মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বিজড়িত, ইতিহাস, ঐতিহ্য এবং সংহতির ধারক বাহক পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় (জবি)। ‘জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় আইন-২০০৫’ জারির মাধ্যমে ২০০৫ সালের ২০ অক্টোবর থেকে চালু হয় প্রতিষ্ঠানটির কার্যক্রম। তারই ফলস্বরূপ আসছে ২০ অক্টোবর উনিশ বছরে পা রাখতে যাচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়টি। প্রতিবারের মত এবারও জাঁকজমকভাবে পালন করা হবে দিবসটি। যার প্রভাব লক্ষ্য করা আচ্ছে ক্যাম্পাসে শিক্ষক শিক্ষার্থীদের মাঝে। কিন্তু কলেজ থেকে পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তর হওয়া এই প্রতিষ্ঠান কতটুকু এগিয়ে গেল তা প্রশ্ন জাগে সবার মাঝেই।
নানা সীমাবদ্ধতার বেড়াজালে আবদ্ধ থাকার পরেও একাডেমিক ও গবেষণায় অগ্রগামী হয়েছে বলে মনে করেন শিক্ষক শিক্ষার্থীরা। তবে অবকাঠামো দিক থেকে অনেকাংশে পিছিয়ে আছে বলেই তাদের মত। তবে কেরানীগঞ্জ এ হতে যাওয়া ২য় ক্যাম্পাসের মাধ্যমে অবকাঠামোগত দিকেও সফল হবেন বলে মনে করেন অনেকে। ২য় ক্যাম্পাসের কাজের ধীরগতি বলছে এখনো অনেক সময় প্রয়োজন জগন্নাথের অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য।
বিগত আট বছরে বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অগ্রগতি নিয়ে সাক্ষাৎকার দেন প্রতিষ্ঠানটির বর্তমান উপাচার্য (চলতি দায়িত্ব), ট্রেজারার অধ্যাপক ড. কামালউদ্দিন আহমেদ। তিনি জানান, এই বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি যখন প্রথম ইংরেজি বিভাগের চেয়ারম্যান হয়ে আসি তখন দেখতাম এখানে অনেক সীমাবদ্ধতা। ছাত্ররাজনীতি নিয়ে মারামারি, অনেক বিভাগে রেগুলার ক্লাস না হওয়া ইত্যাদি।
পরবর্তীতে আমি এখানকার প্রক্টর এর দায়িত্ব পালন করি। ২০১৯ থেকে এখন পর্যন্ত এখানে ট্রেজারার হিসেবে আছি। আমি যখন এখানে আসি তখন ছাত্রী হলের কাজ অনেক বাকি। নতুন ভবন এর উপরের অংশের কাজ বন্ধ ছিল। এরপর কাজগুলো পর্যায়ক্রমে হয়।
তিনি আরো জানান, নতুন ভবন এর বিভাগের জন্য ক্লাস রুম বণ্টন নিয়েও অনেক কাজ করতে হয়েছে প্রশাসনকে। ছোট ক্যাম্পাস হওয়ায় এখানে অনেক সীমাবদ্ধতা রয়েছে। তবে একাডেমিক কাজ চালিয়ে যেতে নতুন ভবন অনেক গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
গবেষণা খাতে বরাদ্দের বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি জানান, গবেষণা খাতে বরাদ্দ প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। আমরা তো প্রতিনিয়ত বাড়াতে চাই। বর্তমান আড়াই কোটি টাকা বরাদ্দ আছে। শিক্ষার্থীরা গবেষণা করতে চাইলেই আমরা বরাদ্দ দিব। চাকরির বিভিন্ন প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় আমাদের শিক্ষার্থীরা দারুণ সাফল্য নিয়ে আসছে।
এছাড়াও বিগত বছরগুলোতে প্রতিষ্ঠানটির অর্জনের বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন তিনি। তার ভাষ্যমতে, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের মাঝে আত্মহত্যার প্রবণতা, বিষণ্ণতা, পরীক্ষা ভীতি থেকে মুক্তির লক্ষ্যে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকেল সেন্টারে প্রতিষ্ঠিত হয় কাউন্সিলিং সেন্টার। বঙ্গবন্ধুর জীবনদর্শন, মতাদর্শ, মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশসহ বিভিন্ন বিষয়ে গবেষণার জন্য জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুমোদন দেয়া হয়েছে ‘বঙ্গবন্ধু চেয়ার’। বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তি (এপিএ) বাস্তবায়নে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) কর্তৃক মূল্যায়নে দেশের ৪৬টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০২১-২২ অর্থ বছরে ৯৩.৭৫ নম্বর পেয়ে তৃতীয় স্থান অর্জন করে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।
বিদেশের একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে বিভিন্ন চুক্তি সম্পন্নকে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য বিশেষ অর্জন বলে মনে করেন তিনি। সাংস্কৃতিক দিক থেকে জগন্নাথের অর্জন নিয়ে প্রশ্ন করা হলে বলেন, সম্প্রতি আমাদের চারুকলা অনুষদে রূপান্তর হয়েছে। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগীতের দিকেও অনেক উন্নত। অনেক শিক্ষার্থী এখন সংগীত, নাট্যকলায় তাদের অর্জন নিয়ে আসছে। একটা বিশ্ববিদ্যালয় কতটা উন্নত তা বুঝা যায় সেখানকার সাংস্কৃতিক অগ্রগতি দিকে তাকালে। আর সেটা জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে বেশ ভালো মনে করেন তিনি।
লাইব্রেরি সংকট নিয়ে তিনি জানান, বর্তমানে সবাই প্রযুক্তি নির্ভর। বেশিরভাগ শিক্ষার্থী মোবাইল ফোনে পড়ার কাজ করে থাকে। তবুও আমি বলবো লাইব্রেরিতে বই পড়ার বিকল্প নেই, সেই জায়গায় জগন্নাথ ছোট ক্যাম্পাস হওয়ার কিছুটা সংকট থাকবে। যেটা আছে সেখানে আমাদের শিক্ষার্থীরা পড়াশোনা করে।
বিভাগগুলোর অগ্রগতি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি মাইলফলক হিসেবে মনে করেন তিনি। উদাহরণস্বরূপ তিনি বলেন, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগ এখন দেশ সেরা। নৃবিজ্ঞান ও বাংলা বিভাগ দ্রুত সেমিস্টার শেষ করছে। কোনো বিভাগেই কার্যত সেশনজট নেই।
এছাড়া ফাইন্যান্সসহ আরো একাধিক বিভাগ খুব অল্প সময়ে অনেক উন্নতি হয়েছে বলে জানান তিনি। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়কে এগিয়ে নিতে কাজ করাকে চ্যালেঞ্জ মনে করেন চলতি দায়িত্বে থাকা উপাচার্য অধ্যাপক ড. কামালউদ্দিন আহমদ।
তিনি বলেন, আমাদের অন্যতম চ্যালেঞ্জ ছিল নতুন ক্যাম্পাসের কাজ শুরু করা। সেটা আমরা করতে সক্ষম হয়েছি। আশাকরি ২০২৪ সালের মধ্যে সেগুলো প্রায় শেষ হবে। এখন আমাদের লক্ষ্য প্রাথমিক কাজগুলো শেষ করে শিক্ষার্থীদের জন্য হল নির্মাণে কাজ করা। আমাদের ছেলে-মেয়েগুলো অনেক কষ্টে এখানে থাকে। আমরা চাই কিছু হল নির্মাণ করে আবাসন সংকট কমিয়ে আনা।
নতুন ক্যাম্পাসের কাজ করতে কেমন বেগ পেতে হচ্ছে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, জগন্নাথে পরিকল্পনা ও প্রকৌশল দপ্তরে কাজ করার মতো লোকের সীমাবদ্ধতা ছিল। আগে সেখানে মন্ত্রণালয় থেকে চুক্তিভিত্তিক লোক নিয়োগ ছিল। এখন আমাদের নিজস্ব লোক আছে তাই আশাকরি এবার কাজ ভালোই আগাবে। এছাড়া লেক নির্মাণ ও মাটি ভরাটে ভালোই বেগ পেতে হচ্ছে। নতুন মাটি হওয়ায় বৃষ্টিতে অনেক সময় ভেঙে যায়। এছাড়া দেয়াল নির্মাণের টেন্ডার পাওয়া লোক কাজে দক্ষ নয়, খুবই ধীর গতির কাজ করেন বলে জানান তিনি।
সর্বশেষ তিনি বলেন, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় অবকাঠামো হিসেবে অনেক ছোট ও এর সীমাবদ্ধতা রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে আমাদের প্রথম কাজ হচ্ছে শিক্ষার পরিবেশ নিশ্চিত করা। আমরা সেটি নিয়ে কাজ করছি। দ্বিতীয় ক্যাম্পাস হলে আমাদের বাকি সমস্যাও কেটে যাবে। আমি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও শুভানুধ্যায়ীদের কাছে আহব্বান জানাই, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়কে গিয়ে নিতে আমাদের একসঙ্গে কাজ করার বিকল্প নেই।
বিশ্ববিদ্যালয়টিতে বর্তমানে সাতটি অনুষদে ৩৮টি বিভাগ ও ২টি ইনস্টিটিউট রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ৬৮০ জন শিক্ষকের মধ্যে অধ্যাপক ১৫৬ জন, সহযোগী অধ্যাপক ১৭৭ জন, সহকারী অধ্যাপক ২৯০ জন ও প্রভাষক ৬৭ জন। শিক্ষার্থীর সংখ্যা রয়েছে ১৮ হাজারের বেশি।
এছাড়া এমফিল ২৪৫ জন ও পিএইচডি করছেন ১৪১ জন শিক্ষার্থী। এছাড়াও ৭৩৮ জন কর্মকর্তা কর্মচারী রয়েছে প্রতিষ্ঠানটিতে।
ভোরের আকাশ/নি