নিখিল মানখিন: শুরু হয়েছে জাতীয় নির্বাচনকেন্দ্রিক খেলার শেষ পর্ব। ডিসেম্বরে ফাইনাল খেলা হবে বলে জানিয়ে রেখেছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। কিন্তু অক্টোবরেই ফাইনাল খেলা দেখাতে চায় বিএনপি। ফাইনাল খেলাকে কেন্দ্র করে আবার শুরু হয়েছে পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি। ১৯ সেপ্টেম্বর থেকে ৩ অক্টোবর পর্যন্ত টানা ১৫ দিনের কর্মসূচি ঘোষণা দিয়েছে বিএনপি।
পাল্টা কর্মসূচি দিতে দেরি করেনি আওয়ামী লীগ। বিএনপির ঘোষণার একদিন পরই গতকাল মঙ্গলবার টানা ১২ দিনের কর্মসূচি ঘোষণা দিয়েছেন তারা। দেশের প্রধান দু’টি রাজনৈতিক দলের মারমুখী অবস্থানে সংঘাতের শঙ্কা আরো ঘনীভূত হচ্ছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, দেশের প্রধান দু’টি রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির বিদেশি ক‚টনৈতিক তৎপরতা অব্যাহত রয়েছে। এক মাস আগেও বিদেশি কূটনীতির প্রবল চাপে পড়েছিল আওয়ামী লীগ। সেই সময় বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিদের বিবৃতির ভাষা ও আচরণ অনেকটা বিএনপির দাবিসমূহের সঙ্গে মিলে গিয়েছিল। তখন স্বস্তিতে ছিল বিএনপি। বর্তমানে কূটনৈতিক তৎপরতায় এগিয়ে গেছে আওয়ামী লীগ। হতাশা নেমে এসেছে বিএনপি শিবিরে। এবার দেশের অভ্যন্তরে ফাইনাল খেলা খেলতে চায় তারা।
এক দফা আন্দোলন বাস্তবায়নের মাধ্যমে তারা আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারকে পদত্যাগে বাধ্য করাতে চায়। এ লক্ষ্যে তারা ইতোমধ্যে টানা ১৫ দিনের কর্মসূচি শুরু করেছে। বসে নেই আওয়ামী লীগও। বিদেশি কূটনৈতিক তৎপরতার পাশাপাশি তারা রাজনৈতিক মাঠ দখলে রাখতে চায়। বিএনপিকে মাঠে মোকাবিলা করতে তারা মঙ্গলবার পাল্টা টানা ১২ দিনের কর্মসূচি দিয়েছে।
আওয়ামী লীগের টানা ১২ দিনের কর্মসূচি: বিএনপির টানা ১৫ দিনের কর্মসূচি ঘোষণার একদিন পরই টানা ১২ দিনের কর্মসূচি দিয়েছে আওয়ামী লীগ। দলীয় নেতা-কর্মীদের সজাগ থেকে এই কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করতে বলা হয়েছে।
মঙ্গলবার দুপুরে রাজধানীর ধানমন্ডিতে আওয়ামী লীগ সভাপতির রাজনৈতিক কার্যালয়ে এক সভা শেষে এই কর্মসূচির কথা জানানো হয়। এদিন ধানমন্ডিতে দলীয় সভাপতির রাজনৈতিক কার্যালয়ে আওয়ামী লীগের সম্পাদকমন্ডলীর সঙ্গে ঢাকা মহানগর উত্তর-দক্ষিণ আওয়ামী লীগসহ সহযোগী সংগঠনের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকদের যৌথসভা হয়। সভা শেষে সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ।
সভায় আওয়ামী লীগ নেতারা বলেন, বিএনপির পাল্টাপাল্টি নয় নির্বাচন পর্যন্ত ধারাবাহিক কর্মসূচি পালন করবে আওয়ামী লীগ। তারই অংশ হিসেবে ঢাকা ও ঢাকার বাইরে নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়েছে। এই কর্মসূচি চলবে আগামী ২৩ সেপ্টেম্বর থেকে ৪ অক্টোবর পর্যন্ত।
আওয়ামী লীগ নেতারা বলেন, আগামী জাতীয় নির্বাচনে বিএনপির জয়ের কোনো সম্ভাবনা নেই দেখে নানা ধরনের ষড়যন্ত্র করছে তারা। যেকোনো রাজনৈতিক দল তাদের কর্মসূচি পালন করতে পারে। তারই ধারাবাহিকতায় তৃণমূল বিএনপি তাদের কাউন্সিল করছে বলেও জানান আওয়াম লীগ নেতারা।
গত ১০ সেপ্টেম্বর রাজধানীর একটি অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, বিএনপির আন্দোলনে জনগণ নেই। তাদের আন্দোলনের বাজার ভেঙে যাচ্ছে। বিএনপির আন্দোলনে শুধু আছে তাদের নেতা-কর্মী। তাদের আন্দোলনের বাজার ভেঙে যাচ্ছে। নেতিবাচক রাজনীতির কারণে জনগণ তাদের প্রত্যাখ্যান করেছে।
আওয়ামী লীগ জনগণের সঙ্গে আছে উল্লেখ করে ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘আমাদের নেত্রী শেখ হাসিনা, কিন্তু ওদের (বিএনপি) নেতা নেই। আজকে লাফালাফি বন্ধ হয়ে গেছে। অনেক করেছেন দিন যায়, মাস যায়, দেখতে দেখতে ১৫ বছর, আন্দোলন হবে কোন বছর? বিএনপি মানুষের মনে আস্থা রাখতে পারছে না। তাদের আন্দোলনের ধরন অনুযায়ী আওয়ামী লীগ পরবর্তী পদক্ষেপ নেবে। বিএনপির আন্দোলন মোকাবিলায় দলের নেতাকর্মীরা সব সময় প্রস্তুত আছেন। জানমালের নিরাপত্তা বিধান এবং আন্দোলনের নামে দেশে অরাজকতা সৃষ্টিকারীদের দমনে রাষ্ট্র প্রয়োজনীয় সব ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করবে বলে জানান ওবায়দুল কাদের।
টানা আন্দোলনে বিএনপি: বর্তমান সরকারের পদত্যাগ, সংসদ বিলুপ্তি এবং নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের এক দফা দাবিতে চলমান যুগপৎ আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় এবার নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করেছে বিএনপি। টানা ১৫ দিনব্যাপী এ কর্মসূচি আগামীকাল ১৯ সেপ্টেম্বর শুরু হয়ে চলবে ৩ অক্টোবর পর্যন্ত। কর্মসূচির মধ্যে রোডমার্চ এবং সমাবেশ রয়েছে।
সোমবার বিকেলে গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান এ কর্মসূচি ঘোষণা করেন। এটি সরকার পতনের এক দফার আন্দোলনের বিএনপির সপ্তম কর্মসূচি ঘোষণা।
গত রোববার বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সাংবাদিকদের বলেছেন, মানুষ জেগে উঠেছে, রাজপথে নেমেছে। রাজপথে এই সরকারকে পতন ঘটিয়ে ঘরে ফিরব। আওয়ামী লীগ আবারও নির্বাচন নিয়ে পাতানো খেলা খেলতে চায়। আমরা নির্বাচন নিয়ে পাতানো খেলা খেলতে দেবো না বলে জানান মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, অক্টোবরের মধ্যেই বিএনপি তাদের আন্দোলনকে চূড়ান্ত পরিণতির দিকে নেয়ার কথা বলছে। কারণ, নভেম্বরের ১ তারিখ থেকে জাতীয় নির্বাচনের ক্ষণগণনা শুরু হবে। ভোট করতে হবে আগামী বছরের ২৯ জানুয়ারির মধ্যে। নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হতে পারে, এমন আভাস পাওয়া যাচ্ছে নির্বাচন কমিশন থেকে। বিএনপি নেতারা মনে করছেন, তফসিল ঘোষণা হয়ে গেলে নির্বাচন ঠেকানো কঠিন হবে। তাই জাতীয় নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগেই সরকারের পদত্যাগের এক দফা দাবিতে আন্দোলনের পরিণতি দেখতে চায় বিএনপি।
এমন চিন্তা থেকে যুগপৎ আন্দোলনকে অক্টোবরের মধ্যেই চূড়ান্ত ধাপে নিতে কৌশল ঠিক করছে দলটি। বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব থেকে এমন বার্তা দেয়া হয়েছে সারা দেশে দলের নেতা-কর্মীদের। সরকার এবার বিনা চ্যালেঞ্জে একতরফা নির্বাচনের দিকে যাতে এগোতে না পারে, সে ধরনের পরিস্থিতি তৈরি করা সম্ভব হবে বলে বিএনপির নেতা-কর্মীদের বড় অংশ মনে করছে। তবে মাঠের আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকারকে কতটা টলানো যাবে, সেই সন্দেহও রয়েছে বিএনপির ভেতরে। কারণ, ঢাকায় বড় জমায়েতের মহাসমাবেশ করার পরদিনই গত ২৯ জুলাই রাজধানীর প্রবেশমুখে অবস্থান কর্মসূচিতে বিএনপির নেতা-কর্মীদের জমায়েত সেভাবে ছিল না।
দলটির নগণ্যসংখ্যক নেতা-কর্মী সেদিন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও পুলিশের মারমুখী অবস্থানের মুখে মাঠে থাকতে পারেননি। সেই পরিস্থিতি ছিল তাঁদের জন্য একটা বড় ধাক্কা। একধরনের হতাশাও তৈরি হয়েছিল এবং একটা ছন্দপতন হয়েছিল এক দফার আন্দোলনে। যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোর ওপর দলটির নেতৃত্বের একধরনের নির্ভরশীলতার বিষয়ও অনেক ক্ষেত্রে প্রকাশ পাচ্ছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, ঢাকার বাইরে বিএনপির কর্মসূচি নিয়ে খুব বেশি চিন্তিত নয় ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। দলটির নীতিনির্ধারকদের মূল চিন্তা ঢাকা নিয়ে।
রাজধানী ঢাকায় বিএনপি কর্মসূচি ঘোষণা করলে পাল্টা কর্মসূচি নিয়ে রাজপথে থাকবে আওয়ামী লীগ। বিশেষ করে ঢাকা যাতে অচল করার মতো কোনো কর্মসূচিতে বিএনপি যেতে না পারে, সেটাই নিশ্চিত করতে চায় সরকার ও আওয়ামী লীগ।
আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকরা মনে করেন, বিএনপি ও সমমনা বিরোধী দলগুলোর পক্ষ থেকে যে কর্মসূচিই নেয়া হোক না কেন, তাদের মূল লক্ষ্য ঢাকা। রাজধানীকে সারা দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করা, অচল করে দেয়া এবং শেষে লাগাতার অবস্থানের মাধ্যমে সরকারের পতন নিশ্চিত করা বিরোধীদের লক্ষ্য। ফলে আওয়ামী লীগ ঢাকা ও এর আশেপাশে শক্ত অবস্থান ধরে রাখার পক্ষে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকেও সেভাবেই প্রস্তুতি রাখার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। ঢাকার বাইরের কর্মসূচিতে কোনো সমস্যা হলে তা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সহজেই সমাধান করতে পারবে বলে মনে করেন আওয়ামী লীগের নেতারা।
আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী সূত্র বলছে, নির্বাচন সামনে রেখে আওয়ামী লীগ নিজে থেকে পরিস্থিতি উত্তপ্ত করতে চায় না। একটা অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন আয়োজনের বিষয়ে আওয়ামী লীগের ওপর দেশি-বিদেশি চাপ রয়েছে। এ পরিস্থিতিতে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ যতটা সম্ভব সংযত আচরণ করার কৌশল নিয়েছে। কারণ, বিএনপি এখন পর্যন্ত যেসব কর্মসূচি নিয়েছে, এর কোনোটাই সরকারের পতন ঘটিয়ে ফেলার মতো নয়।
এ ছাড়া এখন পর্যন্ত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সরকারের পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আছে। এমন পরিস্থিতিতে বিএনপি আন্দোলন করে সরকার ফেলে দেবে এমন আশঙ্কা খুব একটা দেখছেন না আওয়ামী লীগের নেতারা। তারা মনে করেন, বড়জোর বিএনপি সরকারের ওপর চাপ তৈরি করতে পারবে। আর সেটা রাজনৈতিকভাবে এবং সরকারের বিভিন্ন সংস্থার মাধ্যমে ভালোভাবে মোকাবিলা করার সামর্থ্যও আছে।
আওয়ামী লীগের নেতারা বলছেন, পুনরায় সংগঠিত হয়ে ঢাকায় চূড়ান্ত পর্যায়ের চেষ্টা চালাবে বিএনপি। এ জন্য বিএনপির এখনকার কর্মসূচিগুলো নিয়ে আওয়ামী লীগ এতটা চিন্তিত নয়। তবে বিএনপি যে ঢাকায় টানা কর্মসূচি নিতে পারে, সে বিষয়টি বিবেচনায় রেখে আওয়ামী লীগও পাল্টা কর্মসূচি নেয়ার পরিকল্পনা করেছে।
আওয়ামী লীগের দলীয় সূত্র বলছে, সাম্প্রতিক সময়ে বিএনপির সব কর্মসূচির পাল্টা কর্মসূচি না নেয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত আছে। তবে ঢাকায় বিএনপির কর্মসূচি থাকলে এর পাল্টা কর্মসূচি নেয়ার বিষয়ে নির্দেশনা আছে। এর বাইরে করণীয় নিয়ে তেমন কোনো নির্দেশনা নেই। তবে দলীয় প্রধান শেখ হাসিনা ও সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করা হবে। পরিস্থিতি বুঝে নতুন কর্মসূচি প্রয়োজন হলে নেয়া হবে।
ভোরের আকাশ/নি