বঞ্চনাময় জীবনে একটু সুখ স্বাচ্ছন্দ্যের আশা যেন ছিল বিলাসিতা। স্বামীর সামান্য আয়, খাওয়ার খোঁটা আর নির্যাতন ছিল নিত্যসঙ্গী। তাই তো অভাবের গরাদ ভেঙে বেরিয়ে আসতে মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন তারা। নিজেদের শ্রমে, ঘামে নিজেদের নতুন পরিচয় তৈরি করলেন। আর এর পেছনে রয়েছে ময়মনসিংহ নগরীর কৃষ্টপুর এলাকার দুই কলোনি ঘিরে একটি বাজার গড়ে ওঠার গল্প। শুধু নারীদের কর্মসংস্থানের জন্য ‘বউ বাজার’ নামে এই বাজারটি গড়ে না উঠলে ঘরবন্দি জীবনযাপনই করতে হতো অনেক নারীকে। দরিদ্র স্বামীর রোজগারে দুঃখ-কষ্টে অতিবাহিত হতো জীবন। সন্তানদের শিক্ষিত করার স্বপ্ন থেকে যেত অধরা।
সরেজমিনে বাজারটিতে গিয়ে দেখা যায়, এখানে প্রায় ১০০টির মতো দোকান রয়েছে। এর মধ্যে কাঁচা তরিতরকারি, ছোট-বড় সব ধরনের মাছ, মাংস, শুঁটকি ও মুদির দোকান আছে। এসব দোকানে নারীরা বেচাকেনা করেছেন। তবে কয়েকজন পুরুষ বিক্রেতাও রয়েছেন।
স্থানীয়রা জানান, সংসারের ঘানি টানতে টানতে নাকাল কয়েকজন নারী ৩০ বছর আগে নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা করে শুধু নারীদের জন্য একটি বাজার প্রতিষ্ঠা করার পরিকল্পনা করেন। যেখানে নারীরাই থাকবেন ক্রেতা-বিক্রেতা। সে অনুযায়ী ‘বউ বাজার’ নাম দিয়ে বাজারে তরিতরকারি বিক্রি শুরু করেন। সেই বাজারই চলে আসছে এখন পর্যন্ত।
এই বাজারে মুরগি বিক্রি করেন রাশিদা বেগম। তিনি জানালেন, ১০ বছর আগে স্বামী মারা যাওয়ার পর তিনবেলার খাবার ও সন্তানদের পড়াশোনা করাতে গিয়ে চোখে অন্ধকার দেখতে শুরু করেন। সে সময় বউ বাজারে অন্য নারীদের ব্যবসা করতে দেখে উৎসাহ পান। শুরু করেন মুরগির ব্যবসা। ধীরে ধীরে পরিবারে সচ্ছলতা আসে। ছেলেমেয়েদের লেখাপড়াও করিয়েছেন এই উপার্জনের টাকায়।
সবজি বিক্রেতা রত্না বেগম বলেন, ‘ঘরে অভাব-অনটন সব সময় লেগেই থাকত। ঠিকমতো তিনবেলা খাবার খাওয়া হতো কদাচিৎই। এই বাজারে তরিতরকারি বিক্রি করে সংসারের হাল ধরেছি। প্রতিদিন ২ হাজার ৫০০ টাকা থেকে ৩ হাজার টাকার তরিতরকারি বিক্রি করি। এতে লাভ হয় ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা। আমার আয় করা এই টাকা সংসারে খরচ করছি। এতে স্বামীও খুশি।’
অজুফা আক্তার জানালেন, ময়মনসিংহ নগরীর মেছুয়া বাজার ও শম্ভুগঞ্জ বাজার থেকে পাইকারি দরে মাছ কিনে এনে বউ বাজারে বিক্রি করেন। এ কাজে তার স্বামীও তাকে সাহায্য করেন। প্রতিদিন ২০ থেকে ২২ হাজার টাকার মাছ বিক্রি করতে পারেন। এতে প্রতিদিন ১০০০ থেকে ১২০০ টাকা পর্যন্ত লাভ হয়। অন্যান্য বাজারের তুলনায় এখানে দাম তুলনামূলক কম। তাই ক্রেতার সংখ্যা বেশি।
নারগিস আক্তার নামে একজন ক্রেতা বলেন, ‘এই বাজারে অল্প আয়ের ক্রেতা বেশি। আমিও এই বাজার থেকেই নিয়মিত সব ধরনের খাদ্যপণ্য কিনে নিই। ন্যায্য দামে সবাই কিনতে পেরে খুশি।’
মনোয়ারা বেগম নামে আরেকজন বলেন, আগে শুধু নারীরা বিক্রি করলেও বর্তমানে কয়েকজন পুরুষ বিক্রেতাও দোকান দিয়েছেন। এতে করে নারী ক্রেতার সংখ্যা কমে যাওয়ার পাশাপাশি ‘বউ বাজার’ নামটিই এক দিন মুছে যাবে। এখানে পুরুষদের বেচাকেনা নিষিদ্ধ করা হোক। পাশাপাশি বাজারটি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখাসহ উন্নয়ন করা প্রয়োজন।
ময়মনসিংহ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সিনিয়র সহসভাপতি শংকর সাহা বলেন, নিজের প্রচেষ্টায় স্বাবলম্বী হয়েছেন এখানকার নারীরা। অভাব দূর করে সন্তানদের পড়াশোনা করাচ্ছেন। এই নারীদের দেখে অন্য নারীরাও যেকোনো ব্যবসায় উৎসাহ পাবেন।
এ বিষয়ে ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশনের মেয়র মো. ইকরামুল হক টিটু বলেন, সিটি করপোরেশনের অনেক জায়গায় উন্নয়ন কর্মকাণ্ড চলমান। এই বউ বাজার ছাড়াও বিভিন্ন বাজারে উন্নয়নের পরিকল্পনা রয়েছে।
ভোরের আকাশ/মি