logo
আপডেট : ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ ১০:৪৬
পাট চাষে আগ্রহ হারাচ্ছেন প্রান্তিক চাষিরা
এনামুল হক রাঙ্গা, বগুড়া

পাট চাষে আগ্রহ হারাচ্ছেন প্রান্তিক চাষিরা

ট্রাকে পাট তুলছেন চাষিরা। ছবিটি সম্প্রতি বগুড়ার সারিয়াকান্দি থেকে তোলা

পাটকে দেশের সোনালি আঁশ বলা হয়। এক সময় দেশে পাটের ব্যাপক চাষাবাদ করত প্রান্তিক কৃষকরা। সময়ের ব্যবধানে সেই পাট চাষ আগের মতো এখন আর তেমন চোখে পড়ে না। তথাপিও বর্তমান সরকার পাটের ওপর বরাবরই গুরুত্ব দিয়ে আসছে। গত কয়েক বছরের ব্যবধানে পাট চাষে উত্তরের জেলাসহ বগুড়ায় মাঠের চিত্র ভিন্ন দেখা গেছে।

 

উপযুক্ত দামের অভাবে কৃষকের কাছে আগ্রহ হারাচ্ছে পাটের আবাদ। গেল বছরের চেয়ে এবার মণপ্রতি পাটের দাম কমেছে অন্তত ৬০০ টাকা। বিপরীতে পাটের আবাদে খরচ বেড়েছে কৃষকের। আবার রপ্তানি না থাকায় পাইকারি ব্যবসায়ীরাও পাট ক্রয় করে পড়ছেন লোকসান ঝুঁকিতে। এমন পরিস্থিতিতে আগামিতে পাটের আবাদ ছেড়ে দেয়ার কথা ভাবছেন কৃষকরা।

 

বগুড়া কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যেও দেখা যায়, জেলায় পাট চাষের পরিমাণ কমেছে। এবার উৎপাদন বেশি হলেও গত দু’বছর ধরে লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হয়নি এ অর্থকরী ফসলে। তবে জেলার কৃষি কর্মকর্তারা সোনালি আঁশ উৎপাদনে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করতে নিয়মিত প্রণোদনা দিয়ে যাচ্ছেন।

 

জেলা কৃষি বিভাগ সূত্র জানায়, চলতি অর্থবছরে বগুড়ায় পাট চাষে জমির লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১২ হাজার ৬৩৪ হেক্টর। বিপরীতে অর্জন হয় ১০ হাজার ৬৯০ হেক্টর। উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৩০ হাজার ৫১৭ টন। জমি থেকে ফসলটি কাটা এখনও চলমান। তবে অর্জিত জমিতে উৎপাদনের হার পাওয়া যাচ্ছে ২ দশমিক ৮২ টন করে। এ হিসাবে মোট উৎপাদন হতে পারে প্রায় ৩০ হাজার ১৪৬ টন। গত অর্থবছরে পাটের আবাদে লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হয়নি। ১৩ হাজার ৫০ হেক্টর জমির বিপরীতে অর্জন হয়েছিল ১১ হাজার ১৬৭ হেক্টর। আর উৎপাদন পাওয়া যায় ৩০ হাজার ৬৭৬ টন।

 

এসব গেল পরিসংখ্যানের কথা। মাঠ পর্যায়ে কৃষকও বলছে পাটের উৎপাদন বৃদ্ধির কথা। বন্যা না থাকায় এবার ফলনে সমস্যা হয়নি। কিন্তু জমি থেকে ফসল কাটার পর হাট-বাজারে পাটের দাম দেখে হতাশ চাষিরা। গত সপ্তাহ পর্যন্ত প্রতি মণ পাট বিক্রয় হয়েছে ১৮০০ থেকে ২ হাজার টাকায়। তবে দু তিন দিন ধরে এ দাম একটু বেড়েছে। বগুড়ার সারিয়াকান্দির মথুরাপাড়া হাটে গিয়ে দেখা যায় প্রতি মণ পাট কৃষকরা বিক্রি করছেন ২২০০ থেকে ২৪০০ টাকায়।

 

বগুড়ার সবচেয়ে বেশি পাট চাষ হয় এ উপজেলায়, এবারের পরিমাণ ৫ হাজার ৭১৫ হেক্টর। এ জন্য এখানে আশেপাশের অনেক পাইকারী ব্যবসায়ীরা আসেন পাট ক্রয় করতে। তবে এসব দামে কৃষক সন্তুষ্ট নন। তাদের দাবি, ২ হাজার বা ২৪০০ টাকায় পাট বিক্রয় করে তাদের খরচ পোষাচ্ছে না। পাট চাষে অন্য খরচ তেমন না থাকলেও কৃষি মজুরের খরচ বেশি।

 

সারিয়াকান্দি উপজেলার বয়ড়াকান্দি গ্রামের ফজলুল হক বলেন, আমার ১০০ শতক জমিতে সব মিলিয়ে খরচ হয়েছে প্রায় ৩৫ হাজার টাকা। এখন দাম যাচ্ছে ১৮০০ থেকে ২ হাজার টাকা মণ। এই দামে খরচ উঠবে না। এ রকম থাকলে আগামীতে এই ফসল আর করা যাবে না। উপজেলার মথুরা পাড়া গ্রামের আবুল প্রামাণিক তিন বিঘা জমিতে পাট করেছেন। এর মধ্যে দুই বিঘা জমির পাট কেটে শুকাচ্ছেন।

 

মথুরাপাড়া হাটে নয় মণ পাট নিয়ে এসেছেন সারিয়াকান্দির মাঝিড়া চরের বাসিন্দা মোবারক আলী। এর মধ্যে ছয় মণ পাট ২৪০০ টাকায় বিক্রি করেছেন। দাম কম বলায় বাকি তিন মণ পাট দিচ্ছেন না। এই কৃষক বলেন, ‘এবার পাট ভালোই হছলো, কিন্তু কামলার মনায় (শ্রমিক খাত), নামানি, ধোয়াতেই ঘর থেকে ভর্তুকি গেছে।’

 

পাইকারি ব্যবসায়ী সোহাগ বাবু বলেন, আজকের বাজারে পাটের দাম একটু বেশি। ২৩০০ থেকে ২৪০০ টাকায় পাট ক্রয় করছি। সরকার গত বছর পাট নেয়নি। গত বছর পাটের দাম ৩২০০ থেকে ৩৩০০ টাকা ছিল। অনেকে কিনে রাখছিল, কিন্তু বেচতে পারেনি। এ জন্য এবার দাম ২২০০-২৩০০ টাকা হয়।

 

মথুরাপাড়া হাটের আরেক পাইকারি ব্যবসায়ী মো. হায়দার আলী জানান, বিগত চার থেকে পাঁচ বছর সরাসরি পাট রপ্তানি বন্ধ আছে। এই পাইকার বলেন, বিগত দুই তিন বছরের মধ্যে এবার পাটের মান ভালো। তবে পাটে যেমন খরচ হয় সেটা বিক্রয়ের দামে ওঠে না।

 

রপ্তানির প্রসঙ্গে উপপরিচালক মতলুবর রহমান বলেন, আমাদের দেশে বেসরকারি পর্যায়ে বেশ কিছু পাটের কল আছে, যারা কিনা পাটজাত দ্রব্য যেমন বস্তা তৈরি করে রপ্তানি করছে। যদি এই পাট রপ্তানিটা সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে আরও বাড়ানো যায় তাহলে আমাদের কৃষকরা যথেষ্ট ভালো দাম পাবে। এই যে একটা ভালো ফসল যা কিনা মাটির উর্বরতা বাড়ায় সেই ফসল চাষে কৃষকরা আরও উদ্বুদ্ধ হবে।

 

পাট রপ্তানির বিষয়ে কথা হয় বগুড়া চেম্বার অব কমার্সের সহ সভাপতি মাহফুজুল ইসলাম রাজ। তিনি বলেন, বগুড়ায় যেসব মিল-কারখানা আছে তারা পাটের ফিনিশড গুড (পাটজাত দ্রব্য) ইন্ডিয়াতে রপ্তানি করে থাকে। ইন্ডিয়াতে পাটের বিশাল মার্কেট রয়েছে। এ ছাড়া মধ্যপ্রাচ্য ও অনেক দেশেই আমাদের পাটের ফিনিশড পন্য যায়। কৃষকদের প্রণোদনার হার আরও বাড়িয়ে দেয়া হলে আগামিতে আরও বৈদেশিক মুদ্রা আসবে।

 

ভোরের আকাশ/নি