logo
আপডেট : ২০ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ ১০:৩৪
নিত্যপণ্যের বেঁধে দেয়া দাম যেন কাজির গরু
মুস্তাফিজুর রহমান নাহিদ

নিত্যপণ্যের বেঁধে দেয়া দাম যেন কাজির গরু

মুস্তাফিজুর রহমান নাহিদ: লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে নিত্যপণ্যের দাম। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে একটার পর একটা পণ্যের দাম বাড়ছে। মাছ-মাংস-দুধ-ডিম-চাল-সবজি-আটা-চিনি-লবণ-তেল-ডাল সব কিছুর দামই যেন পাগলা ঘোড়ার মতো ছুটছে। কালেভদ্রে দু-একটি পণ্যের দাম কমলেও তা স্থির থাকছে না। আবারো বাড়তি হয়ে যাচ্ছে এসব পণ্যের দাম। এর বেশিরভাই হচ্ছে ব্যাবসায়ীদের কারসাজির কারণে। বিষয়টি সামনে আসায় সরকার কয়েকটি পণ্যের দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে। কিন্তু তা যেন কেবল কাজির গরুর মতো। যা কেতাবে আছে গোয়ালে নেই। বেঁধে দেয়া কোনো পণ্যেই নির্ধারিত দামে পাওয়া যাচ্ছে না।

 

সম্প্রতি সরকার খুচরা বাজারে ছয়টি পণ্যের দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে। সরকারের নির্দেশনা উপেক্ষা করে বাড়তি দামেই বিক্রি হচ্ছে আলু, ডিম ও পেঁয়াজ। নানা অজুহাত দেখিয়ে বাড়তি মূল্যে ব্যবসায়ীরা বিক্রি করছেন এসব পণ্য।

 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কিছু অতি মুনাফালোভী ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট করে বাজার নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছে। সরকারকে কঠোরভাবে এদের দমন করতে হবে। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে অভিযান চালিয়ে কিছু ব্যবসায়ীরা জরিমানা করা হলে পরে আবার আগের অবস্থায় চলে আসে। এমন পরিস্থিতিতে তিনটি পণ্য ডিম, আলু ও পেঁয়াজের দাম বেঁধে দেয় সরকার।

 

গত ১৪ সেপ্টেম্বর প্রথমবারের মতো পণ্য তিনটির দাম নির্ধারণ করে দেয়া হয়। কৃষি মন্ত্রণালয়ের সুপারিশের আলোকে আলুর সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য ৩৫-৩৬ টাকা, দেশি পেঁয়াজের সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য ৬৪-৬৫ টাকা আর ডিমের পিস সর্বোচ্চ ১২ টাকা নির্ধারণ করে দেয়া হয়। জরুরি এই তিন পণ্যের দাম নির্ধারণ করা হলেও বাজারে বাড়তি দামেই বিক্রি হচ্ছে এসব পণ্য।

 

রাজধানীর বেশ কয়েকটি বাজার ঘুরে দেখা যায়, খুচরা বাজারে আলু বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ৫০ টাকা, পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৭৫-৮৫ টাকা, ডিম প্রতি ডজন বিক্রি হচ্ছে ১৫০-১৫৫ টাকা। সরকারের ঘোষণার আগেও এই দামে বিক্রি হয়েছিল এসব পণ্য।

 

রাজধানীর বিভিন্ন বাজারের খুচরা ব্যবসায়ীরা বলছেন, সরকার দাম ঘোষণা করলেও পাইকারি বাজারে সেই দামে কিনতে পারছেন না তারা। ডিমের বাজারেও সরকারের নির্ধারণ করে দেয়া দামের প্রভাব নেই। বেঁধে দেয়া দামে ডিমের ডজন ১৪৪ টাকা বিক্রি করার কথা থাকলেও অধিকাংশ দোকানে তা বিক্রি হচ্ছে ১৫০ থেকে ১৫৫ টাকা দরে। একইভাবে ৭৫ টাকার নিচে নেই দেশি পেঁয়াজ। তবে সবচেয়ে ভালো মানের দেশি পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৯০ টাকা কেজি দরে। কিছু আমদানি করা পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৭০ টাকায়। খুচরা পেঁয়াজ বিক্রেতাদেরও একই কথা। আড়তে দাম কমেনি। তাই তারা নির্ধারিত দামে বিক্রি করতে পারছেন না।

 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অতি মুনাফালোভী কিছু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট করে বাজার নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছে।

 

প্রতিমন্ত্রী শামসুল আলম সম্প্রতি ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরামের (ইআরএফ) এক কর্মশালায় বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়া হলেও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আসছে না। এটা সরকারকে ভাবাচ্ছে। তিনি বলেন, নতুন ফসল উঠলে এবং সরবরাহ বাড়লে মূল্যস্ফীতি কমে আসবে।

 

দেশে নিত্যপণ্যের দাম বাড়ছে ২০২০ সালের মার্চে করোনা সংক্রমণ শুরুর পর থেকে। তখন আতঙ্কের কেনাকাটা বাজারে সরবরাহ-সংকট তৈরি করেছিল। এরপর সরবরাহ-সংকট, দেশীয় পরিস্থিতিসহ নানা কারণে দর বাড়তিই ছিল। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর সরবরাহ-সংকট, মার্কিন ডলারের দাম বেড়ে যাওয়া, দেশে জ্বালানি তেল, বিদ্যুৎ, গ্যাস ও সারের দাম বাড়ানোর কারণে উৎপাদন ও পরিবহন খরচ বেড়ে যায়। এতে লাফিয়ে লাফিয়ে পণ্যের দাম বেড়েছে। এসব কারণে দেশে মূল্যস্ফীতি উঠে গেছে ১০ শতাংশের কাছাকাছি। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) ১০ সেপ্টেম্বর জানায়, গত আগস্ট মাসে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল ১২ দশমিক ৫৪ শতাংশ, যা গত ১১ বছর ৭ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ।

 

বিবিএস উদ্বেগজনক মূল্যস্ফীতির হার প্রকাশের চার দিন পর বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, কৃষি মন্ত্রণালয় ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় বৈঠক করে তিন পণ্যের দাম নির্ধারণ করে দেয়।

 

দাম ঠিক করে দেয়া পণ্যের একটি আলু। বিগত কয়েক বছর আলু নিয়ে এমন পরিস্থিতি হয়নি। সাধারণত মৌসুমের শুরুতে আলু প্রতি কেজি ১৫ টাকা এবং শেষ দিকে নভেম্বর-ডিসেম্বরে ৩৫ থেকে ৪০ টাকায় বিক্রি হয়। এবার সেপ্টেম্বরেই আলুর কেজি ৫৫ টাকায় উঠে যায়। এমন অবস্থায় গত বৃহস্পতিবার প্রতি কেজি আলুর দাম ঠিক করে দেয়া হয় ৩৫ থেকে ৩৬ টাকা।

 

জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এ এইচ এম সফিকুজ্জামান গত শনিবার মুন্সিগঞ্জে হিমাগার পরিদর্শনে গিয়ে বলেছিলেন, হিমাগার থেকে রসিদের মাধ্যমে ২৬ থেকে ২৭ টাকা কেজি দরে আলু বিক্রি করতে হবে।

 

গতকাল সকালে দুটি হিমাগারে গিয়ে দেখা যায়, নির্ধারিত দরে আলু বিক্রি হচ্ছে না। রিভারভিউ কোল্ড স্টোরেজ নামের একটি হিমাগার থেকে মূল্য নির্ধারণ ছাড়াই আলু চট্টগ্রামের আড়তে পাঠানোর কাজ চলছিল। ঢাকার কারওয়ান বাজার, নতুন বাজার ও গুদারাঘাট বাজার ঘুরে দেখা যায়, আলু বিক্রি হচ্ছে ৪৫ থেকে ৫০ টাকা কেজি দরে। এ দর তিন দিন আগের তুলনায় কেজিতে প্রায় ৫ টাকা কম।

 

তবে নির্ধারিত দরের চেয়ে ১০ থেকে ১৪ টাকা বেশি। প্রতি হালি ডিমের দর নির্ধারণ করা হয়েছিল ৪৮ টাকা, যা বাজারদরের চেয়ে সামান্য কম। সেই দরও কার্যকর হয়নি। সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তালিকা বলছে, প্রতি হালি ডিম বিক্রি হচ্ছে ৫০ থেকে ৫২ টাকা দরে।

 

প্রশ্ন উঠেছে, তাহলে দাম নির্ধারণ করে লাভ কী? জানতে চাইলে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক সফিকুজ্জামান বলেন, ‘বাজারদর প্রত্যাশিত পর্যায়ে আনতে আমরা সারা দেশে অভিযান চালাচ্ছি। আমাদের যা যা করা দরকার, তা করব।’ ভোজ্যতেল ও চিনির দাম আগে নির্ধারণ করা হয়েছে, সেটা কেন কার্যকর হয়নি জানতে চাইলে তিনি বলেন, বিষয়টি নিয়ে তিনি এখন কথা বলতে চান না। নতুন পণ্যের ঘোষিত দর কার্যকর করতে চান।

 

বড় কোম্পানি, বাজার বিশ্লেষক, পাইকারি বিক্রেতা ও খুচরা ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে নির্ধারিত দর কার্যকর না হওয়ার চারটি কারণ জানা যায়. বড় কোম্পানি, উৎপাদক অথবা আমদানি পর্যায়ে দর কার্যকর করতে না পারা।

 

পাইকারি বাজার ও খুচরা পর্যায়ে সার্বক্ষণিক নজরদারি না থাকা। দেখা গেছে, যতক্ষণ বাজারে অভিযান চলে, ততক্ষণ দাম কম থাকে। চাহিদা ও জোগানের মধ্যে ভারসাম্য না থাকা। সরবরাহ-সংকট থাকলে কোনোভাবেই নির্ধারিত দর কার্যকর করা সম্ভব নয়। বেড়ে যাওয়ার পর দর নির্ধারণে লাভ হয় না। আলুর উদাহরণ এ ক্ষেত্রে সামনে এসেছে।

 

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, সরকারি হিসাব যা-ই হোক, হিমাগারে আলু মজুত কম হয়েছে, সেটা ব্যবসায়ীরা জানতেন। এ কারণে হিমাগারে আলু মজুতের ‘কাগজ’ কেনাবেচা হয়েছে। যারা বেশি দর দিয়ে আলু কিনেছেন, তারা কোনোভাবেই এখন লোকসান দিতে চাইবেন না। প্রয়োজনে আরও পরে আলু বিক্রি করবেন। সরকারের উচিত ছিল মজুত পরিস্থিতি ও আশেপাশের দেশের দাম বিবেচনা করে আগে থেকেই পদক্ষেপ নেয়া।

 

ডিম উৎপাদনকারী শীর্ষ প্রতিষ্ঠানের ডায়মন্ড এগ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কায়সার আহমেদ বলেন, বন্ধ খামার চালুর জন্য পদক্ষেপ নেয়া উচিত। দেশে উৎপাদন না থাকলে ধরপাকড় করে কাজ হবে না। পেঁয়াজ ব্যবসায়ীরা বলছেন, যখন আমদানির দরকার ছিল, তখন কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর আমদানির অনুমতি দেয়া বন্ধ রেখেছে। দাম অনেকটা বেড়ে যাওয়ার পর আমদানির অনুমতি দেয়া হয়। তত দিনে আবার ভারতে দাম বেড়ে গেছে।

 

এসব কারণে দেশে মূল্যস্ফীতি উঠে গেছে ১০ শতাংশের কাছাকাছি। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) ১০ সেপ্টেম্বর জানায়, গত আগস্ট মাসে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল ১২ দশমিক ৫৪ শতাংশ, যা গত ১১ বছর ৭ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ। বিবিএস উদ্বেগজনক মূল্যস্ফীতির হার প্রকাশের চার দিন পর বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, কৃষি মন্ত্রণালয় ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় বৈঠক করে তিন পণ্যের দাম নির্ধারণ করে দেয়।

 

দাম ঠিক করে দেয়া পণ্যের একটি আলু। বিগত কয়েক বছর আলু নিয়ে এমন পরিস্থিতি হয়নি। সাধারণত মৌসুমের শুরুতে আলু প্রতি কেজি ১৫ টাকা এবং শেষ দিকে নভেম্বর-ডিসেম্বরে ৩৫ থেকে ৪০ টাকায় বিক্রি হয়। এবার সেপ্টেম্বরেই আলুর কেজি ৫৫ টাকায় উঠে যায়। এমন অবস্থায় গত বৃহস্পতিবার প্রতি কেজি আলুর দাম ঠিক করে দেয়া হয় ৩৫ থেকে ৩৬ টাকা।

 

বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বৃহস্পতিবার বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম লিটারে ৫ টাকা কমিয়ে ১৬৯ টাকা নির্ধারণ করে দেয়, যা কার্যকর হওয়ার কথা গতকাল থেকে। তবে এখনো নতুন দামের তেল বাজারে আসেনি। অবশ্য ভোজ্যতেল বেশির ভাগ সময় নির্ধারিত দরে বিক্রি হয়। কিন্তু চিনিতে দর মানা হয় না। এখন প্রতি কেজি খোলা চিনির নির্ধারিত দর ১৩০ টাকা। বাজারে বিক্রি হচ্ছে ১৩৫ থেকে ১৪০ টাকা কেজিতে।

 

সরকার যদি তেল, চিনি, আলু, পেঁয়াজ ও ডিমের নির্ধারিত দর কার্যকর করতে পারে, তাহলে একটি পরিবারে মোটামুটি ২৫০ টাকা সাশ্রয় হবে এক মাসে। কিন্তু এই টাকার প্রায় দ্বিগুণ চলে যাবে রান্নার গ্যাসের বাড়তি দামের পেছনে।

 

বিইআরসি চলতি মাসের জন্য ১২ কেজির প্রতিটি সিলিন্ডার গ্যাসের দাম ঠিক করেছে ১ হাজার ২৮৪ টাকা, কিন্তু বাজারে বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ৩৫০ থেকে ১ হাজার ৬০০ টাকায়। পাঁচজনের একটি পরিবারে মাসে দুটি সিলিন্ডার লাগে। এতে বাড়তি দিতে হয় ১৩২ থেকে ৬৩২ টাকা। ঢাকায় বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দাম নেওয়া হয় ১ হাজার ৫০০ টাকা। ফলে রাজধানীর পরিবারগুলোর বাড়তি ব্যয় হয় মাসে ৪৩২ টাকা।

 

আলুর উদাহরণ এ ক্ষেত্রে সামনে এসেছে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, সরকারি হিসাব যা-ই হোক, হিমাগারে আলু মজুত কম হয়েছে, সেটা ব্যবসায়ীরা জানতেন। এ কারণে হিমাগারে আলু মজুতের ‘কাগজ’ কেনাবেচা হয়েছে। যারা বেশি দর দিয়ে আলু কিনেছেন, তারা কোনোভাবেই এখন লোকসান দিতে চাইবেন না। প্রয়োজনে আরও পরে আলু বিক্রি করবেন। সরকারের উচিত ছিল মজুত পরিস্থিতি ও আশপাশের দেশের দাম বিবেচনা করে আগে থেকেই পদক্ষেপ নেয়া।

 

অন্যদিকে বাজার শিগগিরই নিয়ন্ত্রণে আসবে এমন আশাবাদ ব্যক্ত করে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের সহকারী পরিচালক মো. আব্দুল জব্বার মন্ডল ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘আপনারা নিজেরাই দেখতেছেন আমরা আমাদের সামর্থ অনুযায়ী কিভাবে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। আমাদের ডিজি স্যার নিজেই দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে অভিযানে যাচ্ছেন, ব্যবসায়ীসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলোচনা করছেন।

 

আমরা নিয়মিত আমাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছি। আশা করছি খুব শিগগিরই নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে।’

 

ভোরের আকাশ/নি