শাহীন রহমান: টানা কয়েকদিনের গরমের পর রাতে বৃষ্টিপাতের প্রবণতা বেড়েছে। বিশেষ করে শেষ রাতে ভারী বৃষ্টিপাতের সঙ্গে মুহুর্মুহু বিদ্যুতের ঝলকানি আর বিকট বজ্রপাতের শব্দে ঘুম ভাঙছে রাজধানীবাসীর। এতে সাময়িকভাবে ভ্যাপসা গরম কমে যাওয়ায় কিছুটা হলেও স্বস্তি মিলছে। কিন্তু দিনের শুরুতে গরমের মাত্রা আবার বেড়ে যাচ্ছে।
আবহাওয়াবিদরা জানিয়েছেন, মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে রাজধানীসহ প্রায় সারা দেশেই বৃষ্টি হচ্ছে। রাজধানীতে ভোর রাতে বৃষ্টির পাশাপাশি বজ্রপাতের আওয়াজ অনেক বেশি। প্রায় আধাঘণ্টা ধরে টানা একের পর এক বিদ্যুৎ চমকানোর আলো, আর শব্দে কেঁপে উঠছে রাজধানীর মানুষ। প্রশ্ন দেখা দিয়েছে শেষ রাতে বৃষ্টির সঙ্গে কেন বাড়ছে বিকট বজ্রপাত।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আগস্ট মাসে স্বাভাবিকের চেয়ে প্রায় ৩৬ শতাংশ বেশি বৃষ্টিপাত হয়েছে। বেশি বৃষ্টিপাতের পরও ভ্যাপসা গরমের মাত্রা ছিল লক্ষণীয়। সেপ্টেম্বরের শুরুতে বৃষ্টিপাত বাড়লেও প্রকৃতিতে উত্তাপের মাত্রা অনেক বেশি। এছাড়া আবহাওয়া অফিসের এ মাসের দীর্ঘমেয়াদি পূর্বাভাসেও তাপপ্রবাহ বয়ে যাওয়ার ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে। অথচ আবহাওয়ার ধরন অনুযায়ী প্রকৃতি আস্তে আস্তে শান্ত হয়ে আসার কথা। অথচ এর পরিবর্তে তাপপ্রবাহ বয়ে যাওয়ার আভাস দেয়া হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে পরিবেশ উষ্ণ হয়ে পড়ায় বজ্রপাতের মতো দুর্যোগ বেড়েই চলেছে। সারা বছরের স্থায়ী দুর্যোগের রূপ নিচ্ছে এই বজ্রপাত।
গত কয়েকদিন ধরেই গভীর রাতে ভারী বৃষ্টিপাত হচ্ছে। সঙ্গে বাড়ছে বিকট শব্দে বজ্রপাতের মাত্রাও। রাজধানী ঢাকার আকাশও থাকছে আংশিক মেঘলা। তীব্র রোদ না থাকলেও প্রত্যাশিত মাত্রায় গরম কমেনি। আবহাওয়াবিদ মো. ওমর ফারুক বলেন, মৌসুমি বায়ু মোটামুটি সক্রিয় হয়েছে। ফলে এখন মাঝে মাঝেই ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় বৃষ্টি হবে। তবে গরম কমবে আরো পরে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন দেশে দুর্যোগের তালিকায় নতুন করে যুক্ত হয়েছে বজ্রপাত। সম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশে বজ্রপাতের মাত্রা অনেক বেড়েছে। প্রতি বছর এ কারণে ২ থেকে ৩শর বেশি মানুষ প্রাণ হারাচ্ছে। ফলে ২০১৬ সালে দুর্যাগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয় থেকে বজ্রপাতকে দুর্যোগের তালিকায় স্থান দেয়া হয়েছে।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের এক নির্দেশনায় বলা হয়েছে, এপ্রিল-জুনে বজ্রবৃষ্টি বেশি হয়। বজ্রপাতের স্থায়িত্ব সাধারণত ৩০-৪৫ মিনিট। এ সময়টুকু ঘরে অবস্থান করতে পরামর্শ দেয়া হয়েছে। এছাড়া ঘন কালো মেঘ দেখা দিলে ঘর থেকে বের হতে বারণ করা হয়েছে। অতি জরুরি প্রয়োজনে রাবারের জুতা পরে বাইরে বের হওয়া যাবে।
আবহাওয়ার ধরন অনুযায়ী প্রকৃতিতে এখন ভাদ্র মাস। ধীরে ধীরে প্রকৃতি শান্ত হয়ে আসার কথা। ভাদ্র-আশ্বিন কে বাংলায় শরৎকাল হিসেবে ধরা হয়। শরতের প্রকৃতি অনেক নরম হয়ে থাকে। কিন্তু আবহাওয়া অফিসের এ মাসের দীর্ঘমেয়াদি যে পূর্বাভাস দেয়া হয়েছে, সেখানে এই সেপ্টেম্বর মাসেও তাপপ্রবাহ বয়ে যাওয়ার আভাস দেয়া হয়েছে।
এতে বলা হয়েছে, এ মাসে দেশের উত্তরাঞ্চল (রংপুর), উত্তর-পূর্বাঞ্চল (সিলেট) ও দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে (চট্টগ্রাম) স্বল্প মেয়াদে বন্যা হতে পারে। একই সঙ্গে চলতি মাসে দিন ও রাতের তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি থাকতে পারে।
আবহাওয়া অফিসের বিশেষজ্ঞ কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে এ মাসে সামগ্রিকভাবে দেশে স্বাভাবিক বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা আছে। সেপ্টেম্বরে বঙ্গোপসাগরে ১ থেকে ২টি বর্ষাকালীন লঘুচাপ সৃষ্টি হতে পারে, এর মধ্যে একটি মৌসুমি নিম্ন চাপে পরিণত হতে পারে। দেশের উত্তর ও মধ্যাঞ্চলে ২ থেকে ৩ দিন বিজলি চমকানোসহ মাঝারি ধরনের বজ্রঝড় এবং সারা দেশে ৩ থেকে ৫ দিন বিজলি চমকানোসহ হালকা বজ্রঝড় হতে পারে বলেও জানান তারা। পাশাপাশি এ মাসে দেশে ২ থেকে ৩টি মৃদু (৩৬ থেকে ৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস) তাপপ্রবাহ বয়ে যেতে পারে জানিয়েছেন আবহাওয়া অধিদপ্তরের পরিচালক আজিজুর রহমান।
তিনি বলেন, সেপ্টেম্বরে দিন ও রাতের তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে কিছুটা বেশি থাকতে পারে। এ মাসে দেশের উত্তরাঞ্চল, উত্তর-পূর্বাঞ্চল ও দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে মৌসুমি ভারী বৃষ্টিপাতজনিত কারণে কয়েকটি স্থানে স্বল্প মেয়াদে বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে।
আবহাওয়া অধিদপ্তর আগস্ট মাসের পর্যবেক্ষণ তুলে ধরে দীর্ঘমেয়াদি পূর্বাভাস প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আগস্ট মাসে সারা দেশে স্বাভাবিকের চেয়ে ৩৬ শতাংশ বেশি বৃষ্টিপাত হয়েছে, তবে ময়মনসিংহ ও খুলনা বিভাগে স্বাভাবিক বৃষ্টিপাত হয়েছে। আগস্ট মাসে দেশের সর্ব্বোচ্চ তাপমাত্রা দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং সর্বনিম্ন তাপমাত্রা দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি ছিল। এছাড়া দেশের গড় তাপমাত্রা দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি ছিল বলে দীর্ঘমেয়াদি পূর্বাভাস প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে।
শুধু বাংলাদেশে নয়, বজ্রপাতের মাত্রা বেড়েছে পাশ্ববর্তী দেশ ভারতেও। ভারতের পূর্বাঞ্চলের রাজ্য ওড়িশায় শনিবার রাতে দুই ঘণ্টায় ৬১ হাজার বার বজ্রপাতের ঘটনা ঘটেছে। এর কবলে পড়ে মারা গেছেন ১২ জন। আহত হয়েছে ১৪ জন। এ ছাড়া রাজ্যটিতে আগামী ৭ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চরম আবহাওয়ার সতর্কতা জারি করেছে ভারতের আবহাওয়া বিভাগ।
এদিকে আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, এমন আবহাওয়ার কারণে আগামী কয়েকদিনের মধ্যে আরো বজ্রপাত হতে পারে। বঙ্গোপসাগরে পরবর্তী ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে সক্রিয় একটি লঘুচাপ সৃষ্টির আভাস রয়েছে।
আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, লঘুচাপ থেকে নিম্ন চাপে পরিণত হতে পারে। এর প্রভাবেও ব্যাপক বৃষ্টিপাত হতে পারে।
ভোরের আকাশ/নি