logo
আপডেট : ৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ ১০:১৫
এক দফার আন্দোলনে জোরেশোরে মাঠে নামবে জামায়াত
এম সাইফুল ইসলাম

এক দফার আন্দোলনে জোরেশোরে মাঠে নামবে জামায়াত

এম সাইফুল ইসলাম: অবশেষে সরকারের পদত্যাগের দাবিতে চলমান এক দফার আন্দোলনে সর্বশক্তি দিয়ে মাঠে নামার সিদ্ধান্ত নিয়েছে জামায়াতে ইসলামী। সরকারবিরোধী এক দফার আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়া বিএনপির সঙ্গে দলটির নেতারা এ বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছেছেন বলেও জানা গেছে। তবে কৌশলগত কারণে জামায়াত একই দিনে একই সময়ে নিজস্ব প্ল্যাটফরমে থেকে আন্দোলনে যুক্ত থাকবে। বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচনে না যাওয়ার সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে দলটির তৃণমূলে আন্দোলন জোরদার করারও নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।

 

জামায়াতের কেন্দ্রীয় নেতারা বলছেন, দেশে গণতন্ত্র ও ভোটাধিকার ফিরিয়ে আনতে যুগপৎভাবে জাতীয় ঐক্যের ভিত্তিতে কর্মসূচির মাধ্যমে সরকারকে দাবি মানতে বাধ্য করা হবে। আর তৃণমূলের নেতারা বলছেন, বর্তমান সরকারের অধীনে জামায়াত কোনো নির্বাচনে যাবে না বলে কেন্দ্র থেকে তাদের কাছে বার্তা দেয়া হয়েছে। একইসঙ্গে জোরালো আন্দোলনের প্রস্তুতি নিতে বলা হয়েছে।

 

জানা গেছে, ক্ষমতার মেয়াদ শেষ হওয়ার পর প্রায় দুই বছর ১/১১-এর পরিস্থিতি পার করে ফের ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে জোটগতভাবে ভোট করে বিএনপি-জামায়াত। ওই ভোটে আওয়ামী লীগের কাছে পরাজিত হওয়ার পর সরকার গঠনের পরে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার শুরু করে মহাজোটের সরকার। সেই বিচারে দন্ড প্রাপ্ত জামায়াতের জ্যেষ্ঠ নেতাদের রায় কার্যকর করা হয়েছে।

 

এছাড়া ২০১৩ সালের আগস্টে সর্বোচ্চ আদালত জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল করলে দলটি নিজস্ব প্রতীক ‘দাঁড়িপাল্লা’ নিয়ে ভোট করার ক্ষমতাও হারিয়ে ফেলে। নেতাদের বিরুদ্ধে রায় ঘোষণা ও কার্যকর করা এবং ২০১৪ সালে নির্বাচন ঠেকানো ইস্যুতে জ্বালাও-পোড়াও আন্দোলনের ঘটনায় অসংখ্য মামলার ঘানি টানতে শুরু করেন দলটির নেতাকর্মীরা। ২০১৪ সালের নির্বাচনের পর জামায়াত নিজেদের আন্দোলনে বিএনপিকে পাশে না পাওয়াসহ নানা অবিশ্বাস ও মান-অভিমানে ২০১৮ সালের নির্বাচনের পর ২০-দলীয় জোটও অকার্যকর হয়ে পড়ে।

 

ফলে মাঠের রাজনীতি থেকে নিজেদের গুটিয়ে নিয়ে ‘দাওয়াতি’ ও সামাজিক কর্মকান্ডে ব্যস্ত রাখে দলটির নেতাকর্মীরা। ২০১৮ সালের নির্বাচনের পর পরাজিত হয়ে দলটি বিভিন্ন সেক্টরে দক্ষ লোকবল তৈরির মিশনে মাঠে নামে। আর বিএনপিও অনেকটাই ‘একলা চলো’ নীতিতে এগোতে থাকে। সেই প্রেক্ষাপটে গত বছরের ২৭ আগস্ট জামায়াতের আমির ডা. শফিকুর রহমান বিএনপি জোট ছাড়ার ঘোষণা দেন।

 

২০২২ সালের ৯ ডিসেম্বর গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে জোটের এক অনানুষ্ঠানিক সভায় বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট কার্যত ভেঙে দেয়া হয়। ১০ ডিসেম্বর রাজধানীর জনসভায় ১০ দফা দাবি আদায়ে কর্মসূচি ঘোষণা করে বিএনপি। এরপর গণতন্ত্র মঞ্চ, ১১ দলীয় জোট, জাতীয়তাবাদী সমমনা জোটসহ কয়েকটি দল নিজস্বভাবে বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ কর্মসূচি পালনের ঘোষণা দেন। ওই দিন বিকেলেই জামায়াতের আমির ড. শফিকুর রহমান বিএনপির কর্মসূচির সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করে বক্তব্য দেন। দু’দিন পর জামায়াতের আমির গ্রেপ্তার হলেও বিএনপি কোনো বিবৃতি না দেয়ায় জামায়াত বেশ মনোক্ষুণ্ণ হয়।

 

প্রথমদিকে বিএনপির যুগপৎ কর্মসূচিতে মাঠে ছিল জামায়াত। যুগপৎ কর্মসূচির প্রথমেই ৩০ ডিসেম্বর গণমিছিল পালনকালে রাজধানীর মৌচাকে পুলিশের সঙ্গে জামায়াত কর্মীদের সংঘর্ষের ঘটনায় বিএনপির পক্ষ থেকে কোনো বিবৃতি দেয়া বা খোঁজখবর না নেয়ায় জামায়াত-বিএনপি সম্পর্কে ফের টানাপোড়েন শুরু হয়। এছাড়া কর্মসূচি গ্রহণে জামায়াতের কোনো পরামর্শ না নেয়ায় বিএনপির প্রতি ক্ষুব্ধ হন দলটির নেতারা। ২০১৩-১৪ সালের মতো বিএনপিকে আন্দোলনে পাশে না পাওয়ার অভিজ্ঞতায় ফের যুগপৎ কর্মসূচিতে অংশ না নিয়ে নিজদের মতো চলতে থাকে দলটি।

 

দীর্ঘদিন এভাবে নীরবতা পালনের পর বাংলাদেশে অবাধ-নিরপেক্ষ ভোটে বাধা প্রদানকারীদের বিষয়ে গত ২৪ মে যুক্তরাষ্ট্র ভিসানীতি ঘোষণার পর নড়েচড়ে বসে জামায়াত। দলটি ৫ জুন রাজধানীর বায়তুল মোকাররম মসজিদের উত্তর গেটে বিক্ষোভ সমাবেশের ঘোষণা দেয়। পরে এই সমাবেশের অনুমতির আবেদন নিয়ে ডিএমপি কার্যালয়ে যান দলটির কয়েকজন আইনজীবী। তাদেরকে প্রথমে আটক করলেও পরবর্তীতে ছেড়ে দেয় পুলিশ। ৫ জুন জামায়াতকে পুলিশ সমাবেশের অনুমতি না দিলে দলটি কর্মসূচি পালন থেকে সরে এসে আবারো ১০ জুন কর্মসূচি পালনে অনুমতি চেয়ে আবেদন দেয়।

 

পরে জামায়াতকে রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিশনে সমাবেশের অনুমতি দেয়। সমাবেশের আগের দিন রাতে অনুমতি দিলেও দলটির বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মী সমাবেশে যোগ দেয়। ২০১৩ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি ঢাকার মতিঝিলে পুলিশের অনুমতি নিয়ে বড় ধরনের শোডাউন করেছিল বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। এরপর প্রকাশ্যে কোনো কর্মসূচি করার সুযোগ না পেয়ে মাঝে মধ্যেই ঝটিকা মিছিল আর ঘরোয়া কর্মসূচি পালন করেছে জামায়াত।

 

১০ জুনের ওই সমাবেশের পর নতুন করে আলোচনায় আসে জামায়াত। পর দলটিকে ভিসানীতির প্রভাবে পুলিশ সমাবেশ করতে দিতে বাধ্য হয়েছে বলে আলোচনা শুরু হয়। আবার আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে জামায়াতের সঙ্গে সরকারের কোনো আপস কিনা তা নিয়েও আলোচনা শুরু হয়। অবশ্য পরবর্তী দলটি সিলেট ও চট্টগ্রাম এবং ফের ঢাকায় সমাবেশ করতে চেয়ে অনুমতি না পাওয়ায় জামায়াতকে নিয়ে সন্দেহ বা অবিশ্বাস আর হালে পানি পায়নি।

 

জামায়াতের একাধিক সূত্র জানিয়েছে, মূলত ভোটাধিকার ফিরিয়ে আনতে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলনের জন্যে মাঠে নামার জোরালো প্রস্তুতি নিচ্ছে দলটি। সম্প্রতি জামায়াতের কর্মতৎপরতায় দেখা গেছে, কেন্দ্রীয় নেতারা বিভিন্ন জেলার নেতাদের নিয়ে যে ‘দায়িত্বশীল বৈঠক’ বা প্রশিক্ষণ কর্মশালা করেছেন সেখানে প্রাধান্য পেয়েছে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যু।

 

কারণ জনরায়ে সরকার পরিবর্তনের সুযোগ না হওয়া পর্যন্ত জামায়াত যে বিপর্যয়ের মধ্যে থাকবে সেটি দলটির নেতাদের কাছে স্পষ্ট। তারা মনে করছেন, বর্তমান সরকার ফের ক্ষমতায় আসতে পারলে আগামীতে জামায়াতের অস্তিত্ব আরো সংকটে ফেলতে সব পদক্ষেপ নেয়া হবে। এছাড়া তৃণমূলের নেতাদের নামে থাকা সব রাজনৈতিক মামলায় বিচারকাজ শেষ করবে সরকার।

 

দলটির পর্ববেক্ষণ, পশ্চিমা দেশসমূহ ছাড়া বিশ্বের গণতন্ত্রকামী বেশিরভাগ দেশ এখন নিরপেক্ষ নির্বাচনের ব্যাপারে কথা বলছে। একটি অবাধ নির্বাচনের সরকারের ওপরে নিকট অতীতে এভাবে চাপও সৃষ্টি হয়নি। তাই এই ইস্যুতে আন্দোলনের মোক্ষম সময় বলেও মনে করছে জামায়াত। বিএনপিসহ যেসব দল নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে ‘এক দফা’ আন্দোলনে আছে, সেখানে জামায়াতেরও সক্রিয়ভাবে আন্দোলনে থাকা জরুরি বলেও দলটির উপলব্ধি। সেজন্য আন্দোলনে মাঠ গোছাতে দলটির কেন্দ্রীয় নেতাদের সমন্বয়ে প্রতিদিন কোনো না কোনো জেলায় কর্মসূচি পালিত হচ্ছে।

 

জানা গেছে, বিএনপির প্রতি নানা মান-অভিমান থাকলেও জাতীয় স্বার্থে এবার বিএনপিসহ বিরোধীদের এক দফার আন্দোলনে এবার সর্বশক্তি দিয়ে মাঠে নামতে চায় জামায়াত। রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু না থাকলেও ইতোমধ্যে দলটির তৃণমূল স্পষ্ট যে, এই সরকারের অধীনে জামায়াত নির্বাচনে যাচ্ছে না। আগামীতে নেতাকর্মীদের মাঠে থাকার স্পষ্ট বার্তা দিয়েছে দলটির কেন্দ্র। দলটির তৃণমূল থেকে কেন্দ্রীয় একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্যের সত্যতাও পাওয়া গেছে।

 

গত ২ সেপ্টম্বর একটি অনলাইন কর্মসূচিতে যোগ দিয়ে জামায়াতের ভারপ্রাপ্ত আমির ও সাবেক সংসদ সদস্য অধ্যাপক মুজিবুর রহমান কেয়ারটেকার সরকার প্রতিষ্ঠা ও এক দফার দাবিতে রাজপথে আন্দোলন-সংগ্রামে নেতাকর্মীদের সক্রিয় হওয়ার আহব্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, দেশের জনগণ এই সরকারকে আর কোনো নির্বাচনী নাটক মঞ্চস্থ করতে দেবে না। তার কথায়ও জামায়াতের মাঠে নামার বিষয়টি স্পষ্ট।

 

এদিকে, দীর্ঘদিনের মিত্র জামায়াতের সঙ্গে দূরত্ব কমাতে বিএনপির হাইকমান্ড কাজ করছে বলে জানা গেছে। দুই দলের শীর্ষ পর্যায়ে নেতাদের সম্প্রতি বৈঠকের খবরও প্রকাশিত হয়েছে। আপাতত একই দিন একই সময়ে যুগপৎ আন্দোলনের কর্মসূচিতে অন্যান্য দলের মতো জামায়াত সর্বোচ্চভাবে মাঠে থাকবে বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

 

রাজধানীর রমনা থানা জামায়াতের সেক্রেটারি আতিকুর রহমান ভোরের আকাশকে বলেন, মান-অভিমান থাকলেও বিএনপি এগিয়ে আসলে জামায়াতের দিক দিয়ে কোনো প্রতিবন্ধকতা নেই। জাতীয় স্বার্থে মাঠে নামতে আমাদরকে প্রস্তুত থাকতে বলা হয়েছে। জামায়াত মাঠে নামার জন্য প্রস্তুত আছে।

 

বিষয়টি নিয়ে যশোর জেলা জামায়াতের কর্মপরিষদ সদস্য ও শিক্ষা, সহিত্য ও সংস্কৃতিবিষয়ক সম্পাদক ফজলুল হক ভোরের আকাশকে বলেন, ভোটাধিকার ও গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার আন্দোলনে মাঠে আছে জামায়াত। আগামীতেও মাঠে থাকবে।

 

জামায়াতের কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য মাওলানা আজীজুর রহমান ভোরের আকাশকে বলেন, মানুষের ভোটাধিকার ফিরিয়ে আনার প্রশ্নে জামায়াত সবসময় অগ্রসর ছিল। কারণ, সবকিছুর মূলে হচ্ছে গণতন্ত্র। ভোটাধিকার প্রয়োগের মাধ্যমে জনপ্রতিনিধি নির্বাচনের সুযোগ না থাকলে সেখানে গণতন্ত্র থাকে না। সেটি এখন বাংলাদেশে বিরাজমান। এই অবস্থার উত্তরণে দেশপ্রেমিক সব শক্তির সঙ্গে জামায়াতও আপসহীনভাবে মাঠে থাকবে।

 

জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য ও প্রচার সম্পাদক মতিউর রহমান আকন্দ বলেন, আমরা আন্দোলনে আছি। মানুষের ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠায় জামায়াত অগ্রণী ভূমিকা রাখবে। এই ইস্যুতে কোনো আপস করা বা ছাড় দেয়ার সুযোগ নেই।

 

জামায়াতের নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের ভোরের আকাশকে বলেন, বিএনপি ও জামায়াতের আন্দোলন হচ্ছে এই সরকারের পদত্যাগ এবং একটি নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে। এক্ষেত্রে সমস্ত জাতি ঐক্যবদ্ধ। কৌশলগত কারণে আমরা আমাদের প্ল্যাটফরম থেকে আন্দোলন করছি। বিএনপিসহ অন্য দলগুলো তাদের নিজস্ব প্ল্যাটফরম থেকে আন্দোলনে আছে। জাতির প্রয়োজনে জাতীয় ঐক্যমত্যের ভিত্তিতে যুগপৎ কর্মসূচি আসছে। সেই কর্মসূচিতে জামায়াত সর্বোচ্চভাবে মাঠে থাকবে।

 

ভোরের আকাশ/নি