logo
আপডেট : ২১ অক্টোবর, ২০২৩ ১০:২৩
খাদ্য তালিকা কাটছাঁট করেও চলছে না সংসার
মুস্তাফিজুর রহমান নাহিদ

খাদ্য তালিকা কাটছাঁট করেও চলছে না সংসার

মুস্তাফিজুর রহমান নাহিদ: করোনাকালীন সময় থেকে বিশ্ব অর্থনীতির অবস্থা মন্দা চলছে। এই মন্দার হাওয়া লেগেছে স্বল্প আয় মধ্যম আয়ের দেশ থেকে শুরু করে উন্নত দেশ পর্যন্ত। করোনার ধাক্কা না কাটতেই মরার উপর খাঁড়ার ঘার মতো অবস্থা করেছে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ। যা বিশ্বকে আরো মন্দার দিকে ঠেলে দিয়েছে। বৈরি হাওয়া লেগেছে বাংলাদেশেও। অন্যান্য দেশ কিছুটা ঘুরে দাঁড়াতে পারলেও পারছেন বাংলাদেশে। সময় যত যাচ্ছে নিত্যপণ্যের বাজারে উত্তাপ তত বাড়ছে।

 

পক্ষান্তরে মানুষের আয় বাড়ছে না। টিকে থাকতে তাই অনেক আগেই খাদ্য তালিকায় কাটছাঁট করেছেন নিম্ন বিত্ত-মধ্যবিত্তরা। পরবর্তীতে যার হাওয়া লেগেছে উচ্চবিত্তদের গায়ে। ফলে খাদ্য তালিকায় ছোট করেও টিকে থাকতে পারছে না কেউ। বাজারে ঢুকে নাকাল হচ্ছে সবাই। প্রহর গুনছেন কবে এর থেকে মুক্তি মিলবে।

 

মো. আবুল বাশার (ছদ্ম নাম) একজন বেসরকারি চাকরিজীবী। তিন ছেলে-মেয়ে, স্ত্রী ও মাকে নিয়ে তার ছয়জনের সংসার। আগে মাসের বাজার একসঙ্গে করতেন। প্রতি মাসে গরুর মাংস কিনতেন চার থেকে পাঁচ কেজি। মুরগি কিনতেন ৪টি। চাল, ডাল, তেল, চিনিসহ অন্যান্য সবকিছু হিসাব মতো কিনে নিতেন। মন্দা আসার পর তার খরচ বেড়েছে ছেলে স্কুল ছেড়ে কলেজে উঠেছে। বাসাভাড়া বেড়েছে।

 

মায়ের অসুস্থর জন্য বেড়েছে ওষুধের খরচ। উল্টো বেতন বাড়েনি এক টাকাও। এর মধ্যে পাগলাঘোড়ার মতো ছুটে চলছে বাজার। তরতর করে দাম বাড়ছে সবধরনের পণ্যের দাম। ফলে বাধ্য হয়ে খাদ্য তালিকা ছোট করেছেন। গরুর মাস পাঁচ কেজি থেকে ২ কেজিতে নেমে এসেছে। কমে গেছে মুরগি, মাছ খাওয়া। ভাত ছাড়া প্রায় সব ধরনের খাদ্য তালিকায় ছোট হয়েছে। কিন্তু এরপর টিকে থাকা দায় হয়ে পড়ছে।

 

কারণ নিত্যপণ্যের বাজারের স্বস্তি আসার বদলে দিন দিন আরো গরম হচ্ছে। বর্তমানে মাছ-মাংস-ডিম-সবজিসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় সবধরনের পণ্যের দাম লাগামহীন হয়ে পড়েছে। সরকারি নির্দেশনার বিন্দুমাত্র তোয়াক্কা না করেই উচ্চমূল্যে বিক্রি হচ্ছে কাঁচাবাজারের সব পণ্য। বাজারের এই লাগামহীন পরিস্থিতিতে হাঁপিয়ে উঠছেন ক্রেতারা। প্রায় এক মাস হয়ে গেছে সরকার নিত্যপ্রয়োজনীয় কৃষি পণ্যের দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে। তবু নিয়ন্ত্রণে আসেনি কাঁচাবাজারের পণ্যের দাম। এরমধ্যে সরকার ডিম আমদানির সিদ্ধান্ত নেয়, আমদানিও করে। কিন্তু এর প্রভাব পড়েনি বাজারে। দাম কমার পরিবর্তে উল্টো বেড়েছে।

 

কারওয়ানবাজারে গিয়ে দেখা যায়, চাল-ডাল- চিনির পাশাপাশি সবধরনের পণ্যের দামই বাড়তি। প্রতি ডজন লাল ডিম ১৫০ টাকা ও সাদা ডিম ডজন প্রতি ১৪৫ টাকায় বিক্রি করতে দেখা যায়। মানভেদে দেশি পেঁয়াজ ১০০-১১০ টাকা, ক্রস জাতের পেঁয়াজ ১০০ টাকা, ভারতীয় পেঁয়াজ ৭৫ টাকা, আলু ৫০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে।

 

অথচ সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী প্রতি কেজি পেঁয়াজের সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য ৬৪ থেকে ৬৫ টাকা। আলু কেজিতে ভোক্তা পর্যায়ে ৩৫/৩৬ টাকা ও কোল্ড স্টোরেজ থেকে ২৬/২৭ টাকা দাম হওয়ার কথা। কিন্তু বাজারে গেলে সরকারের নির্দেশনার কিছুই বোঝার উপায় নেই। ক্রেতাদের সঙ্গে কথা বললে তারা জানায়, তাদের কিনতে হয় বেশি দামে, ফলে কম দামে বিক্রি অসম্ভব।

 

জানতে চাইলে আবুল হোসেন নামে এক বিক্রেতা বলেন, আমি গতকাল রাতে দেশি পেঁয়াজ আর ক্রস পেঁয়াজ কিনেছি। আমার কেনা পড়েছে দেশিটা ৯৩ টাকা আর ক্রস ৯২ টাকা। আর আমি বিক্রি করছি দেশিটা ১০০ থেকে ১০৫ টাকা আর ক্রস ১০০ টাকায়।

 

সবজির বাজারে এসেও হাঁসফাঁস করতে হচ্ছে ক্রেতাদের। চড়া দামে কিনতে হচ্ছে সব ধরনের সবজি। গতকাল কারওয়ান বাজারে লম্বা বেগুন ১০০ টাকা, সাদা গোল বেগুন ১২০ টাকা, কালো গোল বেগুন ১৪০ টাকা, শসা ৮০ টাকা, করলা ১০০ টাকা, উচ্ছে ১২০ টাকা, পেঁপে ৪০ টাকা, পটল ৮০-১২০ টাকা, কাঁকরোল ১০০ টাকা, গাজর ১২০ টাকা, মুলা ৮০ টাকা, টমেটো ১০০ টাকা, মিষ্টি কুমড়া ৬০ টাকা, ঢেঁড়স ৭০ থেকে ১০০ টাকা, চিচিঙ্গা ৮০ টাকা, ধুন্দল ৮০ টাকা, বরবটি ১২০ টাকা, কচুরমুখী ১০০ টাকা, শিম ২০০ টাকা, কাঁচামরিচ ২৪০ টাকা, ধনেপাতা ২০০ কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে।

 

আর প্রতিটি লাউ ১০০ টাকা, ফুলকপি ৭০ টাকা, বাঁধাকপি ৭০ টাকা ও চাল কুমড়া ৬০ টাকা করে বিক্রি হচ্ছে। বাজারে আসা ক্রেতারা বলছেন, এভাবে দাম বাড়তে থাকলে খেয়েপরে বেঁচে থাকা কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে উঠবে।

 

জানতে চাইলে নাখালপাড়া থেকে বাজার করতে আসা মো. মিজানুর রহমান বলেন, মহল্লার বাজারে সবধরনের সবজির দাম চড়া। ভেবেছিরাম। এরা হয়তো সিন্ডিকেট করে দাম বাড়িয়েছে। তাই ভাবলাম কারওয়ানবাজার থেকে কিছু কমে বেশি করে বাজার করে রাখব। কিন্তু এখানে এসে একই চিত্র দেখা যাচ্ছে। ৮০ টাকার নিচে কোনো সবজিই পাওয়া যাচ্ছে না। অথচ এখন সবজির মৌসুম। এখানো কোনো ধরনের সিন্ডিকেট হচ্ছে কি না তা খতিয়ে দেখা দরকার।

 

এদিকে বাড়তি দরে বিক্রি হচ্ছে মাছ। ইলিশ তো মিলছেই না। রুই মাছ ৪৫০-৬০০ টাকা, কাতল মাছ ৪০০-৪৫০ টাকা, কালিবাউশ ৪০০-৬০০ টাকা, চিংড়ি মাছ ৮০০-১০০০ টাকা, কাঁচকি মাছ ৫০০ টাকা, কই মাছ ৩৫০ টাকা, পাবদা মাছ ৫০০ টাকা, শিং মাছ ৫০০-৫৫০ টাকা, বেলে মাছ ১১০০-১৩০০ টাকা, বোয়াল মাছ ১১০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে।

 

একই অবস্থা মাংসের বাজারে ব্রয়লার মুরগি ১৮০-২০০ টাকা, কক মুরগি ২৯০-৩১৫ টাকা, দেশি মুরগি ৫৫০ টাকা, গরুর মাংস ৭৫০-৭৮০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। বেড়েছে ডালের দামও। মোটা মসুরের ডাল দাম বেড়েছে ৫ টাকা। আগে দাম ছিল ১০৫ টাকা কেজি, এখন তা হয়েছে ১১০ টাকা। এছাড়া ছোট মুসরের ডাল ১৩০ টাকা, মুগ ডাল ১৩০ টাকা, খেসারি ডাল ৮০ টাকা, বুটের ডাল ৯০ টাকা, ছোলা ৭৫ টাকা, প্রতি লিটার বোতলজাত সয়াবিন তেল ১৭৫ টাকা, চিনি ১৩৫ টাকা, দুই কেজি প্যাকেট ময়দা ১৪০ টাকা, আটা দুই কেজির প্যাকেট ১২০ টাকা, খোলা সরিষার তেল প্রতিলিটার ২২৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

 

এদিকে বিষয়টি নিয়ে কথা বললে সংশ্লিষ্টরা বলেন, বেশিরভাগ জিনিষেরর দাম বাড়তি এ কথা ঠিক। তবে আমাদের দেশে সব চলে যায় সিন্ডিকেটের হাতে। যার ভোগান্তি পোহাতে হয় সাধারণ জনগণের। তাই সবার আগে সিন্ডিকেট দমন করতে হবে।

 

ভোরের আকাশ/নি