logo
আপডেট : ১৪ অক্টোবর, ২০২৩ ১০:২০
গাজার উত্তরাঞ্চলে বড় ধরনের হামলার প্রস্তুতি ইসরায়েলের
শাহীন রহমান

গাজার উত্তরাঞ্চলে বড় ধরনের হামলার প্রস্তুতি ইসরায়েলের

শাহীন রহমান: গত সাতদিন ধরে গাজায় উপত্যকায় অব্যাহতভাবে হামলা চালাচ্ছে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী। ইতোমধ্যে তারা গাজার উত্তরাঞ্চলে বড় ধরনের হামলার প্রস্তুতি নিয়েছে। ওই এলাকা থেকে সাধারণ নাগরিকদের সরে যেতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। যানা গেছে গাজার উত্তর সিটি এলাকায় ১১ লাখের অধিক নাগরিকের বসবাস। এদের গাজার দক্ষিণের সরে যেতে বলা হয়েছে। খবর বিবিসি, সিএনএন এপি, এএফপি রয়টার্স

 

ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাস গত শনিবার ইসরায়েলে নজিরবিহীন হামলা চালায়। হামাসের হামলায় ইসরায়েলে নিহত মানুষের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৩০০। জবাবে গত শনিবারই পাল্টা হামলা শুরু করে ইসরায়েল। অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলি হামলায় নিহত ফিলিস্তিনিদের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৫৩৭। আহত হয়েছেন ৬ হাজার ৬১২ জন। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এ তথ্য জানায়।

 

মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, নিহত ফিলিস্তিনিদের মধ্যে ৫০০ শিশু ও ২৭৬ নারী রয়েছে।

 

ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী জাতিসংঘকে জানিয়েছে, ২৪ ঘণ্টার মধ্যে গাজার উত্তরাঞ্চলে বসবাসরত সব মানুষ গাজার দক্ষিণাঞ্চলে সরিয়ে নেয়া হোক। তবে জাতিসংঘ বলছে, ওই এলাকায় প্রায় ১১ লাখ মানুষ বসবাস করে, যা পুরো গাজা উপত্যকায় বসবাসরত মানুষের প্রায় অর্ধেক। এই অঞ্চলের মধ্যে ঘনবসতিপূর্ণ গাজা শহরও রয়েছে।

 

এক বিবৃতিতে জাতিসংঘ বলে, জাতিসংঘ মনে করে মারাত্মক মানবিক বিপর্যয় ছাড়া এ ধরনের স্থানান্তর সম্ভব নয়।

 

জাতিসংঘকে উদ্ধৃতি করে এফপির রিপোর্টে বলা হয়েছে ইসায়েলের ভারী বোমা বর্ষণের পর গাজায় ৪ লাখ ৩৮ হাজারের বেশি মানুষ তাদের বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছে। গাজায় একটি শরণার্থী ভবনে ইসরায়েল হামলা চালিয়েছে বলে হামাসের তরফে দাবি করা হয়েছে। তাতে নারী ও শিশু-সহ বহু মানুষের মৃত্যু হয়েছে বলে তারা দাবি করেছে। হামাসের সশস্ত্র শাখার পক্ষ থেকে বলা হয়েছে ২৪ ঘণ্টায় ইসরায়েলি বিমান হামলায় উত্তর গাজা উপত্যকায় আটক অন্তত ১৩ ইসরায়েলি ও বিদেশী জিম্মি নিহত হয়েছে।

 

গত শনিবার ফিলিস্তিনি সংগঠন হামাসের হামলার পর অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় অনবরত হামলা চালিয়ে যাচ্ছে ইসরায়েল। গাজায় এ পর্যন্ত প্রায় ৬ হাজার বোমা ফেলার কথা জানিয়েছে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী। ইসরায়েলি হামলায় নিহতদের মরদেহ নেয়া হচ্ছে গাজা শহরের শিফা হাসপাতালে। ইসরায়েল-হামাস চলমান সংঘাতের এত মরদেহের ভার নিতে পারছে না গাজার সবচেয়ে বড় এই হাসপাতালটি।

 

গাজায় ফিলিস্তিনি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কার্যালয়ের বরাত দিয়ে সিএনএন জানায়, বৃহস্পতিবার পর্যন্ত গাজায় অন্তত ১ হাজার ৫৩৭ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে। তাদের মধ্যে ৫০০ জন শিশু ও ২৬৭ জন নারী। আহত হয়েছেন অন্তত ৬ হাজার ৬১২ জন। বৃহস্পতিবার গাজা শহরের উত্তরে শাতি শরণার্থী শিবিরে ভারী বোমা হামলায় অসংখ্য মানুষ ক্ষতবিক্ষত হয়। শিফা হাসপাতালের আইসিইউ ভরে যায়। হাসপাতালের করিডরে রাখা হয় আহতদের।

 

বার্তাসংস্থা এপির প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রায় ২৩ লাখ জনসংখ্যা অধ্যুষিত গাজায় ইসরায়েলের ভারী বোমা হামলায় যত দ্রুত মানুষ নিহত হচ্ছে, অত দ্রুত স্বজনরা মরদেহ শনাক্ত করতে পারছেন না।

 

চিকিৎসকরা বলছেন, ইসরায়েলি হামলায় প্রতিদিন অসংখ্য ফিলিস্তিনি নিহত হচ্ছেন। বিভিন্ন ধ্বংসস্তূপ থেকে মরদেহ উদ্ধার করে আনলেও রাখার জায়গা হচ্ছে না। এ অবস্থায় হিমঘরের বাইরে তিনটি স্তূপে মরদেহ রাখতে হয়েছে। হাসপাতালের পার্কিং লটেও রাখতে হয়েছে বেশ কিছু মরদেহ।

 

ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর দাবি, তারা হামাসের জঙ্গি অবকাঠামোতে হামলা করছে এবং বেসামরিক নাগরিকরা যেন আহত না হয়, সেভাবে লক্ষ্যবস্তু নির্ধারণ করছে। ‘হামলা এবং অবরোধের কারণে গাজার স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে’ উল্লেখ করে শিফা হাসপাতালের মহাপরিচালক মোহাম্মদ আবু সেলিম বলেন, কোনো অবস্থাতেই সেবাদান চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। আহতরা ক্ষতবিক্ষত অবস্থায় রাস্তায় পড়ে রয়েছে। তাদের জন্য একটি বেডের ব্যবস্থা করতে পারছি না।

 

এদিকে ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজার বাসিন্দাদের সরে যেতে ২৪ ঘণ্টার আল্টিমেটাম দেয়া হলেও হামাস জানিয়েছে, ফিলিস্তিনিরা তাদের জন্মস্থান ছেড়ে কোথাও যাবে না। এ ছাড়া ইসরাইলের আল্টিমেটাম উপেক্ষা করে দেশটিতে আরও অন্তত ১৫০টি রকেট নিক্ষেপ করেছে সংগঠনটি। কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরা শুক্রবার জানিয়েছে, ইসরাইল যখন ভূমি থেকে অভিযান শুরু করার প্রস্তুতি নিচ্ছে তখন ফের রকেট হামলা শুরু করেছে হামাস। হামাসের সশস্ত্র শাখা আল-কাসাম ব্রিগেড জনিয়েছে, বেসামরিক নাগরিকদের বাস্তুচ্যুত ও লক্ষ্যবস্তু করার প্রতিক্রিয়ায় ইসরাইলের আশকেলন শহরের দিকে ১৫০টি রকেট ছোড়া হয়েছে।

 

এদিকে ইসরায়েল একটি স্থল অভিযানের প্রস্তুতি নিচ্ছে। এর অংশ হিসেবে এরইমধ্যে গাজা সীমান্তে সেনা মোতায়েন, ভারী আর্টিলারি এবং ট্যাংক জড়ো করেছে তারা। গত শনিবার ইসরায়েলে হামাসের সশস্ত্র সদস্যরা অতর্কিত হামলা চালানোর পর থেকে গাজায় বিমান হামলা চালিয়ে আসছে ইসরায়েল। জাতিসংঘে নিযুক্ত ইসরায়েলের কূটনীতিক গিলাদ এরদান, গাজা থেকে বাসিন্দাদের স্থানান্তরের বিষয়ে জাতিসংঘের প্রতিক্রিয়ার সমালোচনা করেছেন। তিনি বলেন, ইসরায়েলের স্থানান্তরের নির্দেশ নিয়ে আন্তর্জাতিক এই সংগঠনটির বিবৃতি লজ্জাজনক।

 

তিনি বলেন, হামাসের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযানের সময় যাতে জড়িত নয় এমন বাসিন্দাদের ক্ষয়-ক্ষতি কমিয়ে আনা যায় তার জন্য গাজার বাসিন্দাদের আগে থেকেই সতর্ক করেছে ইসরায়েল। অনেক বছর ধরে জাতিসংঘ হামাসের সশস্ত্র হয়ে ওঠা, গাজা উপত্যকায় বেসামরিক নাগরিক ও স্থাপনাকে পালানোর আশ্রয় এবং অস্ত্র ও হত্যা লুকানোর আশ্রয় হিসেবে ব্যবহারের বিষয়টি এড়িয়ে গেছে। এখন ইসরায়েলের পাশে দাঁড়ানোর পরিবর্তে, যাদের নাগরিকের হামাসের সন্ত্রাসীরা হত্যা করেছে. ইসরায়েলকে কথা শোনাচ্ছে। এখন জিম্মিদের ফিরিয়ে আনা, হামাসের নিন্দা জানানো এবং ইসরায়েলের আত্মরক্ষার অধিকারের উপর ফোকাস করাটাই জাতিসংঘের জন্য ভালো হবে,’ তিনি বলেন।

 

শুক্রবার ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর বিবৃতিতে বলা হয়েছে, হামাসের সদস্যরা গাজা সিটির ঘরবাড়ির নিচে থাকা টানেলের ভেতরে, বেসামরিক ভবনের ভেতরে লুকিয়ে আছেন। যখন পরবর্তী ঘোষণা দেওয়া হবে, তখন বেসামরিক লোকজন গাজা সিটিতে ফিরতে পারবে বলে বিবৃতিতে জানায় ইসরায়েলি সেনাবাহিনী। ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর এই স্থানান্তর আদেশ জাতিসংঘ কর্মীসহ আশ্রয়শিবিরে থাকা ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের জন্যও প্রযোজ্য হবে বলে জানিয়েছে সংস্থাটি।

 

ইসরায়েল বলেছে, গত সাত দিনে গাজায় হামাসের স্থাপনা লক্ষ্য করে চার হাজার টন ওজনের প্রায় ছয় হাজার বোমা নিক্ষেপ করা হয়েছে। ইসরায়েলের বিমানবাহিনী বলেছে, বিমান হামলায় মোট ৩৬ হাজারের বেশি স্থাপনায় আঘাত হেনেছে। এদিকে মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ইসরায়েলের বিরুদ্ধে গাজা ও লেবাননে বিতর্কিত সাদা ফসফরাস বোমা ব্যবহারের অভিযোগ তুলেছে। অতি দাহ্য এই রাসায়নিক অনেক সময় সামরিক বাহিনী তাদের সীমান্ত নির্ধারণের জন্য ব্যবহার করে।

 

কিন্তু এটা মানুষকে মারাত্মকভাবে পুড়িয়ে দিতে পারে। আর অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হলে বিশেষ করে গাজার মতো এতো ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় ব্যবহার করা হলে এটি প্রচন্ড মারাত্মক হয়ে উঠতে পারে।

 

ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী সংবাদ সংস্থা রয়টার্সকে বলেছে, বর্তমানে গাজায় সাদা ফসফরাসযুক্ত অস্ত্র ব্যবহারের বিষয়ে তারা সচেতন নন। তবে লেবাননের বিষয়ে তারা কোন মন্তব্য করতে রাজি হননি। এইচআরডাব্লিউ বলছে, তারা গাজা এবং লেবাননে ধারণকৃত ভিডিও দেখে তা বিশ্লেষণ করে সাদা ফসফরাসযুক্ত আর্টিলারি শেল বিস্ফোরিত হতে দেখেছেন। বার্তা সংস্থা এএফপি এর তোলা ছবিতেও এর উপস্থিতি দেখা যাচ্ছে। ছবিতে উঠে এসেছে, গাজায় বিস্ফোরিত হওয়ার সময় সাদা রেখা তৈরি হয়েছে। সাদা ফসফরাস বাতাসের অক্সিজেনের সংস্পর্শে আসলে তা ঘন সাদা ধোঁয়া তৈরি করে।

 

এক বিবৃতিতে মানবাধিকার সংস্থাটি বলে, বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় সাদা ফসফরাসের ব্যবহার বেসামরিক নাগরিকদের ঝুঁকি অনেক বেশি বাড়িয়ে দেয় এবং তা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের লঙ্ঘন যেখানে বেসমারিক নাগরিকদের বিনা কারণে ঝুঁকি বাড়ানোর বিষয়ে নিষেধ করা হয়েছে। এদিকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলেছে, গত শনিবার থেকে এ পর্যন্ত ১১ জন স্বাস্থ্যকর্মী গাজায় নিহত হয়েছে। ইসরায়েল প্রতিশোধ হিসেবে বিমান হামলা শুরু করার পর থেকে গাজায় এ পর্যন্ত ১৪০০ মানুষ নিহত হয়েছে।

 

এদিকে ইসরাইলের বিরুদ্ধে ইরাকের রাজধানী বাগদাদ ও জর্ডানে বিক্ষোভ হয়েছে। শিয়া নেতা মোক্তাদা আল সদরের আহব্বানে বাগদাদের তাহরির স্কয়ারে হাজার হাজার মানুষ হাজির হয়ে বিক্ষোভ করেন এবং ইসরাইল ও যুক্তরাষ্ট্রবিরোধী স্লোগান দেন। একইভাবে ইসরাইল সীমান্তের দিকে বিক্ষোভ মিছিল করেছেন জর্ডানের শত শত নাগরিক।

 

এর আগে জর্ডানের বাদশাহ আবদুল্লাহ বলেছেন, ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ছাড়া শান্তি সম্ভব নয়।

 

ভোরের আকাশ/নি