গ্রাহকদের বোকা বানিয়ে টাকা আত্মসাৎ এবং বিদেশে পাচারের ঘটনা বহুকাল থেকেই। আর হুন্ডির মাধ্যমে টাকা পাচার করা অনেক পুরোনো অবৈধ রীতি। আধুনিক যুগে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যাপক উন্নয়নের ফলে অনলাইনে টাকা লেনদেনের অনেক বৈধ উপায় থাকা সত্তেও অবৈধ পথেই টাকা পাচার হচ্ছে বিভিন্ন প্রযুক্তির মাধ্যমে।
টাকা পাচারের প্রথম ঘটনাটি গণমানুষের দৃষ্টিতে আসে ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে প্রায় ১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার চুরির ঘটনায়। নিরাপত্তা হ্যাকারদের দ্বারা ঝডওঋঞ নেটওয়ার্কের মাধ্যমে ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব নিউইয়র্ক অ্যাকাউন্ট থেকে বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এই টাকা ফিলিপিন্সে এবং শ্রীলঙ্কায় চলে যায়।
অনলাইনে এভাবে বৈধ বা অবৈধভাবে টাকা পাচারের নিরবচ্ছিন্ন প্ল্যাটফর্ম হওয়ায় হালের হুন্ডি বাণিজ্য অনেকটা কমে এসেছিল। কিন্তু রাশিয়া-ইউক্রেনের যুদ্ধের অজুহাতে ডলার সংকটের কারণে হুন্ডি ব্যবসায়ীরা আবার সরব হয়েছে আধুনিক স্টাইলে। ‘হুন্ডি কারবারিরা’ আগে বাসাবাড়িতে গিয়ে নগদ টাকা পৌঁছে দিত। এখন এমএফএস বা ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে গ্রাহকের কাছে টাকা পৌঁছে দিচ্ছে, যা ‘ডিজিটাল হুন্ডি’ নামে পরিচিত।
সমসাময়িক সময়ে বাংলাদেশের ইতিহাসে অর্থ আত্মসাতের সর্ববৃহৎ ঘটনা ঘটে শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারিতে ২০০৯ থেকে ২০১১ সালের মধ্যে। বাজার দরপতনের নামে প্রায় ৪০ লাখ বিনিয়োগকারীর কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার নেপথ্যে নায়করা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যায়। শেয়ারবাজারে কোটি কোটি টাকা লুটপাটে সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের কতিপয় কর্মকর্তা জড়িত। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকও চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। এরপর দেশে ডিজিটাল প্রযুক্তির আশীর্বাদে অর্থ লেনদেনে বিকাশ, নগদ, সিওর ক্যাশ ইত্যাদি প্রচলন শুরু হয়।
ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অর্থ লেনদেনে এগুলো খুবই সহজ, নিরাপদ এবং স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করায় ব্যাংকিং লেনদেন এগুলোর অবস্থান এখন শীর্ষে। প্রাতিষ্ঠানিক কোনো ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট না খুলেও শুধু মোবাইল ফোনের মাধ্যমে অর্থ লেনদেনের এই সুযোগটি সব মহলের আস্থা অর্জন করতে সক্ষম হয়।
অসাধু ডিজিটাল প্রতারকরা গ্রাহকদের এই সুযোগটি কাজে লাগিয়ে টাকা পাচার করছে অবৈধ পন্থায়। বিকাশ, নগদ কিংবা অন্য কোনো অনলাইন অ্যাপসের মাধ্যমে অল্প বিনিয়োগে অধিক মুনাফা ও অন্যান্য লোভনীয় অফার দেয়। লেনদেনের হিসাবকে বিভিন্ন নম্বর (পয়েন্ট) দিয়ে গ্রাহকদের পদ-পদায়ন (সিইও, এমডি) করা হয়।
দেশের অল্প শিক্ষিত বিকাশ ও নগদ ব্যবহারকারীরা এ রকম পদ পেয়ে খুশিতে টগবগ করে, লোভে পড়ে আরো গ্রাহক বাড়ায়, নিজেও অধিক হারে বিনিয়োগ করতে থাকে। কিন্তু সে যে ডিজিটাল প্রতারকের খপ্পরে পড়েছে। এ কথা নিজেও বোঝে না, বোঝালেও বুঝে না। এক পর্যায়ে হঠাৎ একদিন দেখা যায় ওই প্ল্যাটফর্ম আর কাজ করে না। আর তখনই বুঝতে পারে যে, এতদিন সে নিমজ্জিত ছিল ডিজিটাল প্রতারণার ফাঁদে। এমন ঘটনা ঘটেছে স¤প্রতি এমটিএফইর মাধ্যমে।
মেটাভার্স ফরেন এক্সচেঞ্জ বা এমটিএফই অর্থ লেনদেনে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মাধ্যমে রোবটিকস ব্যবহারের নামে সাধারণ গ্রাহক বিশেষ করে গ্রামীণ এলাকার প্রবাসীদের মাধ্যমে ব্যবসাটি ছড়িয়ে দেয়। এক্ষেত্রে টাকাকে প্রথমে ডলার পরে ক্রিপ্টোকারেন্সি বা ভার্চুয়াল মুদ্রায় রূপান্তরিত করে গ্রাহককে পৌঁছে দেয়ার লোভনীয় অফার দেয়। গ্রামের সহজ সরল মানুষের মধ্যে আস্থা বাড়ানোর জন্য প্রক্রিয়াটিকে ইসলামী শরীয়তভিত্তিক ব্যবসা হিসেবে চালানো হয়।
এ কারণে অনেক ইসলামী চিন্তাবিদ, মাওলানা এবং ধর্মভীরু লোকজনও এই ব্যবসায় জড়িয়েছে ব্যাপক হারে। গ্রাহকের নগদ, বিকাশ বা রকেট নম্বর ছিল এমটিএফইর মাধ্যম। এরপর অ্যাপসভিত্তিক প্রযুক্তির ব্যবহার, ক্রিপ্টোকারেন্সি, ডলার, ইউরো ইত্যাদির মুনাফা এবং সিইও/এমডি বানানোর কৌশলগুলো সাধারণ মানুষকে আস্থায় এনেছিল দারুণভাবে।
এমন একটি সংস্থার বাংলাদেশে কোনো কার্যালয় না থাকলেও ছিল প্রায় পাঁচ শতাধিক সিইও। মুনাফা শুধু প্রতিদিন নয়, জ্যামিতিকহারে অ্যাকাউন্টে চলে আসবে এই লোভে জমাকৃত টাকা-পয়সা তো বটেই, জমি-জমা ও অন্যান্য স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি বিক্রি কিংবা ঋণ করে এমটিএফইতে বিনিয়োগ করে অনেকে। কিন্তু এটা যে কত বড় প্রতারণা ছিল। ঘুণাক্ষরেও তা কেউ বুঝতে পারেনি। এরপর যা হওয়ার তাই হয়েছে। প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকা নিয়ে উধাও হয়েছে প্রতারক চক্র। পথে বসেছে লাখ লাখ মানুষ।
২০১১-১২ সালে ‘ডেসটিনি-২০০০’ কর্তৃক টাকা হাতিয়ে নেয়ার অপকৌশল দেখেছে দেশবাসী। প্রায় ৪৫ লাখ গ্রাহকের চার হাজার ১১৯ কোটি টাকা আত্মসাৎ ও ৯৬ কোটি টাকা পাচারের অভিযোগে অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠানটি। একই আদলে ‘যুবক’ ২০০৬ সালে ৩ লাখ ৩৪ হাজার গ্রাহকের দুই হাজার ৬০০ কোটি টাকা, ‘ইউনিপেটুইউ’ ২০১১ সালে মাত্র ১০ মাসে ছয় লাখ বিনিয়োগকারীর ৬ হাজার কোটি টাকা এবং আইসিএল গ্রুপ ২০১৩ সালে প্রায় পাঁচ লাখ গ্রাহকের কাছ থেকে ৩ হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়।
২০১৮ সালে শুরু হয় ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের নামে এমএলএম ব্যবসা। প্রতারণার ফাঁদে পড়ে গ্রামের অশিক্ষিত, শিক্ষিত লোকজন থেকে শহরের উচ্চশিক্ষিত এলিট শ্রেণির লোকজনও। ই-ভ্যালির ১০০%, ১৫০% ক্যাশব্যাক অফার দেখে অল্প সময়ে গ্রাহক সংখ্যা ছাড়িয়ে যায় ৩৫ লাখ।
একইভাবে ব্যবসা শুরু করে ই-অরেঞ্জ, ধামাকা শপিং, কিউকম, এসপিসি ওয়ার্ল্ড, বুমবুম, আদিয়ান মার্ট, নিডস, দালাল, সিরাজগঞ্জ শপ, নিরাপদ ডটকম, আলাদিনের প্রদীপ, এসকে ট্রেডার্স, প্রিয়শপ, ২৪টিকেট.কম, গ্রিনবাংলা, এক্সিলেন্টবিগবাজার, ফাল্গুনিশপসহ প্রায় ২৬টি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান। একপর্যায়ে গ্রাহকদের অন্তত তিন হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে কেটে পড়ে নীরবে।
২০২০ সালে অ্যামাসবিডি.কম নামে একটি ওয়েবসাইট ও ফেসবুক পেজ খুলে মোটরসাইকেল, ফ্রিজ ও মোবাইল ফোনসহ বিভিন্ন পণ্য স্বল্পমূল্যে বিক্রির প্রলোভনে ফেলে ব্যাংক হিসাব এবং মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসের মাধ্যমে প্রায় ৩০০ গ্রাহকের সাড়ে সাত কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়।
ডিজিটাল কারেন্সি ব্যবহার করে অর্থ পাচারের অপর একটি কৌশল হচ্ছে ‘স্ট্রিমকার অ্যাপ’। সাধারণ মানুষকে আকৃষ্ট করতে বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া সুন্দরী তরুণী ও সেলিব্রিটিদের লাইভে এনে পাতা হয় ফাঁদ। অনেকে তরুণীদের খুশি করতে টাকা দিয়ে অনলাইন কারেন্সি কিনে তা উপহার দেন। তরুণীদের দিয়ে পাতা এই ফাঁদের মাধ্যমে স্ট্রিমকার অ্যাডমিনরা হাতিয়ে নেয় কোটি কোটি টাকা।
পরে তা পাচার করা হয় বিভিন্ন দেশে। এভাবে চক্রটি বিভিন্ন ব্যাংক, ক্রিপ্টোকারেন্সি ও হুন্ডির মাধ্যমে শতকোটি টাকা পাচার করেছে বলে দাবি পুলিশের (সংবাদ.নেট, ১৯ মে ২০২১)। এখনো সচল আছে এ ধরনের আরো অনেক প্রতিষ্ঠান। এরা কিভাবে নিবন্ধিত হয়, কি করে, কারা এর গ্রাহক, কিছুই কেউ জানে না।
এসব ছাড়াও নামে-বেনামে ব্যাংক লোন, জাল দলিল, ভুয়া ভাউচার, বিল এবং এলসি খুলে টাকা বিদেশে পাচারের ঘটনা নতুন কিছু নয়। ফলে নিঃস্ব হচ্ছে সাধারণ মানুষ। তাদের টাকায় তৈরি হচ্ছে বেগমপাড়া। শুধু ২০২০ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের জমা অর্থের পরিমাণ ৫ হাজার ২০১ কোটি। ২০২১ সালে এই অর্থের পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ৮ হাজার ২৭৬ কোটি টাকা হাইকোর্ট থেকে সুইস ব্যাংকে টাকা জমাকারী বাংলাদেশিদের তালিকা চেয়েও কোনো লাভ হয়নি।
তবে সরকারের কঠোর নির্দেশনার ফলে ইতোমধ্যে এই ব্যাংক থেকে সাড়ে ১০ হাজার কোটি টাকা সরিয়েছেন অন্যত্র, দেশে নয় (বিবিসি, ২৩ জুন ২০২৩)। তাহলে এক লাফে এত টাকা কোথায় তা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায় (মানবজমিন ২৬ জুন ২০২৩)।
তবে ক্যাসিনো ও অনলাইন জুয়ার মাধ্যমেও প্রতিনিয়ত বিপুল পরিমাণ টাকা পাচার হচ্ছে। শখে এবং পরিশ্রম ছাড়া ঘরে বসে আয় করতে গিয়েই আজকালকার তরুণ-তরুণীরা এই ফাঁদে পড়েন। তবে দেশে-বিদেশে অনুষ্ঠিত বিভিন্ন জনপ্রিয় ফুটবল-ক্রিকেট লিগ চলাকালেও অস্বাভাবিক মাত্রায় বেড়ে যায় জুয়ার এই থাবা।
বর্তমান সময়ে টাকা পাচারের এই ধারাকে ডিজিটাল প্রযুক্তির অপব্যবহারএবং গ্রাহকের বোকামি বলা যায়। কারণ, প্রযুক্তির কারসাজিতে বিশ্বব্যাপী টাকা চলাফেরা করছে আন্ডারগ্রাউন্ডে বা ওভারগ্রাউন্ডে। পরিত্রাণের জন্য ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সফটওয়্যার অবকাঠামোর আধুনিকায়ন, কঠোর নিরাপত্তা, সাইবার সিকিউরিটি বিশেষজ্ঞ ও সাইবার পুলিশের সার্বক্ষণিক নজরদারি বাড়াতে হবে। বিদেশি বিশেষ করে আফ্রিকানদের কঠোর নজরদারিতে রাখা উচিত।
দেশে বিদ্যমান মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২, ৪(২) ধারা মতে, টাকা পাচারের এই অপরাধে অন্যূন ৪ (চার) বছর এবং অনধিক ১২ (বার) বছর পর্যন্ত কারাদন্ডে দন্ডিত এবং এর অতিরিক্ত অপরাধ প্রমাণিত হলে সংশ্লিষ্ট সম্পত্তির দ্বিগুণ মূল্যের সমপরিমাণ বা ১০ (দশ) লাখ টাকা পর্যন্ত অর্থদন্ডে দন্ডিত হওয়ার কথা বলা আছে। এক্ষেত্রে আইনটি আরো সময়োপযোগী করা উচিত। আর গ্রাহকদের ‘ভাবিয়া করিও কাজ, করিয়া ভাবিও না’ নীতি মেনে চলতেই হবে।
লেখক : অধ্যাপক, তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, আইআইটি, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
ভোরের আকাশ/নি