বাহারি নকশা আর সূক্ষ কারুকাজে বাঁশ ও বেতের পণ্য তৈরি করেই জীবিকা নির্বাহ করছেন নেত্রকোনা সদর উপজেলার বাজে আমলি গ্রামের হিন্দু সম্প্রদায়ের অন্তত ৭০টি পরিবার। এক সময় এ গ্রামের বাঁশ-বেত তৈরির কাজ ছিল খুই জমজমাট। এ কাজে জড়িত ছিলেন আরো বেশি মানুষ। কিন্তু আর্থিক সংকট, কাঁচামালের অপ্রতুলতা ও পৃষ্টপোষকতার অভাবে দিন দিন হারিয়ে যেতে বসেছে তাদের পূর্বপুরুষদের আমলের ঐতিহ্যবাহী এ পেশা। এ কাজে জড়িত শিল্পীদের এখন দুর্দিন চলছে।
গ্রামের ছেলে-বুড়ো থেকে শুরু করে কিশোরী-গৃহিণীরা সবাই ব্যস্ত থাকতো বাঁশ ও বেতের তৈরি বিভিন্ন সাংসারিক সরঞ্জাম ও তৈজসপত্র তৈরিতে। বাড়ির উঠান, পুকুরের ধার, বাড়ি লাগোয়া রাস্তা সবখানেই বাঁশ ও বেত নিয়ে কারিকুরি চলত সবার। অবস্থা এমনই যে, বাঁশ-বেত পণ্যের গ্রাম বলে অনায়াসের পরিচয় গড়ে তোলা যায় নেত্রকোনা সদর উপজেলার এ বাজে আমলি গ্রামকে।
কিন্তু কালের আবর্তে, আর্থিক সংকট, কাঁচামালের দুষ্প্রাপ্যতা আর প্রযুক্তির উৎকর্ষে কিছুটা থেমে গেছে এ শিল্পের গতি। কমে গেছে এ পেশায় থাকা মানুষের আয়-রোজগার, কমেছে তাদের সংখ্যাও। কিন্তু রীতিমতো এখনো সমান খ্যাতি-যশ রয়েছে বাঁশ-বেত পণ্যের বাজে আমলি গ্রামের হাতে তৈরি জিনিসের। তাই প্রতিবন্ধকতা এড়িয়ে এখনো তৈরি করছেন বাঁশের তৈরি কুলা, ঝুড়ি, খাঁচা, খুচি, সোফা, বিয়ের কুঞ্জসহ নানা তৈজসপত্র।
এদিকে তাদের মধ্যে সম্প্রতি ৪টি পরিবারকে সরকারিভাবে সমাজসেবা কার্যালয় থেকে আর্থিক অনুদান দেয়ায় নতুন করে পুরোনো সুদিন ফিরিয়ে আনার স্বপ্ন দেখছেন তারা। বংশ পরম্পরায় অর্জিত এ পেশা রক্ষায় সরকারি সহযোগিতার প্রত্যাশা করছেন এ শিল্পের সঙ্গে জড়িত গ্রামের প্রত্যেকেই। বাঁশ-বেতের কাজ করে দিনাতিপাত করা গ্রামটির কমল, সুরবালাসহ আরো কয়েকজনের সঙ্গে কথা বললে তারা জানান, বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতা এড়িয়ে বাপ-দাদার পুরাতন এ পেশাকে আগলে রেখেই তারা জীবিকা নির্বাহ করছেন।
অন্য কোনো কাজ তারা শিখেননি। ছোটবেলা থেকে এ কাজ করতে দেখছেন তাদের আদি পুরুষদের। তাই এ কাজই শিখেছেন তারা। ইচ্ছে করলেই অন্য কোনো পেশায় জড়িয়ে যেতে পারছেন না। তবে এখন এ কাজ করে সংসার চালানো কষ্টকর হয়ে পরেছে। এ কাজ করে যা আয় হয় আর বাজারের যা অবস্থা তাতে সংসার খরচ, ছেলে মেয়েদের লেখাপড়া, চিকিৎসা ইত্যাদি খরচ মিলিয়ে চলা দায় হয়ে পড়েছে।
বর্তমান বাজার অনুযায়ী কাঁচামালের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় তা সংগ্রহ করতে গিয়ে অনেক কারু শিল্পীই ঋণগ্রস্ত হয়ে এলাকা ছেড়েছেন। ঝুকে পড়ছেন অন্য পেশায়। কাঁচামালের দুষ্প্রাপ্যতা ও আর্থিক সংকট প্রকট হওয়ায় এ সকল সমস্যা এড়াতে সরকারি সহযোগিতার বিকল্প নেই। এদিকে কিছুদিন আগে গ্রামের চারজন সমাজসেবা অধিদপ্তর থেকে আর্থিক সহায়তার আওতায় এসেছেন।
তাদের মধ্যে অঞ্জলী রানী, রানী দেবী ও বিভা রানী জানান, ১৮ হাজার টাকা করে সমাজসেবা কার্যালয় থেকে অনুদান পাওয়ার পর তাদের কাঁচামাল সংগ্রহ করতে আর কোনো সমস্যা হচ্ছে না। তাই ব্যবসায় লাভও হচ্ছে মোটামোটি ভালোই। তারা সুখে শান্তিতে বসবাসও করছেন স্বামী সন্তান নিয়ে। এমতাবস্থায় প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী এ শিল্পকে রক্ষা করতে যত শীঘ্রই সরকারি উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে, ঘুচবে আর্থিক অনটন, রক্ষা পাবে বাপ-দাদার আমলের এ পেশা এমনটাই প্রত্যাশা বাজে আমলি গ্রামের বাসিন্দাদের।
নেত্রকোনা ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের (বিসিক) উপব্যবস্থাপক মো. আক্রাম হোসেন বলেন, এ শিল্পে নিয়োজিতদের নিয়ে ডাটাবেইজ তৈরির কাজ চলছে। খুব দ্রুতই তা সম্পন্ন হবে। পরে আগ্রহীদের মধ্যে স্বল্পসুদে ঋণ কার্যক্রম চালু করার ব্যবস্থা করা হবে।
ভোরের আকাশ/নি