logo
আপডেট : ২৪ আগস্ট, ২০২৩ ১০:৪৩
ইলিশ মাছের খনি দক্ষিণাঞ্চল
এসএলটি তুহিন, বরিশাল

ইলিশ মাছের খনি দক্ষিণাঞ্চল

বরিশালের মাছের বাজার

প্রাকৃতিক দুর্যোগসহ নানামুখী প্রতিবন্ধকতার বিরুদ্ধে লড়াই করে ‘মাছে ভাতে বাঙালি’র দক্ষিণাঞ্চলে চাহিদার প্রায় দ্বিগুণ মাছ উদ্বৃত্ত থাকছে। এমনকি এ অঞ্চলে মৎস্য সেক্টরে অনুমোদিত জনবলের অর্ধেকেরও বেশি ঘাটতির পাশাপাশি সাগর ও নদনদীতে অভিযানের মতো কোনো নৌযান না থাকলেও প্রবৃদ্ধি জাতীয় হারের চেয়ে বেশি। গত ১ দশকে দেশে মাছের উৎপাদন ৫৩ শতাংশ বাড়লেও প্রায় ১১ লাখ টন খাদ্য উদ্বৃত্ত দক্ষিণাঞ্চলে মৎস্য খাতে প্রবৃদ্ধির পেয়েছে ৭৫ শতাংশ। দক্ষিণাঞ্চলে ইলিশের উৎপাদন বেড়েছে ১১২ শতাংশ। আর সারা দেশে ইলিশের ৬৬ শতাংশই আহরিত হয় দক্ষিণাঞ্চলে।

 

একজন মানুষের দৈনন্দিন ৬০ গ্রাম মাছের চাহিদার বিপরীতে আমাদের দেশে তা ইতোমধ্যে ৬২.৫৮ গ্রামে উন্নীত হয়েছে। ‘বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা-২০১৮’-এর হিসাব অনুযায়ী, দেশের মোট জিডিপির ৩.৫৭ শতাংশ এবং কৃষিজ জিডিপির ২৫.৩০ শতাংশ মৎস্য খাতের অবদান রেখে চলছে। দেশের মোট জনগোষ্ঠীর ১১ শতাংশেরও বেশি মানুষ মৎস্য সেক্টর থেকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জীবন-জীবিকা নির্বাহ করেন।

 

২০১৬-১৭ সালে দেশ মাছ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করলেও আরো ৫ বছর আগেই দক্ষিণাঞ্চল এখাতে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে। জাতিসংঘের ‘খাদ্য ও কৃষি সংস্থার ২০১৮-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী মুক্ত ও অভ্যন্তরীণ জলাশয়ে মাছ আহরণে বাংলাদেশ সারা বিশ্বের তৃতীয় স্থানে এবং বদ্ধ জলাশয়ের মৎস্য উৎপাদনে ৫ম স্থানে রয়েছে। দক্ষিণাঞ্চলও এক্ষেত্রে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। এ অঞ্চলের ৬ জেলার প্রায় ২৬ হাজার হেক্টর বদ্ধ জলাশয়, ৪ লাখ ২৭ হাজার ৪৮২ হেক্টর উন্মুক্ত জলাশয় ছাড়াও প্রায় আড়াই হাজার বেসরকারি মৎস্য খামার, ৫০টির মতো সরকারি-বেসরকারি মৎস্য হ্যাচারি, ৯২০টি নার্সারি খামার ছাড়াও প্রায় ৯ হাজার চিংড়ি খামার মৎস্য উৎপাদনে ব্যাপক অবদান রাখছে।

 

কৃষি ফসলের চেয়ে মাছে মুনাফা বেশি হওয়ায় বরিশাল অঞ্চলের মানুষ মাছ চাষে ঝুঁকছে। তবে ২০০৮ সালে ঘূর্ণিঝড় সিডরের পরে মহাসেন, আম্পান, আয়লা ও সিত্রাংয়ের মতো ঘূর্ণিঝড়সহ প্রবল বর্ষণে বরিশাল অঞ্চলে বিপুল সংখ্যক মাছের ঘের, পুকুর ও দীঘি প্লাবিত হয়ে কোটি কোটি মাছ ও পোনা ভেসে গিয়ে চাষিরা সর্বশান্ত হয়। তবে বরিশাল অঞ্চলে ৪২টি উপজেলাতেই মাছ চাষে প্রবৃদ্ধির ধারা অব্যাহত রেখেছে। দক্ষিণাঞ্চলের ১১টি নদনদীকে অভয়াশ্রম ঘোষণা করা হয়েছে যা উন্মুক্ত জলাশয়ে মাছের উৎপাদন বৃদ্ধিতে যথেষ্ট সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।

 

তবে অব্যাহত নগরায়নের ফলে মহানগরীসহ দক্ষিণাঞ্চলের জেলা শহরগুলোর পুকুর, দীঘি ও খালগুলো ক্রমাগত ভরাট হয়ে যাচ্ছে। যা মৎস্য সেক্টরের জন্য একটি বড় হুমকির মুখে পড়বে । বরিশাল অঞ্চলে প্রায় ৪ লাখ ২৭ হাজার পুুকুর ও দীঘি, ৬৬৭টি বরোপীট, ৯০টি প্রবাহমান নদনদী, ৪৩টি বিল, একটি বাওড় বা মরা নদী, প্রায় দেড় হাজার খাল ও সোয়া ৬০০ প্লাবন ভূমিসহ মোট ৫৪ লাখ ৫৬ হাজার হেক্টরে কম বেশি মাছ উৎপাদন হচ্ছে।

 

এসব জলাশয়ে মাছের উৎপাদন ২০০৮-০৯ সালে ২ লাখ ৯৮ হাজার টন থেকে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৫ লাখ ২৩ হাজার টন ও ২০২১-২২ অর্থবছরে তা প্রায় ৫ লাখ ৩২ হাজার টনে উন্নীত হয়েছে। যার মধ্যে ইলিশের উৎপাদন ছিল ৩ লাখ ৭০ হাজার টনের মতো। ২০২১-২২ অর্থবছরে দেশে ইলিশের সহনীয় আহরণ ছিল ৫.৬৬ লাখ টন। এছাড়াও প্রায় ৬০ হাজার টন রুই জাতীয় মাছ এবং পাঙাশ, শিং-মাগুর, কই, তেলাপিয়া এবং চিংড়ি ছাড়াও অন্য মাছের উৎপাদনও ছিল দেড় লাখ টনের মতো। এ সময়ে দক্ষিণাঞ্চলের সরকারি-বেসরকারি ৫০টি হ্যাচারি ও ৯২৩টি নার্সারিতে প্রায় ১৮ হাজার কেজি রেনু ও ২৫ লাখ ১৮ হাজার মাছের পোনা উৎপাদন হয়েছে।

 

বরিশাল অঞ্চলের প্রায় ৫ লাখ জেলে মৎস্য সেক্টরের ওপর নির্ভরশীল। যার মধ্যে মৎস্য অধিদপ্তরের নিবন্ধিত জেলের সংখ্যা ৩ লাখ ২ হাজার ৪৭৪। এ অঞ্চলে জেলে পরিবারের সংখ্যা আড়াই লাখের মতো। মৎস্য অধিদপ্তরের অন্য এক পরিসংখ্যানে দেশের ৮টি বিভাগের মধ্যে শুধুমাত্র বরিশাল বিভাগেই প্রায় সাড়ে ৩ লাখ জেলে ইলিশ আহরণে জড়িত। যার ৬৫ শতাংশ সার্বক্ষণিক ও ৩৫ শতাংশ খন্ড কালীন। বিগত ২০২২-২৩ অর্থবছরে বরিশাল অঞ্চলের প্রায় ২ হাজার জলাশয়ে রাজস্ব ও উন্নয়ন খাতে ৫৩ লাখ বিভিন্ন মাছের পোনা অবমুক্ত করেছে মৎস্য অধিদপ্তর।

 

সরকার ২০১২-১৩ অর্থবছরকে ভিত্তি হিসেবে ৭ম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় দেশের মৎস্য চাষি ও মৎস্যজীবীদের আয় ২০ শতাংশ বৃদ্ধির লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে। এ লক্ষ্যে দক্ষিণাঞ্চলেও বিভিন্ন ধরনের প্রকল্প ও কর্মসূচি গ্রহণের কথা জানান হয়েছে। দেশের বিভিন্ন উন্মুক্ত জলাশয়ে খাঁচায় মাছ চাষ কার্যক্রম অতীতে যথেষ্ট জনপ্রিয়তা অর্জন করলেও অতি সম্প্রতি তা কিছুটা স্তিমিত হয়ে পড়েছে। বরিশাল অঞ্চলে বর্তমানে প্রায় দেড় হাজার খাঁচায় ১২শ’ মৎস্যজীবী মাছ চাষ করে বছরে প্রায় এক হাজার টন বিভিন্ন ধরনের মাছ উৎপাদন হয়েছে। পাশাপাশি এ অঞ্চলের বিভিন্ন জেলায় কাকড়া ও কুচিয়া চাষ যথেষ্ট সম্প্রসারণ ঘটছে।

 

২০২১-২২ অর্থবছরে এ অঞ্চলের ৩ হাজার টন কুচিয়া ও সাড়ে ৭০০ খামারে ৩০০ টন কাঁকড়া উৎপাদন হয়েছে।

 

ভোরের আকাশ/নি