logo
আপডেট : ১১ অক্টোবর, ২০২৩ ১০:৪৯
শ্রমে-ঘামে গর্বিত নারী
মীর বাবুল, ময়মনসিংহ

শ্রমে-ঘামে গর্বিত নারী

ময়মনসিংহের কৃষ্টপুর এলাকায় বউ বাজারে নারী বিক্রেতা

স্বামী, সংসার আর বাচ্চা সামলিয়ে দিন পার করতেন ময়মনসিংহের কৃষ্টপুর এলাকার দরিদ্র নারীরা। স্বামীর উপার্জনের টাকা দিয়ে প্রতিদিন তিনবেলা ঠিকমতো খেতে পারতেন না। সন্তানদের পড়াশোনা করানো ছিল দুঃস্বপ্নের মতো। কিন্তু এখন এসব নারীর উদ্যোগেই সংসারে সুখ এসেছে, স্বাচ্ছন্দ্যে বসবাস করছেন তারা।

 

এর পেছনে রয়েছে নগরীর কৃষ্টপুর এলাকার দুই কলোনি ঘিরে একটি বাজার গড়ে উঠার গল্প। শুধু নারীদের কর্মসংস্থানের জন্য ‘বউ বাজার’ নামে এই বাজারটি গড়ে না উঠলে ঘরবন্দি জীবন-যাপনই করতে হতো অনেক নারীদের। দরিদ্র স্বামীর রোজগারে দুঃখ-কষ্টে অতিবাহিত হতো জীবন।

 

সরেজমিন বাজারটিতে গিয়ে দেখা যায়, এখানে প্রায় ১০০টির মতো দোকান রয়েছে। এর মধ্যে কাঁচা তরিতরকারি, ছোট-বড় সবধরনের মাছ, মাংস, শুঁটকি ও মুদির দোকান। এসব দোকানে নারীরা বেচাকেনা করেছেন। তবে কয়েকজন পুরুষ বিক্রেতাও রয়েছেন।

 

স্থানীয়রা জানান, এই কলোনি এলাকার বেশিরভাগ মানুষের অভাব অনটনের সংসার। অনেক দরিদ্র নারীরা তাদের স্বামীর কাছে বঞ্চনার স্বীকার হতো। কারণ স্বামীর উপার্জনের টাকা ছাড়া সংসার চালানো সম্ভব ছিল না। ফলে ৩০ বছর আগে কয়েকজন নারী নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা করে শুধু নারীদের জন্য একটি বাজার প্রতিষ্ঠা করার পরিকল্পনা করেন। যেখানে শুধু নারীরাই থাকবে ক্রেতা-বিক্রেতা। সে অনুযায়ী ‘বউ বাজার’ নাম দিয়ে বাজারে তরিতরকারি বিক্রি শুরু করেন, যা এখন পর্যন্ত চলছে।

 

এই বাজারে মুরগি বিক্রি করেন রাশিদা বেগম। তিনি জানান, তার স্বামী ১০ বছর আগে মারা যান। স্বামী মারা যাওয়ার পর তিনবেলার খাবার ও সন্তানদের পড়াশোনা করানো নিয়ে চোখেমুখে চিন্তার ভাঁজ পড়ে যায়। তখন বউবাজারে অন্য নারীদের ব্যবসা করতে দেখে উৎসাহ পাই। সেই থেকে মুরগির ব্যবসা শুরু করি। ধীরে ধীরে পরিবারে সচ্ছলতা আসে। আয় করা টাকা দিয়ে সন্তানকে শিক্ষিত বানিয়েছি।

 

তরিতরকারি বিক্রেতা রত্না বেগম বলেন, ঘরে অভাব অনটন সবসময় লেগেই থাকত। ঠিকমতো তিনবেলা খাবার খাওয়া ছিল দুঃস্বপ্নের মতো। এই বাজারে তরিতরকারি বিক্রি করে সংসারের হাল ধরেছি। প্রতিদিন ২ হাজার ৫০০ টাকা থেকে ৩ হাজার টাকার তরিতরকারি বিক্রি করি। এতে লাভ হয় ৫শ থেকে ৬শ টাকা। আমার আয় করা এই টাকা সংসারে খরচ করছি। এতে স্বামীও খুশি।

 

মাছ বিক্রি করেন অজুফা আক্তার। তিনি বলেন, নগরীর মেছুয়া বাজার ও শম্ভুগঞ্জ বাজার থেকে পাইকারি ধরে মাছ কিনে এখানে বউ বাজারে বিক্রি করি। মাছ বিক্রিতে আমার সাথে স্বামীও সাহায্য করেন। প্রতিদিন ২০ থেকে ২২ হাজার টাকার মাছ বিক্রি করতে পারি। এতে প্রতিদিন এক হাজার থেকে ১২শ টাকা পর্যন্ত লাভ হয়। অন্যান্য বাজারের তুলনায় এখানে দাম তুলনামূলক কম। তাই ক্রেতার সংখ্যা বেশি।

 

কথা হয় নারগিস আক্তার নামে একজন ক্রেতার সাথে। তিনি বলেন, এই বাজারে অল্প আয়ের ক্রেতা বেশি। আমিও এই বাজার থেকেই নিয়মিত সবধরনের খাদ্যপণ্য কিনে নিই। ন্যায্য দামে সবাই কিনতে পেরে খুশি।

 

মনোয়ারা বেগম নামে আরেকজন বলেন, আগে শুধু নারীরা বিক্রি করলেও বর্তমানে কয়েকজন পুরুষ বিক্রেতাও দোকান দিয়েছে। এতে করে নারী ক্রেতার সংখ্যা কমে যাওয়ার পাশাপাশি বউ বাজার নামটিই একদিন মুছে যাবে। এখানে পুরুষদের বেচাকেনা নিষিদ্ধ করা হোক। পাশাপাশি বাজারটি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখাসহ উন্নয়ন করা প্রয়োজন।

 

ময়মনসিংহ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সিনিয়র সহ-সভাপতি শংকর সাহা বলেন, নিজের প্রচেষ্টায় স্বাবলম্বী হয়েছে এখানকার নারীরা। অভাব দূর করে সন্তানদের পড়াশোনা করাচ্ছেন। স্বামী-সন্তান নিয়ে স্বাচ্ছন্দ্যে বসবাস করছেন। এই নারীদের দেখে অন্য নারীরাও যেকোনো ব্যবসায় উৎসাহ পাবে।

 

এ বিষয়ে ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশনের মেয়র মো. ইকরামুল হক টিটু বলেন, চেষ্টার মাধ্যমেই সফলতা আসে। তবে কোনো কাজকেই ছোট মনে করা যাবে না। পরিশ্রমী ওইসব নারীরা অনেক দরিদ্র নারীদের অনুপ্রেরণা জোগাতে সাহায্য করবে। সিটি করপোরেশনের অনেক জায়গায় উন্নয়ন কর্মকান্ড চলমান রয়েছে। এই বউ বাজার ছাড়াও বিভিন্ন বাজার উন্নয়নের পরিকল্পনা রয়েছে।

 

ভোরের আকাশ/নি