যে হারে নারীর অগ্রগতি হয়েছে সে হারে কমেনি নারীর প্রতি সহিংসতা। বিভিন্ন ক্ষেত্রে উন্নতি ঘটলেও নারীর প্রতি সহিংসতা কমেনি আশানুরূপ। বরং ক্রমান্বয়ে এ সহিংসতা বেড়েই চলেছে। নারীর প্রতি সব ধরনের সহিংসতা ও বৈষম্য বিলোপ সনদ (সিডও) পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নের দাবি উঠেছে। গতকাল ছিল আন্তর্জাতিক সিডও দিবস।
সাম্প্রতিক বছরগুলোয় অর্থনৈতিকভাবে বাংলাদেশের অনেক অগ্রগতি হয়েছে। অগ্রগতি হয়েছে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও নারীর ক্ষমতায়নসহ বিভিন্ন সামাজিক সূচকেও। এ সময়ে পরিবর্তন এসেছে নারীর অবস্থা ও অবস্থানেও। বর্তমানে সমাজের প্রায় সব খাতেই নারীর অংশগ্রহণ দৃশ্যমান হচ্ছে। শিক্ষার প্রাথমিক স্তরে মেয়েদের উপস্থিতি এখন শতভাগ। পোশাকশিল্পের কৃতিত্বের সিংহভাগই নারীর।
কিন্তু প্রশ্ন উঠছে- বাংলাদেশে মোট জনসংখ্যার ৫০ শতাংশই যেখানে নারী, সেখানে অগ্রগতি দৃশ্যমান হচ্ছে খুব অল্পসংখ্যক নারীর মধ্যেই। নারীর ক্ষমতায়ন ও উন্নয়ন ছাড়া দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন সম্ভব নয়। সরকার দেশের নারী সমাজের সার্বিক উন্নয়ন, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে নিরলসভাবে কাজ করে চলেছে। সরকার নারী শিক্ষার বিস্তার ও নারী অধিকার প্রতিষ্ঠাসহ নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ, কর্মক্ষেত্রে অবাধ প্রবেশ ও নীতি নির্ধারণে নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে বহুমুখী পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করছে। এরপরও ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে ঘরে-বাইরে নারীর নিরাপত্তা।
সম্প্রতি অ্যাকশন এইড বাংলাদেশ এবং ব্র্যাকের দুটি গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশের শতকরা ৮৮ জন নারী রাস্তায় চলার পথে যৌন হয়রানিমূলক মন্তব্যের শিকার হন, যেখানে সিংহভাগ পারপেট্রেটরই গণপরিবহনের চালক ও হেলপাররা। দেশব্যাপী যে হারে ধর্ষণের ঘটনা বৃদ্ধি পেয়েছে, তাতেও উদ্বিগ্ন না হয়ে পারা যায় না। স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন ওঠে, এ কোন বর্বরতার মধ্যে আমরা বসবাস করছি?
ধর্ষণ ও যৌন নির্যাতনের খবর যত বেশি পাওয়া যায়, এসব অপরাধের দায়ে অপরাধীদের শাস্তির দৃষ্টান্ত তার চেয়ে অনেক কম। ধর্ষককামীরা এত দিনে জেনে গেছে, ধর্ষণ করলে তাদের খুব একটা সমস্যা হয় না। এর প্রতিকার নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে। ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য অর্জন করতে হলে অবশ্যই এর ৫ নম্বর লক্ষ্য অর্জনে সাফল্য দেখাতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা ছিল একটি বৈষম্যহীন সমাজ বিনির্মাণ।
বাংলাদেশের সংবিধানেও এর প্রতিফলন আছে। কিন্তু ৫০ বছরে কি আমরা বৈষম্যহীন সমাজ নির্মাণ করতে পেরেছি?
সিডও সনদের শর্ত বাস্তবায়ন করতে হলেও নারী-পুরুষ বৈষম্য দূর করার কোনো বিকল্প নেই। সিডও সনদের ২ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে- যেসব আইন, রীতি, প্রথা নারীর প্রতি বৈষম্য তৈরি করে তা বাতিলের জন্য সনদে স্বাক্ষরকারী রাষ্ট্রগুলোকে অবশ্যই ব্যবস্থা নিতে হবে। এ ধারাকে নারী-পুরুষের সাম্য প্রতিষ্ঠার মূল মন্ত্র হিসেবে গণ্য করা হয়।
কিন্তু সরকারগুলো নারী-পুরুষের সমতা বিধানের লক্ষ্যে মূল কাজ করতে এখনো প্রস্তুত নয় বলে মনে হচ্ছে। দেশে বৈষম্যমূলক আইন, বিধি, প্রথা বিলোপে সরকারের বাধা কোথায়- সেটা একটা প্রশ্ন। নারীর ক্ষমতায়নের জন্য সম্পদে সমানাধিকার প্রতিষ্ঠা করা অত্যন্ত জরুরি।
সর্বোপরি আমরা বলতে পারি যে, নারীর নিরাপত্তা-মর্যাদা ও ক্ষমতায়নের মাধ্যমে বাংলাদেশ একটি আধুনিক কল্যাণমুখী ও কার্যকর রাষ্ট্রে পরিণত হতে পারে।
ভোরের আকাশ/নি