহজেই ছাল উঠানো যায়। শীতের শেষেই সাধারণত গাছ নিষ্পত্র হয়ে যায় এবং বসন্তে নতুন পাতায় গাছ ভরে যায়। মেঠোপথ ধরে হাঁটতেই দেখা হয় ওই এলাকার আব্দুর রবের সাথে। এ সময় কথা হলে তিনি বলেন, ওই গ্রামে কয়েকশ’ পরিবারের বসবাস। লোকসংখ্যা কয়েক হাজার তবে গ্রামটি নতুন নয়। ব্রিটিশ আমল থেকেই এখানে মানুষের বসতি।

 

তিনি আরো জানান, ১৯৮৮ সালে তৎকালীন ভিটাবাড়ীয়া ইউনিয়নের স্বর্ণপদকপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান খান এনায়েত করিম নিজ উদ্যোগে তার ইউনিয়ন পরিষদের অর্থায়নে এই গ্রামে প্রায় পাঁচশ’ অর্জুন গাছ রোপণ করেন। বৃহদাকৃতির বহুবর্ষজীবী এই উদ্ভিদটি প্রায় ১৮ থেকে ২৫ মিটার উচ্চতাবিশিষ্ট হয়ে থাকে। এই গাছগুলোর বয়স এখন ৩৫ বছর। তাই পশ্চিম ভিটাবাড়ীয়া গ্রামটি এখন অর্জুনের গ্রাম হিসেবে পরিচিত।

 

এ বিষয়ে ইউনিয়নের সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান খান এনায়েত করিম বলেন, পশ্চিম ভিটাবাড়ীয়া গ্রামে প্রচুর অর্জুন গাছ রয়েছে। এ ছাড়াও তিনি ওই ইউনিয়নের সব রাস্তার দু’পাশে বিভিন্ন ঔষধি গাছসহ নারিকেল, সুপারি, আম ও কাঁঠাল গাছ রোপণ করেছিলেন।

 

হাঁটতে হাঁটতে কিছুদূর যেতেই দেখা হয় মোস্তফা বয়াতির সাথে। তিনি বলেন, হাজার বছর আগে থেকেই চিকিৎসাশাস্ত্রে ভেষজ উপাদানের ব্যবহার হয়ে আসছে। প্রাচীনকালে এখনকার মতো ঔষধ ছিল না। তখন মানুষ বিভিন্ন সমস্যার সমাধানে ভরসা রাখত এসব ভেষজ উপাদানের ওপর। ভেষজ উপাদানের মধ্যে অর্জুনের নাম রয়েছে সবার প্রথমে। এই গাছের অনেক গুণ রয়েছে।

 

স্থানীয় ইউনানী, আয়ুর্বেদ ও হোমিও চিকিৎকদের সাথে আলাপের সময় জানা যায়, অর্জুনের ছালে হার্টের সমস্যা দূর করার পাশাপাশি প্রতিরোধ করতেও সহায়তা করে এটি। এ ছাড়াও বিভিন্ন রোগের দাওয়াই এই ছোট্ট ফলটি। শুধু ফলই নয়, এই গাছের পাতা, ছালও সমান উপকারী। হৃদরোগ উপশমে অর্জুন ছাল ব্যবহৃত হয়। আবার শুকনো ফল গুঁড়া করে পানির সাথে মিশিয়ে খেলেও উপকার পাবেন।

 

রক্তে নিম্ন চাপ থাকলে অর্জুনের ছালের রস সেবনে উপকার হয়। রক্তক্ষরণে পাঁচ থেকে ছয় গ্রাম ছাল রাতে পানিতে ভিজিয়ে রেখে সকালে ছেকে পানি খেলে আরোগ্য হয়। অ্যাজমার ক্ষেত্রে কিন্তু অর্জুন গাছের ছাল অসাধারণ উপকারী। আপনি যদি অর্জুন গাছের ছাল গুঁড়া করে দুধে মিশিয়ে খেতে পারেন নিয়মিত তাহলে এই অ্যাজমার সমস্যা অনেক কমে যাবে। এই গাছের ছাল মুখ, জিহবা ও মাড়ির প্রদাহের চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়, এটি মাড়ির রক্তপাত বন্ধ করে। এটি সংকোচন ও জ্বর রোধক হিসেবেও কাজ করে।

 

এ ছাড়া চর্ম ও যৌন রোগে অর্জুন ব্যবহৃত হয়। অর্জুন খাদ্য হজম ক্ষমতা বাড়ায়। খাদ্যতন্ত্রের ক্রিয়া স্বাভাবিক রাখতে সাহায্য করে। ত্বকের জন্যও অর্জুন গাছের ছাল খুবই উপকারী। এটি ভেতর থেকে ত্বকের উজ্জ্বলতা বাড়ায়, ত্বকের কোষ মজবুত করে। অর্জুন গাছের ছাল মধুর সাথে মিশিয়ে ব্রণের ওপর লাগালে তা কমে যায়। আবার এই ছালের সাথে মধু মিশিয়ে ব্যবহার করলে মেছতার দাগও কমে যায়। অর্জুন গাছের ছাল ফেস প্যাক হিসেবে অনেকে নিয়মিত ব্যবহার করে।

 

এ ছাড়াও অর্জুন গাছে ভেষজ গুণ যেমন অনেক তেমনি বাণিজ্যিকভাবেও কদর অনেক। অর্জুনের গাছের কাঠ বেশ শক্ত। একদা গরুর গাড়ির চাকা নির্মাণে অর্জুন গাছ ব্যবহৃত হতো। গৃহনির্মাণ, কৃষি উপকরণ, জলযান, নৌকা, দাড়ি, মাস্তুল, খনি ও নলকূপ খননে এই গাছের কাঠ ব্যবহৃত হয়।

 

ভোরের আকাশ/নি