logo
আপডেট : ১ অক্টোবর, ২০২৩ ১০:৫১
রামু ট্র্যাজেডির ১১ বছরেও নিষ্পত্তি হয়নি ১৮ মামলার
এইচ এম ফরিদুল আলম শাহীন, কক্সবাজার

রামু ট্র্যাজেডির ১১ বছরেও নিষ্পত্তি হয়নি ১৮ মামলার

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করতে একটি কুচক্রী মহল কক্সবাজারের রামু, টেকনাফের উখিয়া ও কক্সবাজার সদরের বৌদ্ধ মন্দির, বিহার, হিন্দু মন্দির ও সংখ্যালঘুদের বসতবাড়িতে অগ্নিসংযোগ লুটপাট ও ভাঙচুর করেছিল আজ থেকে ১১ বছর আগে। এতে বেশি আক্রান্ত হয়েছিল রামু। এ কারণে এ ঘটনাকে রামু ট্র্যাজেডি বলা হয়।

 

২০১২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানার অভিযোগের গুজব ছড়িয়ে মাত্র কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে সবকিছু লন্ডভন্ড হয়ে পডেছিল। কক্সবাজার সদর রামু, উখিয়াও টেকনাফের বৌদ্ধদের হাজার বছরের পুরোনো বুদ্ধমূর্তি, মন্দির, বিহার হিন্দু মন্দির ও শতাধিক বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ চালানো হয় ২৯ সেপ্টেম্বর রাতে। ১১ বছর পেরিয়ে গেল। সেদিনের পুড়ে ছাই হওয়া দৃশ্য আর নেই, সবকিছুর পরিবর্তন করে মন্দির সজ্জিত করা হয়েছে।

 

ঘটনার উত্থান উত্তম বড়ুয়া নামের এক যুবকের ফেসবুক আইডিতে পবিত্র কোরআন অবমাননাকর ছবি পোস্ট করার অভিযোগ তুলে মিছিল সহকারে বৌদ্ধপল্লীতে হামলা চালিয়ে বিহারে অগ্নিসংযোগ, ভাঙচুর ও লুটপাট চালানো হয়। এতে কক্সবাজার সদর, রামু, উখিয়া ও টেকনাফে ১৩টি বৌদ্ধবিহার, মন্দির, বৌদ্ধমূর্তি, হিন্দুদের কয়েকটি মন্দিরে এবং শতাধিক বসতবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

 

এ ঘটনার ১১ বছরে এসেও সেই উত্তম বড়ুয়ার কোনো খোঁজ জানেন না তার বাবা ও মা। এমন কি উত্তম বড়ুয়ার স্ত্রী-সন্তানকে নিয়ে এখন কোথায় আছেন তার তথ্যও দিতে পারেননি কেউ। তবে উত্তম বড়ুয়ার বাবা সুদত্ত জানান, তার ছেলে দেশে আছে কি বিদেশ আছে তা জানেন না। প্রধানমন্ত্রী চাইলে ছেলেকে তার কাছে ফিরে আনতে পারেন। মৃত্যুর আগে ছেলেকে দেখতে চান তিনি।

 

উত্তমের মা মাধু বড়ুয়া জানান, ১১ বছর আগে সংঘঠিত ঘটনাটিতে উত্তম কোনোভাবেই জড়িত নন। উত্তমকে ফিরে আনা হলে প্রকৃত সত্য জানা যাবে। ছেলেকে ফিরে আনার দাবি মায়েরও। রামুর হাইটুপী পাড়া উত্তমের বাবা ও মায়ের সঙ্গে আলাপ হলেও ওখানে পাওয়া যায়নি উত্তমের স্ত্রী রিতা বড়ুয়া ও ১৪ বছরের সন্তান আধিত্র বড়ুয়া। সুদত্ত বড়ুয়া ও মাধু বড়ুয়া জানান, তাদের পুত্রবধূ নাতিকে নিয়ে সীমা বিহার সংলগ্ন ভাড়াবাসায় থাকেন।

 

২০১২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর রাতের ঘটনার পর পুলিশ বাদী হয়ে এজাহারভুক্ত ৩৭৫ জন এবং অজ্ঞাত আরো ১৫/১৬ হাজারজনকে আসামি করে ১৮টি মামলা করে পুলিশ। পরবর্তীতে এসব মামলায় প্রায় ১ হাজারেরও বেশি মানুষকে অভিযুক্ত করে আদালতে অভিযোগ পত্র জমা দেয় পুলিশ। কিন্তু ১১ বছর পার হলেও এখনো পর্যন্ত একটি মামলার বিচার কাজ শেষ হয়নি। এ অবস্থায় বিচার নিয়ে হতাশা প্রকাশ করেছেন বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের নেতারা। তারা বলেছেন, এখন বিচারের নামে নিরাপরাধ কোনো ব্যক্তি হয়রানি হোক তা চান না তারা। তারা চান শান্তি ও সম্প্রীতি।

 

বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের নেতা কেতন বড়ুয়া জানান, ২০১২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যা থেকে রামুতে মিছিল, মিটিং হয়েছে। অনেকেই চেনা গেছে। কিন্তু মামলার পরবর্তী যে প্রক্রিয়া তাতে অনেক চিহ্নিত ব্যক্তি যেমন বাদ পড়েছে তেমনি নিরাপরাধ অনেকেই হয়রানি হতে দেখা গেছে। বৌদ্ধ ধর্ম শান্তির। এখন সকলেই শান্তি চান, যে সম্প্রীতিতে রামুবাসি বসবাস করছে তা যেন রক্ষা হয়।

 

বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের আরেক নেতা বিপুল বড়ুয়া বলেন একই কথা। তিনি বলেন, ঘটনার ১১ বছরে এসে বৌদ্ধ স¤প্রদায়ের মানুষ ভুলতে বসেছে। পুঁড়িয়ে দেয়া বিহার নান্দনিকভাবে নির্মিত করে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শান্তিতে আছি, সম্প্রীতিতে আছি। এর চেয়ে বেশি পাওয়ার নেই।

 

কক্সবাজার জেলা বৌদ্ধ সুরক্ষা পরিষদের সভাপতি ও রামু কেন্দ্রিয় সীমা বিহারের আবাসিক প্রধান প্রজ্ঞানন্দ মহাথের জানান, আলোচিত এ হামলার ঘটনায় এলাকার সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিতে যে সংকট তৈরি হয়েছিল তা অনেকটা ঘুছিয়েছে। এটা ধারাবাহিক রক্ষা করা জরুরি। বিচারের নামে প্রকৃত অপরাধিদের চিহ্নিত করা জরুরি। এটা করতে গিয়ে নিরাপরাধ কেউ হয়রানিতে শিকার হোক তা কোনোভাবেই কাম্য নয়।

 

রামুর বৌদ্ধ মন্দিরে অগ্নিসংযোগ ও হামলার ঘটনায় এখনো কেন বিচার শেষ হয়নি, এমন প্রশ্নের উত্তরে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী ফরিদুল আলম বললেন, এই মামলা সাক্ষীরা সাক্ষ্য দিতে চান না। যার কারণে মামলা নিষ্পত্তিতে দেরি হচ্ছে। রামু, উখিয়া ও টেকনাফে ১৯টি মামলা করা হয়েছিল। এতে এজাহারভুক্ত ৩৭৫ জনসহ ১৫ হাজার ১৮২ জনকে অভিযুক্ত করা হয়। এরপর আপোসের ভিত্তিতে একটি মামলা প্রত্যাহার করা হলেও ১৮টি মামলায় ৯৯৩ জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেয় তদন্তকারী সংস্থা।

 

একজন তদন্তকারী পুলিশের কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, এসব মামলাসমূহে রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি কাজ করছে। অনেক নিরাপরাধ লোক আসামি হয়েছে। অনেকে এ ঘটনার সঙ্গে সরাসরি জড়িত এমন অনেক লোক বাদ পড়েছে। এ কারণে সময়মত সাক্ষীদের কোর্টে হাজির করা যাচ্ছেনা। কারণ মিথ্যা সাক্ষী দিয়ে আর অপরাধ অনেকে করতে চাননা। সেদিনের ছবি ও ভিডিও ফুটেজ দেখে অপরাধীদের সনাক্ত করা হলে বিচার কাজ সহজে দ্রুত সময়ে নিষ্পত্তি হবে বলে মনে করেন অনেক বিজ্ঞ আইনজীবী।

 

ভোরের আকাশ/নি