logo
আপডেট : ২৪ আগস্ট, ২০২৩ ১০:১৪
ভয়াবহ ডেঙ্গু পরিস্থিতি: দায় কার?
নিখিল মানখিন

ভয়াবহ ডেঙ্গু পরিস্থিতি: দায় কার?

নিখিল মানখিন: দেশের ভয়াবহ ডেঙ্গু পরিস্থিতির দায় এড়াতে তৎপর সংশ্লিষ্টরা। ডেঙ্গু সংক্রমণ না কমার পেছনে মশকনিধনে ব্যর্থতাকে দায়ী করেছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী। মশকনিধনে ব্যবহৃত কীট কার্যকর বলে দাবি করেছেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস। এডিস মশার প্রজনন এবং ডেঙ্গুর বিস্তার সম্পূর্ণভাবে আবহাওয়ার ওপর নির্ভর করে বলে মন্তব্য করেছেন স্থানীয় সরকারমন্ত্রী।

 

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এবং স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের এমন বক্তব্যের মাঝেই ভয়াবহ রূপ নিয়েছে দেশের ডেঙ্গু পরিস্থিতি। মৃত্যু বিবেচনায় বর্তমান ডেঙ্গু পরিস্থিতি ইতোমধ্যে দেশের সর্বকালের রেকর্ড ভেঙেছে। আক্রান্তের সংখ্যাও এমন রেকর্ড গড়ার ইঙ্গিত দিচ্ছে।

 

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এডিস মশাবাহিত রোগ ‘ডেঙ্গু’। ঢাকা সিটিতে ডেঙ্গুতে মৃত্যুহার বেশি, আক্রান্ত বেশি ঢাকা সিটির বাইরের এলাকাগুলোয়। চলতি বছরে ডেঙ্গুতে মারা যাওয়া মোট রোগীর প্রায় ৮০ শতাংশই ঢাকা সিটির। মশকনিধনের দায়িত্বে রয়েছে সিটি করপোরেশন। এটি স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের অধীন। আর ডেঙ্গু রোগীকে চিকিৎসাসেবা প্রদানের দায়িত্বে আছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।

 

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে রাজধানীর দুই সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে বাজেট বরাদ্দ বৃদ্ধি এবং নিয়মিত মশকনিধন অভিযানসহ আপাতদৃষ্টিতে নানা ধরনের পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। তবে তা সত্তেও ঢাকায় এডিস মশাবাহিত এ রোগের প্রকোপ স্মরণকালের ভয়াবহ পরিস্থিতি পার করছে।

 

কর্তৃপক্ষ বলছে, এডিস মশার প্রজননস্থল (লার্ভা) ধ্বংস করতে চিরুনি অভিযানসহ তাদের আওতাধীন বিভিন্ন এলাকায় নিয়মিত মশকনিধন অভিযান পরিচালিত হচ্ছে। নগরীতে মশা জন্মানোর অনুক‚ল পরিবেশ সৃষ্টি করায় ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে অনেককে জরিমানাও করা হচ্ছে। তবে সিটি করপোরেশনের সব প্রচেষ্টাই নিছক লোকদেখানো হওয়ায় ডেঙ্গু থেকে সাধারণ মানুষ রক্ষা পাচ্ছে না বলে অভিযোগ অনেকের।

 

ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের সব এলাকায় নিয়মিত মশার ওষুধ না ছিটানো, ফগিংয়ের সময় গলির মধ্যে না গিয়ে মেইন রাস্তায় ফগিং করাসহ লোক দেখানো অভিযান পরিচালনা করে জরিমানা আদায়, ডোবা-নালা নিয়মিত পরিষ্কার না করায় সিটি করপোরেশনের কার্যক্রম কোনো কাজে আসাছে না বলে অভিযোগ করেছেন নগরবাসী।

 

ডেঙ্গুর বিস্তার আবহাওয়ার ওপর নির্ভর করে সমবায়মন্ত্রী: স্থায়ী সরকার মন্ত্রণালয় এবং ঢাকার দুটি সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তারাই পরিস্থিতির জন্য জলবায়ু পরিবর্তন এবং মানুষের অসচেতনতাকে দায়ী করেছেন। অসময়ে বৃষ্টির কারণে এডিস মশার বিস্তার বেড়েছে এবং ঢাকার রোগীদের একটি বড় অংশ অন্য জেলা থেকে এসেছেন বলে দাবি কর্তৃপক্ষের।

 

গত ১১ আগস্ট রাজধানীর একটি অনুষ্ঠানে স্থানীয় সরকারমন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম বলেন, শুধু বাংলাদেশে নয়, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বিশ্বজুড়ে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব বাড়ছে। এডিস মশা নিধনে বাংলাদেশ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বিধিবিধান অনুসরণ করছে। এডিস মশা প্রজনন রোধে আমরা সিটি করপোরেশনগুলোর মাধ্যমে কাজ করছিলাম। কিন্তু এবার এডিসের মাত্রাতিরিক্ত প্রাদুর্ভাব লক্ষ করা যাচ্ছে। শহরকেন্দ্রিক এটা অনেক বেশি। এমনকি জেলা, উপজেলা ও পৌরসভা পর্যায়েও অনেক মানুষ ডেঙ্গু আক্রান্ত হচ্ছেন।

 

সাংবাদিকদের অপর প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এডিস মশার প্রজনন এবং ডেঙ্গুর বিস্তার সম্পূর্ণভাবে আবহাওয়ার ওপর নির্ভর করে। ক্লাইমেট চেঞ্জের কারণে এটি হচ্ছে। শুধু আমাদের দেশে নয়, আজকে পৃথিবীর ১৪৮টি দেশে ডেঙ্গু মাত্রাতিরিক্ত পর্যায়ে গিয়েছে। সরকার বা সিটি করপোরেশনগুলো আগে থেকে ব্যবস্থা না নেয়ায় ডেঙ্গুর ভয়াবহতা বেড়েছে সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী বলেন, এটি একেবারেই ঠিক নয়। তারা যখন আমাদের সামনে কথা বলে তখন এ কথাগুলো বলেন না। আগে থেকে কী ব্যবস্থা নেবে? আমরা জানুয়ারি মাসের ৫ তারিখে সভা করেছি। সেখানে কীটতত্তবিদরা উপস্থিত ছিলেন। তারা তো তখন এ ব্যাপারে আমাদের কোনো দুর্বলতা আছে বলে বলেননি। আমাদের কোনো পদক্ষেপে ঘাটতি আছে কিনা, সেটাও বলেননি।

 

ডেঙ্গু মোকাবিলায় যথাযথ প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ হয়েছিল দাবি করে মন্ত্রী বলেন, পুরো বছরে জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত সবসময় মশকনিধন কার্যক্রম অব্যাহত আছে। মশা এবং ডেঙ্গু ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ফেব্রুয়ারি, মার্চ, এপ্রিল, মে, জুন, জুলাই থেকে বাড়ে। আমরা জানুয়ারি মাসেই এ বিষয়ে সভা করেছি। সেখানে বিস্তারিত আলোচনা করে ব্যবস্থা নেয়া হয়।

 

মশকনিধনে ব্যর্থতা রয়েছে স্বাস্থ্যমন্ত্রী: দেশে ডেঙ্গু সংক্রমণ না কমার পেছনে মশকনিধনে ব্যর্থতাকে দায়ী করেছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক। তিনি বলেন, আমরা যতই রোগীদের চিকিৎসাসিবা দিই না কেন, মশা না কমলে দেশে ডেঙ্গু রোগীও কমবে না। বুধবার দুপুরে সচিবালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে এক মতবিনিময় সভায় তিনি এসব কথা বলেন।

 

মন্ত্রী বলেন, ডেঙ্গুতে এখন পর্যন্ত ৫০০ মানুষের মৃত্যু এবং ১ লাখ লোক আক্রান্ত হয়েছে। মশা যেভাবে নিয়ন্ত্রণ করা দরকার, সেভাবে হচ্ছে না বলেই ডেঙ্গুর সংক্রমণ কমছে না। তবে আমাদের সেবা নিয়ে মানুষের কোনো অভিযোগ নেই। তিনি বলেন, সম্প্রতি সিটি করপোরেশনের ওষুধ নিয়ে সমালোচনা হচ্ছে। ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে হলে স্প্রে জোরদার করতে হবে, ভেজাল ওষুধ ব্যবহার থেকে দূরে থাকতে হবে। মশকনিধন কার্যক্রম জোরদার করতে হবে জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, আশপাশের দেশ থেকে বাংলাদেশে পরিস্থিতি খারাপ। সবাইকে যার যার জায়গায় দায়িত্ব পালন করতে হবে। সিটি করপোরেশনগুলো যেন ভেজাল ওষুধ না ছিটায় সে আহব্বান জানান মন্ত্রী।

 

মশকনিধনে ব্যবহৃত কীট কাজ করছে ডিএসসিসি মেয়র: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগার সংলগ্ন এলাকায় বিশেষ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ও এডিস মশার প্রজননস্থল ধ্বংস করার লক্ষ্যে পরিচালিত কার্যক্রম পরিদর্শনে গিয়ে গণমাধ্যমের সঙ্গে মতবিনিময়কালে ডিএসসিসি মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস বলেন, এখন ডেঙ্গু রোগের ভরা মৌসুম। এ সময় তা ঊর্ধ্বগামী হওয়ার কথা।

 

কিন্তু আপনারা লক্ষ করেছেন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরও বলছে, ঢাকা শহরে ডেঙ্গু রোগ এখন স্থিতিশীল। আমাদের রোগীর সংখ্যা আমরা নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসতে পেরেছি। গতকালও ডিএসসিসিতে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা ১০০-এর নিচে ছিল। ভরা মৌসুমে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ অত্যন্ত দুরূহ হলেও আমরা কাজটি করে চলেছি।

 

সাংবাদিকদের আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ঢালাওভাবে বলা, এটা কাজ করছে না, ওটা কাজ করছে না! আমার ফলাফলই তো বলে দিচ্ছে কোনটা কাজ করছে। কীটনাশক যদি কাজ না করত, তাহলে এ ভরা মৌসুমে ১০০-এর নিচে রোগী রাখা; কোনো দেশই তো পারছে না। যারা এ কথাগুলো বলছেন, তারা কীটতত্তবিদ নন। তারা আসলে বিভিন্ন ধরনের কীটনাশক বিক্রি করে ডিএসসিসিতে চক্র সৃষ্টি করেছিল। তারা সেই একটি চক্রের অংশবিশেষ।

 

ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিতে হবে বিশেষজ্ঞরা: ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে না নিলে এ কাজে গতি আসবে না বলে জানিয়েছেন কীটতত্তবিদ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক কবিরুল বাশার। তিনি বলেন, এ চ্যালেঞ্জটা সিটি করপোরেশনগুলো কতটা নিতে পেরেছে, সেটাই এখন বড় প্রশ্ন। ডেঙ্গু যে আকারে ছড়িয়ে পড়েছে এখন আসলে সিটি করপোরেশনের আর করার কিছুই নেই।

 

তিনি বলেন, যখন একটা ইনফেকশন ছড়িয়ে পড়ে অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে কোনো কাজ হয় না। তার মতে, সিটি কপোরেশনের ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ প্রস্তুতিতে অবশ্যই ঘাটতি ছিল। তবে বর্তমানে যে পরিস্থিতি তার চেয়ে ভয়ংকর হতে পারত যদি সিটি করপোরেশন কন্ট্রোল না করত।

 

তিনি বলেন, এ মুহূর্তে এডিস মশা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম গতানুগতিক পদ্ধতিতে করলে হবে না। হটস্পট ধরে ধরে উড়ন্ত মশা নিধন কার্যক্রম বাড়াতে হবে। সব জায়গায় প্রজননস্থল ধ্বংস (সোর্স রিডাকশন) করতে হবে। মশার লার্ভা ধ্বংসে নতুন প্রজন্মের বায়ো লার্ভিসাইড বিটিআইর প্রয়োগ করতে হবে। এ কাজে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান বিশেষ করে সিটি করপোরেশনের পাশাপাশি জনগণ ও সামাজিক সংগঠনকেও সম্পৃক্ত হতে হবে।

 

ডেঙ্গু বিশেষজ্ঞ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন অনুষদের সাবেক ডিন এবং প্রধানমন্ত্রীর বর্তমান ব্যক্তিগত চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ ভোরের আকাশকে বলেন, দেশের ডেঙ্গু পরিস্থিতির অবনতি অব্যাহত রয়েছে। গত কয়েক বছর ধরে সারা বছরই ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত এবং মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। মশকনিধন ও লার্ভা ধ্বংস কার্যকর আরো জোরালো করতে হবে। সাধারণ মানুষের মাঝে সচেতনতা না বাড়লে ডেঙ্গু প্রতিরোধ কার্যক্রম সফল হবে না।

 

ভোরের আকাশ/নি