টাঙ্গাইলে বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ) এক বছরে রাজস্ব আদায় কমেছে ৪২ লাখ ৯ হাজার ২০৯ টাকা। দালালদের দৌরাত্ম্য, সরকারি ফির বাইরে অতিরিক্ত টাকা আদায়, অনলাইন আবেদন বুঝতে না পারায় অহেতুক হয়রানিসহ নানা কারণে অংশীজনরা মুখ ফিরিয়ে নেয়ায় রাজস্ব আদায় কমেছে।
টাঙ্গাইল বিআরটিএ সূত্রে জানা গেছে, মোটরযান রেজিস্ট্রেশন, মালিকানা বদলি, রোড পারমিট, ফিটনেস নবায়ন, ড্রাইভিং লাইসেন্স ইত্যাদি কার্যক্রম থেকে ২০২২-২৩ অর্থবছরে রাজস্ব আদায় হয়েছে ৬ কোটি ৪৭ লাখ ৬৫ হাজার ৪৫৭ টাকা। এর মধ্যে ৮ হাজার ৭৮১টি মোটরযান রেজিস্ট্রেশন থেকে আদায় হয়েছে ৩ কোটি ৫৬ লাখ ৭২ হাজার ৫২৩ টাকা। ৪২৭টি মোটরযানের মালিকানা পরিবর্তনে রাজস্ব আদায় হয়েছে ৭ লাখ ৯৭ হাজার ৭৯৫ টাকা। এক হাজার ২৪৬টি ফিটনেস নবায়নে ২৭ লাখ ২৬ হাজার ৬২৪ টাকা। ৩০৮টি রোড পারমিট নবায়নে আদায় হয়েছে ১০ লাখ ৯১ হাজার ৫৩১ টাকা।
৬ হাজার ৯১২টি ট্যাক্স টোকেন ইস্যু করে আদায় হয়েছে এক কোটি ৬০ লাখ ১২ হাজার ৮৭৩ টাকা। ২৩ হাজার ২০১টি শিক্ষানবিস ড্রাইভিং লাইসেন্স (লার্নার) ইস্যু থেকে আদায় হয়েছে ৭৭ লাখ ৫২ হাজার ৩৪১ টাকা। অথচ করোনা মহামারির প্রভাব থাকলেও ২০২১-২২ অর্থবছরে ওইসব খাত থেকে রাজস্ব আদায় হয়েছে ৬ কোটি ৮২ লাখ ৬২ হাজার ৮৯৬ টাকা। যা বর্তমান বছরের চেয়ে প্রায় অর্ধকোটি টাকা বেশি।
সরকারের রাজস্ব কমলেও সহকারী পরিচালক মো. আলতাব হোসেনের পকেট দিন দিন ভারী হচ্ছে। নির্ভরযোগ্য একটি সূত্র জানায়, মো. আলতাব হোসেন ২০০৬ সালের দিকে বিআরটিএতে ইন্সপেক্টর (মোটরযান) পদে যোগদান করেন। পদোন্নতি পেয়ে সহকারী পরিচালক হিসেবে টাঙ্গাইলে যোগদান করেন। সহকারী পরিচালক হয়ে তিনি টাঙ্গাইল বিআরটিএকে ব্যক্তিগত টাকার উৎস হিসেবে ব্যবহার শুরু করেন। সরকারের রাজস্ব কমলেও তিনি কামাই করতে থাকেন কাড়ি কাড়ি টাকা। সেই টাকায় ঢাকায় তিনি দুটি বাড়ি ও একটি আড়াই কাঠা প্লট কিনেছেন।
পল্লবীর ইস্টার্ন হাউজিংয়ে ‘কে’ ব্লকের ৪ নম্বর রোডের ২৪ নম্বর প্লটে তিনি ছয়তলা বিলাসবহুল বাড়ি করেছেন। ঢাকা মেট্রো-গ-২৭-২৫২৫ নম্বরের একটি প্রাইভেটকারের মালিকও তিনি। তবে গাড়িটি তার পরিবারের সদস্যরা ব্যবহার করেন। পশ্চিম ভাসানটেকের শ্যামল পল্লী আবাসিক এলাকায়ও মো. আলতাব হোসেন তিনতলা বাড়ি করেছেন। ওই বাড়িটি দেখভাল করেন তার মামা পরিচায় দানকারী অটোরিকশাচালক আলহাজ। মিরপুরের জল্লাদখানা এলাকায় তার আড়াই কাঠার একটি প্লটও রয়েছে। এর বাইরে আলতাফের আরো সম্পত্তি থাকলেও সেগুলো সুনির্দিষ্টভাবে জানা যায়নি।
সরেজমিনে দীর্ঘ দুই মাস পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেছে, একটি টেবিল নিয়ে বসে আছেন সাজেদুল করিম সাজু নামে এক যুবক। তিনি বিআরটিএ’র কেউ নন। স্মার্টকার্ড (লাইসেন্স) গ্রহণ করতে প্রাপকদের টাকা দেয়ার নিয়ম না থাকলেও তিনি ২০০ টাকা নিয়ে লাইসেন্স বিলি করছেন।
তিনি জানান, সব টাকাই সহকারী পরিচালক নিয়ে থাকেন। তিনি শুধু গ্রহণ করেন মাত্র। টাঙ্গাইল বিআরটিএ’র শিক্ষানবিস ড্রাইভিং লাইসেন্স (লার্নার) ইস্যু থেকে লিখিত, মৌখিক (ভাইভা) ও ব্যবহারিক (প্র্যাকটিকাল) পরীক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করেন ইন্সপেক্টর গোলাম সরওয়ার। তাকে সব কাজে সহযোগিতা করেন আল আমিন নামে এক যুবক।
কিন্তু তার কথায় ইন্সপেক্টর ও সহকারী পরিচালক সব কাজই করেন। অথচ ওই যুবক বিআরটিএ’র কেউ নন। আল আমিন শিক্ষানবিস লাইসেন্স গ্রহণকারীদের কাছ থেকে তিনটি পরীক্ষায় পাস করিয়ে দেয়ার নিমিত্তে পাঁচ হাজার করে টাকা আদায় করে থাকেন। দিনশেষে ওই টাকা অফিসার ও নিজেদের মধ্যে ভাগবাটোয়ারা করে নেন। সবাই তাকে বিআরটিএ’র আলআমিন হিসেবে চিনেন।
টাঙ্গাইল বিআরটিএ’র সব ধরনের রেজিস্ট্রেশন অফিসের রেজিস্ট্রারে লিখে রাখার কাজ করেন বেল্লাল হোসেন মিলন নামে অপর যুবক। তিনি গ্রাহকদের নাম-ঠিকানা লিপিবদ্ধ করার সময় সরকারি ফি’র বাইরে মোটরসাইকেল রেজিস্ট্রেশন করতে এক হাজার, সিএনজিচালিত অটোরিকশা রেজিস্ট্রেশনে ৮ হাজার টাকা অতিরিক্ত নিচ্ছেন। ফিটনেসের ক্ষেত্রে অনলাইনে অ্যাপয়েন্টমেন্ট প্রক্রিয়া গ্রাহকের সম্পন্ন করার বিধান থাকলেও তারা নিজেরাই করে নেন। অনলাইনে অ্যাপয়েন্টমেন্ট দেখানো হলেও গাড়ি না দেখেই রেজিস্ট্রেশন ও ফিটনেস সনদ দেয়া হচ্ছে। এজন্য গ্রাহকের কাছ থেকে আলাদা নানা অংকের টাকা নেয়া হয়।
জেলা প্রশাসনের ১১৪ নম্বর রুমে ড্রাইভিং লাইসেন্স প্রাপ্তির মৌখিক (ভাইভা) পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। ওই পরীক্ষায় একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট, ট্রাফিক ইন্সপেক্টর ও বিআরটিএ’র একজন ইন্সপেক্টর থাকার বিধান রয়েছে। কিন্তু প্রতিটি মৌখিক পরীক্ষায় অফিসের উচ্চমান সহকারী মো. কামরুল হোসেন অংশ নেন। ইতোপূর্বে উল্লিখিত পাঁচ হাজার টাকা পরিশোধকারীদের তিনি মৌখিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ দেখান। কেউ টাকা দিতে অস্বীকার করলে তাকে অকৃতকার্য দেখানো হয়।
জানা গেছে, টাঙ্গাইল বিআরটিএ’র সহকারী পরিচালক মো. আলতাব হোসেন রোববার অফিস করেন না। মোবাইল ফোনে বা অফিসে গিয়ে কেউ জিজ্ঞাসা করলে অফিস থেকে বলা হয়, তিনি জরুরি কাজে ঢাকায় আছেন বা অফিসের কাজে মধুপুর কিংবা অন্য কোনো উপজেলায় গেছেন। কিন্তু দুই মাস ওই অফিসের আশপাশে অবস্থান করে রোববার তার অফিসে না আসার বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া গেছে।