‘ঘোড়ার ব্যাপারী, তোমায় জিজ্ঞাসা করি। কত লাভ কইরাছো ঘোড়া বাইয়া?’ হাওর জনপদ নেত্রকোনা অঞ্চলে এক সময়ের জনপ্রিয় এই গানটির রচয়িতা জেলার কেন্দুয়া উপজেলার বৈশ্যপাট্টা গ্রামের বাউল প্রয়াত আবেদ আলী। গানটির কথা থেকেই বোঝা যায় যে, তখনকার সময়ে এ অঞ্চলে ঘোড়া এবং ঘোড়ার গাড়ির ব্যবহারের ব্যাপক প্রচলন ছিল। তবে বর্তমানে ঘোড়া ও ঘোড়ার গাড়ি কোনোটাই আর তেমন চোখে পড়ে না।
আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির চরম উৎকর্ষতার এই যুগে বর্তমানে পল্লি এলাকার কৃষকদের বিভিন্ন পণ্য পরিবহনে ঘোড়া ও গরুর গাড়ির চাহিদা প্রায় ফুরিয়েছে। তবে নেত্রকোনায় অনেক প্রত্যন্ত এলাকায় কদাচিৎ এখনো ঘোড়ার গাড়ির ব্যবহার দেখতে পাওয়া যায়। সম্প্রতি এমন দৃশ্যই দেখা গেছে কেন্দুয়া উপজেলার কান্দিউড়া ইউনিয়নের এক সময়ের প্রসিদ্ধ বাণিজ্য কেন্দ্র গোগবাজার এলাকায়। এ অঞ্চলে এখনো ঘোড়া ও ঘোড়ার গাড়ির বেশ কদর রয়েছে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।
সম্প্রতি প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চল থেকে ধানবোঝাই করে বেশ কয়েকটি ঘোড়ার গাড়ি গোগবাজারে নিয়ে আসতে দেখা যায়। ধান নিয়ে আসা এসব ঘোড়ার গাড়ির চালকদের সঙ্গে কথা হলে তারা জানান, গ্রামের কৃষকদের কাছ থেকে এসব ধান ক্রয় করেছেন স্থানীয় ধান ব্যবসায়ীরা। আর ব্যবসায়ীদের এ ধান গ্রামের কৃষকের বাড়ি থেকে নির্ধারিত স্থানে পৌঁছাতে আমাদের ঘোড়ার গাড়িগুলো ভাড়ায় ব্যবহার করা হয়। এর কারণ হলো- গ্রামাঞ্চলের বেশিরভাগ রাস্তাই কাঁচা। এসব রাস্তা দিয়ে যান্ত্রিক গাড়ির মাধ্যমে ধানসহ বিভিন্ন মালামাল পরিবহন করতে গেলে চরম দুর্ভোগে পড়তে হয়। তাই ঘোড়ার গাড়ি দিয়ে পরিবহন করা অনেকটাই সহজ। ফলে এসব কাঁচা রাস্তায় ঘোড়ার গাড়ির কদর রয়েছে।
তারা আরো জানান, বিভিন্ন ব্যবসায়ী ও সাধারণ মানুষের পণ্য বা মালামাল ভাড়ায় পরিবহনের কাজে ব্যবহৃত এই ঘোড়াগুলো বেশিরভাগই ব্যক্তি মালিকানাধীন। সাধারণত দুই চাকার একটি গাড়ি তৈরি করতে একটি ঘোড়া ব্যবহার করা হয়। পরে সেই গাড়িতে পরিবহন করা হয় বিভিন্ন পণ্য ও মালামাল।
স্থানীয় ধান ব্যবসায়ী আবুল কালাম বলেন, গ্রামের কাঁচা রাস্তায় যান্ত্রিক গাড়ি দিয়ে পণ্য বা মালামাল পরিবহন করা খুবই কষ্টের। তবে ঘোড়ার গাড়ি ব্যবহার করে এসব পরিবহন করা কিছুটা সহজ। তাই গ্রামের কৃষকদের বাড়ি থেকে ধান সংগ্রহ করে ঘোড়ার গাড়ি দিয়ে বাজারে নিয়ে আসতে অনেক সুবিধা হয়। এতে ভাড়াও অনেকটা কম লাগে।
এ ছাড়া স্থানীয় বিভিন্ন দুর্গম গ্রাম এলাকার কৃষকদের উৎপাদিত কৃষি পণ্য ও নিত্য পণ্য পরিবহনে ঘোড়ার গাড়ি অগ্রণী ভূমিকা রাখছে এবং অনেকেই ঘোড়ার গাড়ির মাধ্যমে এলাকায় পরিবহন সেবা দিচ্ছেন। এতে করে ঘোড়ার গাড়ির মালিকদের ব্যক্তিগত আয়ের পাশাপাশি আশপাশের কৃষকরা এবং ব্যবসায়ীরা স্বল্প খরচে সেবা পাচ্ছেন বলেও জানান ভুক্তভোগীরা।
কথা হলে স্থানীয় গোগবাজার ঋষিপাড়ার বাসিন্দা ঘোড়ার গাড়ি চালক ইঞ্জিন মিয়া বলেন, আমাদের সাতজনের সাতটি ঘোড়ার গাড়ি রয়েছে। আমরা গ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে বিভিন্ন মালামাল ভাড়ার বিনিময়ে পরিবহন করে থাকি। আমাদের গাড়িতে এসব পরিবহন করতে পারিশ্রমিক নির্ধারণ হয় পণ্যের পরিমাণ ও গন্তব্যের দূরত্বের ভিত্তিতে।
প্রতিদিন কেমন আয় হয় জানতে চাইলে তিনি বলেন, প্রতিদিন গাড়ি চালালে ৫শ থেকে ১ হাজার বা আরো বেশি টাকা ইনকাম করা যায়। গাড়ি চালালে ঘোড়ার খাবার বাবদ ২শ থেকে ৩শ টাকা খরচও হয়। তবে যান্ত্রিক গাড়ির চেয়ে ঘোড়ার গাড়িতে পরিবহন খরচ অনেক কম। তাই আমাদের এখানে কদরও একটু বেশি।
স্থানীয় কান্দিউড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. মাহাবুব আলম বাবুল বলেন, ঘোড়ার গাড়ি এক সময় এ এলাকার মানুষের একমাত্র বাহন ছিল। প্রায় প্রতি বাড়িতে ঘোড়া ছিল। কিন্তু বর্তমানে তা নেই বললেই চলে। তবে এখনো আমাদের কিছু এলাকায় ঘোড়ার গাড়িতে পণ্য পরিবহন করতে দেখা যায়।
স্থানীয় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) কাবেরী জালাল বলেন, আমাদের দেশের গ্রামীণ জনপদের কাঁচা মেঠো পথে যাতায়াত ও মালামাল পরিবহনের ক্ষেত্রে গরু ও ঘোড়ার গাড়ির বহুল প্রচলন পরিলক্ষিত হতো। বর্তমানে দেশের গ্রামীণ জনপদের বেশিরভাগ কাঁচা ও মেঠোপথকে আধুনিকায়ন করা হয়েছে। ইঞ্জিনের স্পর্শে গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী অনেক যানবাহনই পুরোপুরি বিলুপ্ত হয়ে গেছে।
বর্তমানে হাতে গোনা দু-একটা গ্রামে ঘোড়ার গাড়ি দেখা গেলেও তা জরাজীর্ণ। এ প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা তো ঘোড়ার গাড়ির সাথে খুব একটা পরিচিতই নয়। শুধু প্রয়োজনীয় যানবাহন হিসেবে না ভেবে ঐতিহ্য রক্ষার স্বার্থে এবং শিশু-কিশোরদের নির্মল আনন্দের উৎস হিসেবে ঘোড়ার গাড়ি সংরক্ষণে আমাদের উদ্যোগী হওয়া প্রয়োজন। বাংলা এবং বাঙালির ঐতিহ্যগুলোকে আমাদের ধরে রাখতে হবে।
ভোরের আকাশ/নি