শাহীন রহমান: ইসরায়ের ও হামাসের মধ্যে চলমান যুদ্ধ গোটা মধ্যপ্রাচ্যে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। গাজার উত্তরাঞ্চলে ইসরায়েল যখন বড় ধরনের স্থল অভিযানের প্রস্তুতি নিচ্ছে ঠিক তখনি তেলআবিবেব ইসরায়েল বাহিনীকে লক্ষ্য করে হিজবুল্লাহর ক্ষেপনাস্ত্র হামলায় উত্তেজনা বাড়িয়ে তুলেছে। এতে একজন ইসরায়েলি সেনাসহ বেশ কয়েকজনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। এর পরিপেক্ষিতে লেবানন ধ্বংস করে দেয়ার হুমকি দিয়েছে। খবর এএফপি, রয়টার্স, বিবিসি, আল জাজিরা
হিজবুল্লাহর এই হামলার জবাবে ইসরাইলের যুদ্ধবিমান থেকে লেবাননে বোমা হামলা চালানো হয়েছে। আর ইসরাইল ডিফেন্স ফোর্সেস (আইডিএফ) সতর্কতা দিয়েছে, যুদ্ধে জড়ালে দেশটিকে ধ্বংস করে দেবে। যুক্তরাষ্ট্র এবং ব্রিটেন আশঙ্কা প্রকাশ করেছে যে, হামাসের সঙ্গে ইসরাইলের এই যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়তে পারে। তাতে যুক্ত হতে পারে মধ্যপ্রাচ্যের বেশির ভাগ দেশ। এমন আশঙ্কার মধ্যেই লেবাননে বিমান হামলা চালিয়েছে ইসরাইল।
যুদ্ধে এখন পর্যন্ত মধ্যপ্রাচ্যের কোনো দেশ হামাসের পক্ষে সরাসরি অবস্থান না নিলেও গাজায় ইসায়েলি বাহিনীর অব্যাহত বর্বরতায় ইতোমধ্যে সব দেশই নিন্দা ও ক্ষোভ জানিয়েছে। এরই মধ্যে গাজায় সর্বাত্মক হামলার প্রস্তুতি নিচ্ছে ইসরায়েল বাহিনী। এই হামলার প্রস্তুতির মধ্যেই ইসরায়েল বাহিনী লক্ষ্য করে ক্ষেপনাস্ত্র হামলায় চালিয়েছে হিজবুল্লাহ।
যুক্তরাষ্ট্র এই যুদ্ধে ইসরায়েলের পক্ষ অবস্থান নিলেও দেশটির প্রধানমন্ত্রী জোবাইডেন বলেছেন, গাজা দখল হবে ইসরায়েলের জন্য মারাত্মক ভুল। মার্কিন টেলিভিশনে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে নেতানিয়াহু সরকারকে এভাবে সতর্ক করেছেন তিনি। খবর এএফপির।
ফরাসি সংবাদ সংস্থাটিতে সোমবার প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘সিবিএস নিউজকে এক ঘণ্টার সাক্ষাৎকারে জো-বাইডেন বলেছেন, গাজায় যা ঘটেছে, আমার দৃষ্টিতে তা হলো হামাস এবং হামাসের বন্ধুরা ফিলিস্তিনি জনগণের প্রতিনিধিত্ব করে না। আমি মনে করি ইসরায়েলের জন্য আবার গাজা দখল করা একটি ভুল। কিন্তু, ভেতরে প্রবেশ করে হিজবুল্লাহ ও হামাসের মতো বিদ্রোহীদের ধ্বংস করে দেয়া প্রয়োজন।
এদিকে গাজায় যখন ইসরায়ের বাহিনী স্থল হামলার প্রস্তুতি নিচ্ছে ঠিক সময় ইরান এই অভিযানের বিরুদ্ধে ইসরায়েলকে সতর্ক করেছে। তারা বলেছে গাজায় উপত্যকায় স্থল অভিযান মধ্যপ্রাচ্যের অন্য জায়গাগুলোতেও সংঘাত ছড়িয়ে পড়তে পারে। আল জাজিরাকে দেয়া সাক্ষাৎকারে ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হোসেন আমির আব্দুল্লাহিয়ান এ সতর্কতা উচ্চারণ করেছেন।
আব্দুল্লাহিয়ান বলেন, গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলের হামলায় শিশুরা নিহত হচ্ছে। এ হামলা অবিলম্বে বন্ধ করতে পদক্ষেপ না নিলে অচলাবস্থা তৈরি হবে। আরো অনেক জায়গায় সংঘাত শুরু হয়ে যাওয়ার ব্যাপক আশঙ্কা আছে। এ আশঙ্কাকে উড়িয়ে দেয়া যাচ্ছে না। এ আশঙ্কা ক্রমে বাড়ছে।
ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, ইসরায়েলি বাহিনী যদি গাজায় ঢোকে, তবে ফিলিস্তিনের প্রতিরোধ আন্দোলনের নেতারা স্থানটিকে দখলদার সেনাদের কবরস্থানে পরিণত করবে।
এদিকে ইসরায়েলের সামরিক বাহিনীর স্থল অভিযানের আশঙ্কায় গাজা উপত্যকার উত্তরের প্রায় ১০ লাখ বাসিন্দা দক্ষিণের দিকে পালিয়ে গেছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। ইসরায়েলি সেনাবাহিনী বলেছে, গত কয়েক দিন ধরে চলমান যুদ্ধে অন্তত ১৯৯ ইসরায়েলিকে অপহরণ করেছে হামাস। অবরুদ্ধ গাজা ভূখন্ডে অবিরাম বিমান হামলা চালিয়ে যাচ্ছে ইসরায়েল। টানা এক সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে চলা এই হামলায় নিহত হয়েছেন আড়াই হাজারেরও বেশি ফিলিস্তিনি। আহত হয়েছেন আরো অন্তত ৯ হাজার ৬০০ জন। ইসরায়েলি হামলায় ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকা পড়ে নিখোঁজ হয়েছেন আরো কমপক্ষে এক হাজার ফিলিস্তিনি।
অন্যদিকে, হামাসের হামলায় নিহত ইসরায়েলিদের সংখ্যা ১ হাজার ৪০০ জনে পৌঁছেছে। নিহতদের মধ্যে ২৮৬ জন সেনাসদস্যও রয়েছে বলে আনুষ্ঠানিকভাবে নিশ্চিত করা হয়েছে।
এদিকে চলমান যুদ্ধে এই উত্তেজনার মধ্যে ইসরায়েলের তেল আবিব শহরে রকেট হামলা চালানোর দাবি করেছে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সশস্ত্রগোষ্ঠী হামাস। সোমবার স্থানীয় সময় দুপুরের দিকে এই হামলা চালানো হয়েছে। তবে এতে তাৎক্ষণিকভাবে কোনো ক্ষয়ক্ষতি কিংবা হতাহতের তথ্য পাওয়া যায়নি। স্থানীয় সংবাদমাধ্যম টাইমস অব ইসরায়েলের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গাজা উপত্যকা থেকে তেল আবিবে রকেট নিক্ষেপ করেছে হামাস।
তবে ইসরায়েলের কেন্দ্রীয় এই শহেরে রকেট হামলার কোনো সাইরেন বাজানো হয়নি। যে কারণে শহরটির বাসিন্দাদের মাঝে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। তেল আবিবের বাসিন্দারা বিশাল বিস্ফোরণের শব্দ শুনতে পেয়েছেন বলে জানিয়েছেন। ইসরায়েলি টেলিভিশন চ্যানেল-১৩ বলছে, গাজা থেকে ধেয়ে আসা একটি রকেট সমুদ্রে পড়ে গেছে।
এদিকে যুদ্ধের উত্তেজনা কিভাবে প্রশমন করা যায় তা নিয়ে জর্ডানের বাদশা আবদুল্লাহর সঙ্গে কথা বলেছেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক। তারা মধ্যপ্রাচ্যে এই যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়া রোধে ক‚টনৈতিক উদ্যোগ নিয়ে আলোচনা করেন। আঞ্চলিক নেতাদের সঙ্গে, ইসরাইলি সরকার এবং ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে এই উদ্যোগের বিষয়ে কথা হয়। হোয়াইট হাউসের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জ্যাক সুলিভানও উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা দেখছেন।
কূটনৈতিক ব্যাকচ্যানেল দিয়ে এই যুদ্ধে জড়িয়ে না পড়তে ইরানকে সতর্ক করা হয়েছে। ইসরাইল ডিফেন্স ফোর্সেস এবং হিজবুল্লাহর মধ্যে তীব্র রকেট বিনিময় হয়েছে বলে রিপোর্ট করেছে জাতিসংঘ। ইসরাইল ডিফেন্স ফোর্সেসের মুখপাত্র লেফটেন্যান্ট কর্নেল পিটার লারর্নার হিজবুল্লাহকে উদ্দেশ্য করে বলেছেন, সীমান্ত অতিক্রম করে যুদ্ধের বিষয়ে তাদের খুবই সতর্ক হওয়া উচিত। হিজবুল্লাহর সঙ্গে কয়েকদিনে সীমান্তে আমাদের কয়েক দফা রকেট বিনিময় হয়েছে। হিজবুল্লাহকে হামাসের পরিণতি দেখার অনুরোধ করছি আমরা।
এদিকে ইরায়েলের বিমান হামলা অব্যাহত রয়েছে। প্রতিনিয়িত বোমার আঘাতে ধ্বংসস্তপে পরিণত হচ্ছে গাজা। উপত্যকাটি এখন মৃত্যুপুরী গেছে প্রায়। ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে আছে হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি। আল-জাজিরার খবরে ফিলিস্তিনি বেসামরিক প্রতিরক্ষা দলের বরাত দিয়ে বলা হয়েছে গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলি বিমান হামলায় ধ্বংস হয়ে যাওয়া ভবনগুলোর ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে হাজারের বেশি মানুষ নিখোঁজ হয়েছেন। টানা এক সপ্তাহ ধরে দখলদাররা হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। যারা নিখোঁজ হয়েছেন, তাদের মৃত্যুর আশঙ্কা ব্যাপক। ভাবনগুলোয় হামলার ২৪ ঘণ্টা পর বহুজনকে বিভিন্ন ধ্বংসস্তূপ থেকে জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে।
গাজার দক্ষিণের শহর খান ইউনিসের ওপর দিয়েও মানবেতর পরিস্থিতির জোয়ার বয়ে যাচ্ছে। শত সহস্র মানুষ গাজার উত্তরাঞ্চল থেকে যে যা কিছু বহন করতে পেরেছে, তা নিয়ে এখানে পালিয়ে এসেছে। দক্ষিণাঞ্চলের প্রতিটি ঘর, প্রতিটি অলিগলি, প্রতিটি রাস্তা নারী-পুরুষ আর শিশুদের ভিড়ে পরিপূর্ণ হয়ে আছে। তাদের আর কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই।
ফিলিস্তিনের এই সংকীর্ণ উপত্যকা এলাকার চারদিক অবরুদ্ধ এবং বাকি বিশ্বের থেকে বিচ্ছিন্ন, যেখানে সুযোগ-সুবিধা ও বিকল্প অনেক সীমিত, যেখানে নিশ্চিত নিরাপত্তা বলে কিছু নেই। এই বিপুল সংখ্যক গাজাবাসী এখন এক জায়গায় জড়ো হয়েছেন। যাদের অনেকে ইতোমধ্যেই বোমা হামলায় তাদের বাড়িঘর হারিয়েছেন, নিঃস্ব হয়েছেন, প্রতিনিয়ত আতঙ্কের সঙ্গে বসবাস করছেন, সামনে কী হতে পারে কেউ কিছুই জানে না। খান ইউনিস শহরটিতে মূলত চার লাখের মতো মানুষ বসবাস করেন। এখন রাতারাতি এই শহরের লোকসংখ্যা বেড়ে ১০ লাখ ছাড়িয়েছে।
এদিকে ইসরায়েল বাহিনীর হামলায় প্রতিদিন গাজায় শ শ মানুষ মারা যাচ্ছে। হাসপাতালের মর্গে তিল ধারণের জায়গা নেই। গত ৭ অক্টোবর থেকে গাজা উপত্যকায় অব্যাহত হামলা চালাচ্ছে ইসরায়েলের সেনা। যার জেরে ইতোমধ্যেই মৃত্যু হয়েছে ২৬০০ ফিলিস্তিনের। জখম হয়েছেন সাড়ে সাত হাজারেরও বেশি মানুষ। এই পরিস্থিতিতে গাজার হাসপাতাল এবং কবরখানায় মৃতদেহ রাখার জায়গা না হওয়ায়, আইসক্রিমের ট্রাক কিনেছেন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। গাজার দায়ের আল-বালাকের শুহাদা আল-আকসা হাসপাতালের এক চিকিৎসকই বিষয়টি জানিয়েছেন সংবাদ সংস্থা রয়টার্সকে।
তিনি বলেছেন, আমার হাসপাতালের মর্গে আর ১০টি দেহ রাখার জায়গা ছিল। তখনই বিকল্প ব্যবস্থা করার সিদ্ধান্ত নিই। একটি আইসক্রিম ফ্যাক্টরি থেকে আইসক্রিমের ট্রাক কেনার ব্যবস্থা করি। ওতে মর্গের থেকে বেশি দেহ রাখার জায়গা রয়েছে। যে সমস্ত দেহ মর্গে পড়ে রয়েছে তার খোঁজে আসেনি কেউ। কী করেই বা আসবেন? হয়তো গোটা পরিবারটাই আর নেই। ফলে পড়ে থাকতে থাকতে মৃতদেহে পরিবর্তন আসতে শুরু করছে। ক্ষমতার থেকে বেশি দেহ সংরক্ষণ করায় ধীরে ধীরে পচন ধরতে শুরু করেছে সেই সব দেহে। একই অবস্থা কবরস্থানেরও।
মৃতদের সমাধিস্থ করার জায়গা পাচ্ছে না গাজা প্রশাসন। যে সমাধিক্ষেত্রটি ছিল সেখানে আর এক ছটাক ফাঁকা জায়গা নেই আর। গাজা প্রশাসন তাই প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে গণকবরের। ইতোমধ্যেই ১০০ জনকে সমাধিস্থ করার ব্যবস্থা করেছে তারা। কিন্তু রোজ যেখানে শ শ মানুষ মারা পড়ছেন সেখানে এই একটি গণকবরের ব্যবস্থা করে কী হবে প্রশ্ন ওঠেছে?
ভোরের আকাশ/নি