logo
আপডেট : ১ অক্টোবর, ২০২৩ ১১:০১
চাহিদা বেড়ে দ্বিগুণ
এক দশকে গমের উৎপাদন কমেছে ২০ শতাংশ
নিজস্ব প্রতিবেদক

এক দশকে গমের উৎপাদন কমেছে ২০ শতাংশ

গত এক দশকে বাংলাদেশে গমের চাহিদা বেড়ে হয়েছে দ্বিগুণ। এ সময়ে বাড়েনি উৎপাদন। বরং কমেছে প্রায় ২০ শতাংশ। ফলে ব্যাপকহারে বেড়েছে আমদানিনির্ভরতা। যা সার্বিক আমদানি ব্যয় এবং খাদ্য-নিরাপত্তার জন্য উদ্বেগের কারণ হয়ে উঠছে। চালের পরেই আমরা গমের তৈরি খাবার বেশি ভোগ করি। রুটি, পাউরুটি, বিস্কিটজাতীয় পণ্য আমাদের খাবারে এনেছে বৈচিত্র্য।

 

বর্তমানে দেশে প্রক্রিয়াজাত খাদ্যের দুই-তৃতীয়াংশের বেশি খাদ্য গমের তৈরি। বাসাবাড়িতে রুটি-পরোটা খাওয়ার চলও বেড়েছে আগের চেয়ে। একইসঙ্গে বেড়েছে গমের আমদানি। চাহিদা বাড়লেও গমের উৎপাদন না বেড়ে বরং কমেছে।

 

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুসারে, সর্বশেষ গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে দেশে গমের উৎপাদন হয়েছে ১১ লাখ ৭০ হাজার টন। যেখানে এক দশক আগেও (২০১৩-১৪ অর্থবছর) দেশে গমের উৎপাদন ছিল ১৩ লাখ ৬ হাজার টন। গম চাষ করে ন্যায্যমূল্য পাচ্ছেন না কৃষক। সরকার দাম নির্ধারণ করলেও বাস্তবে দাম পাচ্ছেন ১৫ থেকে ১৬ টাকা কেজি, যা লাভের জন্য ৩০ টাকা হওয়া উচিত। কৃষকের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিতের কোনো বিকল্প নেই। এটি দ্বিতীয় প্রধান খাদ্যশস্য। উৎপাদন কমলে খাদ্যঝুঁকি বেড়ে যাবে। এজন্য কন্ট্রাক্ট ফার্মিংয়ের ব্যবস্থা করা যেতে পারে।

 

দেশে এ ক্রমবর্ধমান গমের চাহিদা অব্যাহত থাকবে বলে মনে করেন দেশের শীর্ষ আমদানিকারকদের একজন বিএসএম গ্রুপের চেয়ারম্যান আবুল বশর চৌধুরী। তিনি বলেন, শুধু বাসাবাড়িতে খাবার নয়, এখন প্রক্রিয়াজাত খাবারের বাজারের সঙ্গে বাড়ছে গমের চাহিদা। কারণ এসব দেশে রুটি, বেকারি, ফাস্টফুড ইত্যাদি পণ্যের চাহিদা বাড়ছে। যা একটি বড় কারণ।

 

খাদ্য মন্ত্রণালয় বলছে, দেশে এখন বছরে গড়ে ৫০ থেকে ৬৭ লাখ টন গম ও গমজাত পণ্য আমদানি করতে হচ্ছে। এক দশক আগে (২০১৩-১৪ অর্থবছর) আমদানি করা হতো ৩৩ লাখ টন গম। এতে বর্তমানে দেশের ব্যয় গুনতে হচ্ছে দেড় থেকে আড়াই বিলিয়ন ডলার পর্যন্ত। যা অন্তর্জাতিক বাজারে গমের দামের সঙ্গে কম-বেশি হয়।

 

তিনি বলেন, শুধু বাংলাদেশ নয়, এমন উন্নয়নশীল দেশগুলোতে দিন দিন গমের চাহিদা বাড়ছে। আবার বাজারে চালের দাম বাড়ায় একটি বাড়তি চাপ রয়েছে গমের ওপর। যখন চালের দাম বেশি হয়, তখন গমের দাম কম হলে আটা খাওয়া বেড়ে যায়। গত কয়েক বছর সেটা হচ্ছে। এছাড়া প্রাণিখাদ্য হিসেবেও গম ও গমজাত পণ্য ভোগ বেড়েছে।

 

কৃষি গবেষণা ফাউন্ডেশনের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক এম এ হামিদ বলেন, আমাদের চাহিদা যেভাবে বাড়ছে এবং বাড়বে, সেভাবে আমরা উৎপাদন বাড়াতে পারিনি। গমের জমি ও উৎপাদন উভয়ই ধীরে ধীরে কমছে। কারণ কৃষকরা বিকল্প ফসলের দিকে ঝুঁকছেন, যেগুলো এখন গমের চেয়ে বেশি লাভজনক। তিনি বলেন, এছাড়া গম দীর্ঘমেয়াদি ফসল। গমের জন্য দীর্ঘমেয়াদি শীতের প্রয়োজন, যেটা দেশে দিন দিন কমে যাচ্ছে। ফলে ফলনও কমছে।

 

কৃষি অর্থনীতিবিদ ড. আক্তারুজ্জামান বলেন, যেহেতু এখন গম চাষ বাড়ানোর বিকল্প নেই, সেজন্য গম চাষের এলাকাকে আগের পর্যায়ে ফিরিয়ে অনতে নীতি প্রণয়ন করা উচিত। কৃষদের উদ্বুদ্ধ করতে প্রণোদনা দেয়া দরকার। তারপরে উৎপাদন বাড়ানোর কথা ভাবা যেতে পারে।

 

তিনি বলেন, বাংলাদেশ গম ও ভুট্টা গবেষণা কেন্দ্র (বিডব্লিউএমআরআই), বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিএআরআই), কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরসহ স্থানীয় সম্প্রসারণ কর্মকর্তাদের সঙ্গে গমের উৎপাদন বাড়াতে কৃষকদের নিবিড়ভাবে কাজ করতে হবে। আমাদের চাহিদা যেভাবে বাড়ছে এবং বাড়বে, সেভাবে আমরা উৎপাদন বাড়াতে পারিনি। গমের জমি ও উৎপাদন উভয়ই ধীরে ধীরে কমছে। কারণ কৃষকরা বিকল্প ফসলের দিকে ঝুঁকছেন, যেগুলো এখন গমের চেয়ে বেশি লাভজনক।

 

এ কৃষিবিদ আরো বলেন, ২০১৫ ও ২০১৭ সালে ব্লাস্ট রোগ গমের ব্যাপক ক্ষতি করেছিল। ওই সময় কৃষকদের অনেকে গম চাষ একদম ছেড়েছেন। এখনো ওই ফসল চাষের বিষয়ে তাদের মনের ভয় কাটেনি। যদিও সাম্প্রতিক বছরগুলিতে ছত্রাকজনিত রোগের তীব্রতা কমেছে। তবুও তারা আগ্রহী নন। কৃষি অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, যেখানে এক দশক আগে দেশে ৪৬ লাখ হেক্টর জমিতে গমের চাষ হতো সেটা এখন কমে ৩০ লাখ হেক্টরে এসেছে।

 

বঙ্গবন্ধু কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি ব্যবস্থাপনা বিভাগের অধ্যাপক গাজী এম এ জলিল বলেন, ভুট্টার দামের ক্রমবর্ধমান প্রবণতা কৃষকদের সেগুলো চাষে উৎসাহিত করেছে। তবে আমাদের গমেও মনোযোগ বাড়াতে হবে, কেননা গম আমদানিতে প্রচুর ব্যয় বহন করতে হচ্ছে। বিশ্ববাজারে দাম বাড়লে দেশে অনেক খাবারের দামে প্রভাব পড়ছে। এমনকি প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্য রপ্তানিতেও প্রভাব ফেলছে গমের দাম।

 

বাংলাদেশ গম ও ভুট্টা গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ড. গোলাম ফারুক বলেন, বর্তমানে জলবায়ুগত বৈশ্বিক সমস্যা, বিভিন্ন ফসলের সঙ্গে প্রতিযোগিতা, উপযুক্ত জাতের সীমাবদ্ধতায় একই সময়ে অন্য শস্যের সঙ্গে পেরে উঠছে না গম।

 

গমের ন্যায্যমূল্য একটি বড় সমস্যা জানিয়ে এই গবেষক বলেন, গম চাষ করে ন্যায্যমূল্য পাচ্ছেন না কৃষক। সরকার দাম নির্ধারণ করলেও বাস্তবে দাম পাচ্ছেন ১৫ থেকে ১৬ টাকা কেজি, যা লাভের জন্য ৩০ টাকা হওয়া উচিত। গোলাম ফারুক আরো বলেন, কৃষকের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিতের কোনো বিকল্প নেই। এটি দ্বিতীয় প্রধান খাদ্যশস্য। উৎপাদন কমলে খাদ্যঝুঁকি বেড়ে যাবে। এজন্য কন্ট্রাক্ট ফার্মিংয়ের ব্যবস্থা করা যেতে পারে।

 

কৃষি অর্থনীতিবিদরা আরো বলছেন, গমের উৎপাদন কমার আরেক কারণ ভুট্টার চাষ বেড়ে যাওয়া। একই সময়ে হওয়ার কারণে ভুট্টার তুলনায় বেশি সেচ খরচ, ভালো বীজের অভাব, ফলন কম, শ্রমিক সংকট ও বৈরী আবহাওয়ার কারণে গম চাষে উৎসাহ হারিয়ে ফেলছেন কৃষকেরা। তারা ভুট্টা চাষ করছেন।

 

ভোরের আকাশ/নি