logo
আপডেট : ৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ ১০:৫৫
নতুন নতুন প্রযুক্তি ব্যবহার
চিহ্নিত পাচারকারীদের বিরুদ্ধে সাঁড়াশি অভিযান শিগগিরই
মোতাহার হোসেন

চিহ্নিত পাচারকারীদের বিরুদ্ধে সাঁড়াশি অভিযান শিগগিরই

মোতাহার হোসেন: নতুন নতুন কৌশলে মানব পাচার করা হচ্ছে প্রতিবেশী দেশ ভারতসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে সহজ-সরল মানুষকে ভুল বুঝিয়ে নানা রকম প্রলোভন দেখিয়ে মানব পাচার করা হচ্ছে। পাচারকারীদের মধ্যে নারী-শিশু, যুবক-যুবতীরাও রয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের হিসাবে বছরে প্রায় দুই লাখ মানুষকে পাচার করা হয়। এর বেশির ভাগ পাচার করা হয় প্রতিবেশী দেশ ভারতে।

 

এর পরে রয়েছে পাকিস্তান, মালয়েশিয়া প্রভৃতি দেশ। আবার সাগর পথে ইউরোপ পাঠানোর নামে মাঝপথে দ্বীপে নামিয়ে দেয়া হয়। এ কারণে প্রায়শই নৌকাডুবিতে অনেক বাংলাদেশির মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। শিগগিরই এসব চিহ্নিত পাচারকারীদের বিরুদ্ধে সাঁড়াশি অভিযানে নামছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। একইসঙ্গে এ সংক্রান্ত মামলাসমূহ দ্রুত নিষ্পত্তির উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের।

 

সূত্র জানায়, একশ্রেণির অসাধু বিক্রুটিং এজেন্সির মালিক অধিক মুনাফার লোভে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে তাদের নিয়োজিত দালালের মাধ্যমে গ্রামের স্বল্প শিক্ষিত, অশিক্ষিত তরুণী, যুবতী, যুবকদের মিথ্যা প্রলোভন দেখিয়ে বিদেশে চাকরি দেয়ার নামে বিক্রি করে দেয়। ভারত, মধ্যপ্রাচ্যের দেশসমূহ ছাড়াও সৌদি আরব, দুবাই, আবুধাবি, কুয়েত, কাতার, মালয়েশিয়া, পাকিস্তানে পাচার করা হয়। প্রতিজন দুই লাখ থেকে সর্বোচ্চ ৪-৫ লাখ টাকা হারে নিয়ে থাকে পাচারকারী চক্র।

 

সূত্র জানায়, আগে মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়ে, ফুঁসলিয়ে বা লোভ দেখিয়ে একসময় মানব পাচার করা হতো। এখন সেখানে বড় উপাদান হয়ে উঠেছে প্রযুক্তি। মানব পাচারের শিকার ধরতে, তাদের পরিবারের কাছ থেকে মুক্তিপণ আদায়ে বা পাচারকারীদের নিজেদের মধ্যেও যোগাযোগে প্রযুক্তির ব্যবহার বেড়েছে। বিষয়টি বেরিয়ে এসেছে মানব পাচারবিরোধী দিবসের আলোচনায়।

 

বলা হয়েছে, মানব পাচারকারীরা শিকার চিহ্নিত করতে, দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে ফাঁদে ফেলতে বা তাদের নিয়ন্ত্রণ করতে প্রযুক্তি ব্যবহার করছে।

 

বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর কত মানুষ পাচারের শিকার হন, তার সঠিক কোনো তথ্য বা পরিসংখ্যান নেই। তবে ইউরোপীয় কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, গত এক দশকে বাংলাদেশ থেকে ইউরোপে প্রবেশ করেছে ৬৫ হাজারের বেশি মানুষ।

 

অভিবাসন সংস্থাগুলোর তথ্য অনুযায়ী, প্রতি বছর গড়ে ৫ হাজার মানুষ বাংলাদেশ থেকে এভাবে উন্নত দেশগুলোয় যাওয়ার চেষ্টা করে। অভিবাসন বিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা ফ্রন্টিয়ারের সাম্প্রতিক তথ্যে বলা হয় , যত মানুষ ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপে ঢোকার চেষ্টা করে আটক হয়েছে, বাংলাদেশ সেই তালিকায় তৃতীয়।

 

সূত্রমতে, কখনো কখনো প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় ও টাইফুনের কারণেও লাখ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হওয়ার পর বেড়েছে মানব পাচারের ঘটনা। জাতিসংঘের মাদক ও অপরাধ বিষয়ক কার্যালয় (ইউএনওডিসি) এক প্রতিবেদনে এমনটাই জানিয়েছে। প্রতিবেদনটি ৩ বছরের সংগৃহীত ১৪১টি দেশের তথ্য এবং ৮০০টি আদালতের মামলার বিশ্লেষণ করে তৈরি করা হয়।

 

প্রতিবেদনে বলা হয় জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ‘অনুপাতিকভাবে’ দরিদ্র কৃষিকাজ, মাছ ধরা এবং অন্যান্য সম্প্রদায়কে প্রভাবিত করেছে যা মূলত তাদের জীবিকার জন্য প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণের ওপর নির্ভর করে। শুধু ২০২১ সালে জলবায়ু-সম্পর্কিত বিপর্যয়গুলো অভ্যন্তরীণভাবে ২ কোটি ৩৭ লাখের বেশি লোক বাস্তুচ্যুত হয়েছে। মাদক ব্যবসা ও অস্ত্র পাচারের পর মানব পাচার হচ্ছে বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম অপরাধমূলক কার্যক্রম। মানব পাচারের সঙ্গে প্রথম দুটি অপরাধও প্রায়ই জড়িয়ে থাকে।

 

ভালোভাবে বেঁচে থাকার আশায় কিংবা একটু উন্নত জীবনের প্রত্যাশায় মানুষ অপেক্ষাকৃত উন্নত দেশগুলোতে পাড়ি জমান; কিন্তু বৈধভাবে যাওয়ার সুযোগ খুব কম। আর এ সুযোগটাই নেয় দালাল শ্রেণি। ভালো চাকরি, লোভনীয় সুযোগ-সুবিধার কথা বলে অভিবাসন প্রত্যাশীদের আকৃষ্ট করে। তারপর টাকা-পয়সা হাতিয়ে নিয়ে তাদের ঠেলে দেয় ভয়ংকর বিপদের মুখে। জীবনও দিতে হয় অনেককে। ভ‚মধ্যসাগরে ট্রলারডুবির ঘটনা ঘটেছে। বহু বাংলাদেশির সলিল সমাধি হয়েছে।

 

অনেককে লিবিয়ার মরুভূমিতে অস্থায়ী আশ্রয় কেন্দ্রে রেখে নির্যাতনও করা হয়। নির্যাতনের ভিডিও পরিবারকে দেখিয়ে মুক্তিপণ আদায় করা হয়। এমন ঘটনা ঘটে অন্যান্য গন্তব্যেও। নৌকায় মালয়েশিয়ায় পাড়ি জমাতে গিয়ে অনেকেরই সলিল সমাধি হয়েছে। থাইল্যান্ডের জঙ্গলে বাংলাদেশিদের বহু গণকবরেরও সন্ধান পাওয়া গেছে। তারপরও এমন ঝুঁকিপূর্ণভাবে বিদেশে পাড়ি জমানো বন্ধ হয়নি। আর এর প্রধান কারণ, দেশজুড়ে মানবপাচারকারীদের বিস্তৃত নেটওয়ার্ক। তাদের অন্যতম টার্গেট তরুণ বা যুবক শ্রেণি।

 

মানব পাচারের সঙ্গে বাড়ছে মাদক কারবার। এসব নিয়ন্ত্রণ ও অপরাধ প্রতিরোধে কাজ করা জাতিসংঘের সংস্থা ইউএনওডিসি, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও বাংলাদেশ সরকারের যৌথ উদ্যোগে পরিচালিত প্রথম জাতীয় মানব পাচার বিষয়ক গবেষণায় দেখা যায়, মানব পাচারের শিকার মানুষের বেশিরভাগই অত্যন্ত গরিব এবং জীবিকার তাগিদে এ পথে পা দেন।

 

বিশেষ করে পাচারকারীরা রংপুর অঞ্চলের পাঁচ জেলা; বান্দরবান, কিশোরগঞ্জ, মাগুরা ও জামালপুর জেলার বাসিন্দাদের লক্ষ্যবস্তু বানিয়ে বিদেশে পাচার করে থাকেন। বাংলাদেশ থেকে মানব পাচারের কারণ ও ঝুঁকি চিহ্নিত করার পাশাপাশি ওই প্রতিবেদনে কিছু সুপারিশও করা হয়েছে, যার মধ্যে আছে অপরাধ দমনে শক্তিশালী প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলা, ভুক্তভোগীদের আইনি সুরক্ষা নিশ্চিত করা, মানব পাচার ও জোর করে শ্রম বন্ধ করতে কৌশলপত্র প্রণয়ন।

 

আইআইইডি ও দাসপ্রথাবিরোধী সংস্থার গবেষকরা বলেন, উত্তর ঘানায় তীব্র খরার কারণে তরুণ জনগোষ্ঠী শহরের দিকে ছুটছেন। কুলি-মজুরের কাজ করা অনেক নারী পাচার হয়েছে, যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছে। ঋণের কারণে নিজেদের বিক্রি করা আধুনিক দাসত্বের নতুন পথ তৈরি করেছে। বিপুল দেনা পরিশোধের জন্য কর্মীকে কাজের চক্রে বেঁধে রাখা হয়।

 

সম্প্রতি আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা জানায়, সারাবিশ্বে ২৭ মিলিয়ন মানুষ নানাভাবে দাসত্বের মধ্যে রয়েছে। এর মধ্যে ভারত, পাকিস্তান, নেপাল ও বাংলাদেশেই রয়েছে ১০ থেকে ১৫ মিলিয়ন আধুনিক দাস। সরকারি হিসাব মতে, প্রতি বছর ১৪ থেকে ১৭ হাজার মানুষ পাচারের শিকার হয়ে যুক্তরাষ্ট্রে ঢুকছে এবং বাধ্যতামূলক শ্রম বা দাসত্বের শিকার হচ্ছে। বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী ২০৫০ সাল নাগাদ জলবায়ু সংকটের প্রভাব যেমন- ফসলহানি, পানির অভাব ও সমুদ্রের উচ্চতা বৃদ্ধিতে আফ্রিকা, দক্ষিণ এশিয়া, লাতিন আমেরিকার ৬টি অঞ্চলে ২ কোটি ১৬ লাখ মানুষ ঘরবাড়ি ছাড়তে বাধ্য হবে।

 

তাছাড়া যুক্তরাষ্ট্রে ২ লাখ ৪০ হাজার থেকে ৩ লাখ ২৫ হাজার নারী ও শিশু যৌন নির্যাতনে শিকার হয়। যুক্তরাষ্ট্রের পাশাপাশি বিভিন্ন প্রতিবেদনে দেখা যায়, গোটা ইউরোপে বিশাল এক শ্রমদাসের রাজত্ব তৈরি হয়েছে। স্থানীয় শ্রমিক ইউনিয়নগুলো মূলত তথাকথিত উদারনীতির কথা বলে দরিদ্র মানুষজনকে আধুনিক দাসত্বের শৃঙ্খলে বেঁধে ফেলছে। বাংলাদেশে ২০২০ সালে যেসব মানব পাচারের ঘটনা শনাক্ত করা গেছে তার বেশিরভাগই ঘটেছে ঢাকা, খুলনা এবং সিলেট বিভাগীয় অঞ্চলে। জাতিসংঘের মানবপাচার বিষয়ক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে আসে।

 

জাতিসংঘের অভিবাসন বিষয়ক সংস্থা আইওএম এবং জাতিসংঘের মাদক ও অপরাধ বিষয়ক দপ্তর যৌথভাবে ‘ট্রাফিকিং ইন পার্সনস ইন বাংলাদেশ’ নামে এই প্রতিবেদনটি তৈরি করে। জেলা হিসেবে বাংলাদেশের সাতটি জেলায় সবচেয়ে বেশি মানব পাচারের ঘটনা শনাক্ত করা হয়েছে। এসব জেলা হচ্ছে মানিকগঞ্জ, ফরিদপুর, নড়াইল, ঝিনাইদহ, শরীয়তপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া এবং হবিগঞ্জ।

 

এসব জেলা থেকে প্রতি লাখে দেড়জনের বেশি মানুষ পাচারের শিকার হয়। জাতিসংঘের প্রতিবেদনে বলা হয় বাংলাদেশের সব এলাকার বাসিন্দাই মানব পাচারের শিকার হয়। তবে ঢাকা, খুলনা এবং সিলেটÑ এই তিনটি অঞ্চলের মানুষ বেশি পাচার হওয়ার কিছু কারণ রয়েছে। যেসব এলাকার সঙ্গে ভারতের সীমান্ত বেশি সেসব এলাকায় মানব পাচারের ঘটনা বেশি ঘটে।

 

উদাহরণ হিসেবে বলা হয় খুলনা বিভাগের কথা। এই বিভাগের পশ্চিমাঞ্চলে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের সাথে দীর্ঘ স্থলসীমান্ত রয়েছে এবং সেখান থেকে কলকাতাও দূরে নয়। যার কারণে ২০২০ সালে এই এলাকায় সবচেয়ে বেশি মানব পাচারের ঘটনা ঘটেছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।

 

এ বিষয়ে অভিবাসন নিয়ে গবেষণার কাজ করা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান রামরুর পরিচালক মেরিনা সুলতানা দৈনিক ভোরের আকাশের এই প্রতিবেদককে বলেন, যেকোনো সীমান্ত এলাকা যেখানে পারাপারটা তুলনামূলক সহজ, সেখানে অনিয়মিত অভিবাসনের সঙ্গে সঙ্গে মানব পাচারের বিষয়টিও ঘটে। বাংলাদেশের কিছু এলাকা মানব পাচারের হাব বা পকেট হিসেবে কাজ করে।

 

এসব এলাকায় মানব পাচারকারী চক্র বেশ সক্রিয় থাকে এবং তারা সেখানকার বাসিন্দাদের নানা ধরনের প্রলোভন দেখিয়ে মানব পাচার করে থাকে এসব এলাকায় সবচেয়ে বেশি মানব পাচারের শিকার হন নারীরা।

 

ভোরের আকাশ/নি