লাট অর্থ রাজ্যপাল। কিংবা গভর্নর। কিংবা প্রধান শাসক। লাট শব্দটি এসেছে ইংরেজি লর্ড থেকে। ব্রিটিশ শাসনামলে ভারতের সব গভর্নর জেনারেলই ছিলেন লর্ড। এই গভর্নর জেনারেলরাই পরে হয়ে যান বড় লাট সাহেব। লেফটেন্যান্ট গভর্নররা হয়ে যান ছোট লাট সাহেব। তেমনি এক লাট সাহেবের আবির্ভাব ঘটেছে রূপগঞ্জে। তিনি ছোট লাট সাহেব। তিনি ১৫ হাজার মানুষকে শাসন করেন।
দেখতে ছিপছিপে গড়ন। চোয়াল ভাঙ্গা। পরনে ধবধবে সাদা লুঙ্গি। চলেন ফিল্মি স্টাইলে। যেমন নাম তেমন ডাক। তেমনি তার অপরাধের সাম্রাজ্য। তার নাম শুনে বাঘে-মহিষে এক ঘাটে পানি খায়। তার নাম মুখে আনতে নাকি স্থানীয়রা বুকে ফুঁ দেয়। তিনি কিন্তু ঢালিউডের বাংলা সিনেমা ‘লাট সাহেব’ এর নায়ক জসিম নন। নন তামিল সিনেমার খলনায়ক প্রভাষ রাজ। তিনি কামশাইর এলাকার লাট বাহাদুর। সবাই তাকে লাট নামে ডাকে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রূপগঞ্জের কায়েতপাড়া ইউনিয়নের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের উত্তরের গ্রাম কামশাইর। গ্রামের এক চিলতে সরু রাস্তা। দু’পাশে বালু নদ। এক পাশে ফসলি ক্ষেত। ঘিঞ্জি পরিবেশ। দুর্গম এলাকা হওয়ায় এখানে পুলিশের যেতে লাগে দীর্ঘ সময়। কামশাইর ছাড়াও উত্তরপাড়া, চাঁনখালী, নর্দ্দা, মোল্লাপাড়া, নয়া কামশাইর এলাকা রয়েছে। এ ওয়ার্ডে প্রায় ১৫ হাজার লোকের বসবাস। স্থানীয়রা বলেন, এলাকায় পুলিশ পৌঁছার সাথে সাথেই অপরাধীরা বালু নদ পার হয়ে ইদারকান্দি, ফকিরখালী নতুবা বেরাইদ এলাকায় গিয়ে আশ্রয় নেয়।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, রূপগঞ্জের কায়েতপাড়া ইউনিয়নের কামশাইর এলাকার মৃত ঈমান ভূইয়ার ছেলে লাট ভূইয়া। তার রয়েছে ২২ জনের বাহিনী। এ বাহিনীর একেকজন সদস্য একেক কাজে নিয়োজিত। কেউ অস্ত্র ভান্ডার দেখভাল করেন। কেউ মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করেন। কেউবা জুয়ার বোর্ড চালান। কেউবা আবার বালু নদে ছিনতাই-ডাকাতির নেতৃত্ব দেন।
দেশীয় অস্ত্রসহ রয়েছে অস্ত্র ভান্ডার। বাড়িতেই গড়ে তোলা হয়েছে টর্চার সেল। কেউ বাড়াবাড়ি করলে তাকে বাহিনী দিয়ে ধরে নিয়ে যাওয়া হয় টর্চার সেলে। পরে চালানো হয় নির্যাতন। স্থানীয়রা বলেন, লাট খুব চতুর লোক। তার ছবি সংবলিত কোনো পোস্টার, ফেস্টুন কিংবা ব্যানার খুঁজে পাওয়া যাবে না। সে দিন থেকে রাত অবধি ঘরের ভেতর নিজেকে আড়াল করে রাখে।
গভীর রাতে কামশাইর বাজারে বের হয়ে হাঁটাহাঁটি করে। খুব ভোরে আধঘণ্টার জন্য বাইরে বের হন। তার ঘনিষ্ট একটি সূত্র জানায়, তার সঙ্গে রূপগঞ্জ থানা পুলিশের রয়েছে দহরম-মহরম। চনপাড়ার পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জের সঙ্গে রয়েছে তার সখ্য। ফাঁড়িতে মাসোহারা দিয়েই চলে তার জুয়া-মাদক ও অপরাধের কারবার।
রূপগঞ্জ থানা সূত্রে জানা গেছে, তার বিরুদ্ধে রূপগঞ্জ থানায় এক ডজনের মতো মামলা রয়েছে। এর মধ্যে ৬-৭টি মাদক মামলা। বাকিগুলো সংঘর্ষ-হামলা সংক্রান্ত মামলা। তার সদস্যদের বিরুদ্ধেও একাধিক মামলা রয়েছে। স্থানীয় এলাকাবাসীরা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, কামশাইর দক্ষিণপাড়া তার বাড়িতে গড়ে উঠেছে অপরাধের আখড়া।
এ আখড়ায় বসে জুয়া-মাদক আর নারীর আসর। কামশাইরের খুচরা কারবারিদের কাছে এখান থেকে মাদক সাপ্লাই দেয়া হয়। আশপাশের ইদারকান্দি, ফকিরখালি, রাতালদিয়া, বরুণাসহ বেশকিছু এলাকায় এখান থেকে মাদক সাপ্লাই দেয়া হয়। সকাল থেকে রাত অবধি চলে জুয়া খেলা। বালু নদ দিয়ে মাদকের চালান আনা হয় বলে জানা গেছে।
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত ১৮ আগস্ট লাটের নেতৃত্বে বহিরাগত সন্ত্রাসীরা মসজিদে ভাংচুর ও লুটপাট চালিয়েছে। এ সময় গ্রামবাসীর সঙ্গে লাট বাহিনীর কয়েক দফা ধাওয়া-পাল্টা ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। সংঘর্ষে ৬ ব্যক্তি আহত হয়েছে। খবর পেয়ে রূপগঞ্জ থানা পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনেন।
পরের দিন (১৯ অক্টোবর) শনিবার সকালে বিক্ষুব্ধ গ্রামবাসী লাটের শাস্তি দাবি করে বিক্ষোভ মিছিল করেছে। লাট ভূইয়া বহিরাগত সন্ত্রাসী নিয়ে মসজিদ ভাংচুর ও মসজিদের ক্যাশ বাক্স ভেঙে দেড় লাখ টাকা লুট করেছে। লাটের সেকেন্ড-ইন কমান্ড ডিশ বাবু ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে আমানউল্লাহ নামে এক ব্যক্তিকে শ্বাস রোধ করে হত্যা করেছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
রূপগঞ্জ থানার ওসি এ এফ এম সায়েদ বলেন, ওর বিরুদ্ধে অসংখ্য মামলা রয়েছে। শিগগিরই ব্যবস্থা নেয়া হবে। গ্রেপ্তারি পরোয়ানা থাকা সত্তে¡ও তাকে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে না কেন এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, গ্রেপ্তারি পরোয়ানা আছে কিনা জানা নেই। যদি থাকে অবশ্যই গ্রেপ্তার করা হবে।
রূপগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার ফয়সাল হক ভোরের আকাশকে বলেন, আমি অবগত নই। তবে শুনে মনে হচ্ছে ওকে শিগগিরই গ্রেপ্তার করা দরকার। আমি এ বিষয় নিয়ে ওসি সাহেবের সাথে কথা বলব।
ভোরের আকাশ/নি