শাহীন রহমান: অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় সর্বাত্মক স্থল হামলা চালাতে সেখান থেকে সাধারণ মানুষের সরে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছিল ইসরায়েল বাহিনী। কিন্তু প্রাণ রক্ষায় পালাতে থাকা এসব সাধারণ নাগরিকের শেষ রক্ষা হয়নি। গাজা ছেড়ে পালাতে থাকা বেসামরিক নাগরিকদের একটি কনভয়ে প্রাণঘাতী হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল বাহিনী। খবর রয়টার্স, বিবিসি, আল জজিরা
বিবিসির এক খবরে বলা হয়েছে ঘটনার খুব কাছে থেকেই ওই হামলার ভিডিও করা হয়েছে, যেখানে শিশুসহ বেসামরিক নাগরিকরা মারা গেছে। ঘটনাস্থলে অনেক যানবাহন ক্ষতিগ্রস্ত হতে ও আগুনে জ্বলতে দেখা গেছে। শুক্রবার সন্ধ্যায় গাজার শহরতলী থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে এ ঘটনা ঘটেছে। মূলত ট্রাক ও ব্যক্তিগত গাড়ির কনভয় লক্ষ্য করে বোমা হামলা চালানো হয়েছিল।
এ ঘটনায় অন্তত ১২ জন নিহত হয়েছে, যাদের বেশিরভাগই নারী ও শিশু। শিশুদের বয়স দুই থেকে পাঁচ বছরের মধ্যে। অন্য একটি ফুটেজে দেখা যাচ্ছে হামলার শিকার ব্যক্তিদের দেহ রাস্তায় পড়ে আছে। আর আগুনে জ্বলছে যানবাহনগুলো।
গাজার উত্তরাঞ্চলে বসবাসকারী এগার লাখ মানুষকে ওই এলাকা থেকে আগেই দক্ষিণাঞ্চলের দিকে যেতে বলেছে ইসরায়েল। এরপর অসংখ্য মানুষকে গাড়িতে বা পায়ে হেঁটে ওই এলাকা থেকে পালিয়ে যেতে দেখা গেছে। এমনকি গাজায় এমন একটি বেসামরিক গাড়িতে ইসরায়েলের বিমান হামলায় নারী ও শিশু নিহত হওয়ার ঘটনা ঘটেছে। গত সপ্তাহে সশস্ত্রগোষ্ঠী হামাস ইসরায়েলের ভূখন্ডের হামলা চালায় এবং এতে প্রায় ১৩০০ ইসরায়েলি নিহত হয়েছে। জিম্মি করা হয়েছে আরও অন্তত দেড়শ জনকে। পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে ইসরায়েল ব্যাপক বোমা বর্ষণ করায় গাজায় নিহত হয়েছে ২২০০ ফিলিস্তিনি।
ইসরায়েল ফিলিস্তিন সংঘাতের নবম দিনে এসে দুই পক্ষে নিহত ব্যক্তির সংখ্যা সাড়ে তিন হাজার ছাড়িয়েছে। এখন ফিলিস্তিনের গাজায় হামাস সদস্যদের বিরুদ্ধে বিমান হামলার পাশাপাশি স্থল ও নৌ হামলা চালানোর প্রস্তুতি নিয়েছে ইসরায়েল। এরই মধ্যে গাজা সীমান্তে কয়েক লাখ সেনা সমাবেশ ঘটিয়েছে তারা। এদিকে স্থলপথে হামলা চালানোর জন্য ইসরায়েলও যেমন প্রস্তুতি নিচ্ছে, হামাসও এই হামলা রুখতে তৎপর হয়ে ওঠেছে।
অপরদিকে ইসরায়েলের উত্তরাঞ্চলীয় সীমান্ত এলাকায় ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে ইরান সমর্থিত লেবাননের সশস্ত্রগোষ্ঠী হিজবুল্লাহ। এতে ইসরায়েলের অন্তত এক নাগরিক নিহত ও আরও তিনজন আহত হয়েছে বলে জানিয়েছেন ইসরায়েলের চিকিৎসকরা। হামাসের সঙ্গে যুদ্ধের মধ্যেই রোববার ইসরায়েলের একটি গ্রামে এ ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালালো হিজবুল্লাহ।
প্রাথমিকভাবে ইসরায়েলের চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, লেবাননের আয়তা-আ-শাব এলাকার কাছাকাছি ইসরায়েলের শটুলা কৃষি খামারে ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় ইসরায়েলি এক নাগরিক নিহত ও তিনজন আহত হয়েছেন। ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী বলেছে, হামলার জবাবে লেবাননের ভূখন্ডের গোলাবর্ষণ করা হয়েছে। একই সঙ্গে লেবানন সীমান্ত লাগোয়া ইসরায়েলি ভূখন্ডের ৪ কিলোমিটার এলাকায় জনসাধারণের চলাচল সীমিত করেছে ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী।
এছাড়া ইসরায়েলের উত্তরাঞ্চলের ইফতাচ, মেনারা, মায়ান বারুচ, মিসগাভ আম, ইয়েরন, বার’আম, জিভন, ড্যান, দাফনা, স্নির এবং কাফার হাগিলাদির পাশাপাশি কিবুতজিমের বাসিন্দাদেরও রোববার সকালে নিরাপদ আশ্রয়ে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছে আইডিএফ।
এদিকে ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী এক বিবৃতিতে জানিয়েছে যে তারা গাজায় স্থল, বিমান ও নৌ-হামলার পরিকল্পনা করছে। তবে কখন এই হামলা শুরু করবে সে সম্পর্কে তারা কোনো সুনির্দিষ্ট সময়সীমা জানায়নি। প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের উদ্দেশ্যে বলেছেন, পরবর্তী ধাপ আসছে। শুধু শনিবারেই গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলের বিমান হামলায় নিহত হয়েছে তিনশ মানুষ। সেখানকার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে উদ্ধৃত করে বার্তা সংস্থা রয়টার্স বলেছে নিহতদের বেশিরভাগই নারী ও শিশু। এছাড়া আহত হয়েছে আরো অন্তত আটশ মানুষ।
ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর বিবৃতিতে আসন্ন অভিযানকে বিস্তৃত পরিসরের আক্রমণ হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে। বিবৃতিতে বলা হয়, ইসরায়েলি বাহিনী প্রস্তুতি নিচ্ছে। প্রয়োজনীয় যুদ্ধসরঞ্জাম ইতোমধ্যে সংশ্লিষ্ট স্থানে পাঠানো হয়েছে। কৌশলগতভাবে সারা দেশে সেনা মোতায়েন করা হয়েছে। অভিযানে বিপুলসংখ্যক রিজার্ভ সেনা অংশ নেবেন। অভিযানটি যে ব্যাপক হবে, তা ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর বিবৃতিতে স্পষ্ট করা হয়েছে। একই সঙ্গে অভিযানটি দীর্ঘমেয়াদিও হতে পারে। ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর বিবৃতিতে বলা হয়, সেনাদের একটি বড় ধরনের স্থল অভিযানের বিষয়ে জোর দেয়া হয়েছে। ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর বিবৃতির ইঙ্গিত অনুযায়ী, গাজায় একটি বড় ধরনের স্থল অভিযান শুরু হতে যাচ্ছে।
উত্তর গাজায় সর্বাত্মক স্থর বাহিনীর হামলার প্রস্তুতি ইসরায়ের বাহিনী নিলেও গাজা এখনো হামাসের কব্জায়। আর সেখান থেকেই ইসরায়েলের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে তারা। এই অবস্থায় বিমান হামলা চালিয়ে হামাসের কোমর ভেঙে দেয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে ইসরায়েল। অন্য দিকে, গাজায় ঘরে ঘরে ঢুকে হামাস জঙ্গিদের খুঁজে বার করে খতম করার প্রস্তুতি নিচ্ছে তারা।
কিন্তু ইসরায়েল স্থলপথে হামলার কথা বললেও তাদের সামনে এটি একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে বলে মনে করছেন সামরিক বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, হামাসের তুলনায় ইসরায়েলি সেনার কাছে অনেক বেশি চ্যালেঞ্জিং হয়ে উঠবে হামাসের বানানো সুড়ঙ্গের জাল।
গোটা গাজায় ছড়িয়ে রয়েছে এই সুড়ঙ্গ। যে সুড়ঙ্গপথগুলোকে ভিয়েতনামের সুড়ঙ্গপথের সঙ্গে তুলনা করা হচ্ছে। ২০ বছর ধরে যুদ্ধ চালিয়েও ভিয়েতনামের বিরুদ্ধে জিততে পারেনি আমেরিকা। কারণ আমেরিকার সেনা এই সুড়ঙ্গপথ পার করে ঢুকতে পারেনি। হামাসও সে রকমই গোটা গাজায় সুড়ঙ্গের জাল বিছিয়ে রেখেছে। যা ইসরায়েলি সেনার কাছে অনেক বেশি চ্যালেঞ্জিং হয়ে উঠতে পারে।
২০২১ সালে ইসরায়েল ডিফেন্স ফোর্স (আইডিএফ) দাবি করেছিল, ১০০ কিলোমিটারেরও বেশি হামাসের তৈরি সুড়ঙ্গপথ ধ্বংস করে দিয়েছে তারা। কিন্তু হামাস নেতা ইয়াহা সিনবার পরবর্তীকালে দাবি করেন, গাজায় ৫০০ কিলোমিটার সুড়ঙ্গপথ রয়েছে। যার মধ্যে মাত্র ৫ শতাংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এই সুড়ঙ্গ গোলকধাঁধার মতো। কোথায় শুরু, কোথায় শেষ তার হদিস পাওয়া মুশকিল।
বেশ কিছু রিপোর্টে দাবি করা হয়েছে, কোথাও কোথাও সুড়ঙ্গপথ শুরু হয়েছে গাজার বাসিন্দাদের ঘর থেকে। সেই সুড়ঙ্গ নাকি সীমান্ত পেরিয়ে এক দিকে মিশর এবং অন্য দিকে ইসরায়েল পর্যন্ত বিস্তৃত। আর এই কারণেই ইসরায়েলি সেনা হামাসের এই সুড়ঙ্গ জালকে ‘গাজা মেট্রো’ও বলে থাকে।
ভোরের আকাশ/নি